ভয়েস অফ জঙ্গলমহল ও একটি তথ্যচিত্র

ভবেশ মাহাত মূলত একজন কবি, আর এক কবির নজরে উঠে এলো এক তথ্যচিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। ভবেশ বর্তমানে মেদিনীপুরেেে বাসিন্দা কর্মসূত্রেে শিক্ষক কিন্তু তাঁর মুক্তি নানান সৃজনশীলতায়। আজ বাইফোকালিজম্-এ তিনি একজন তথ্যচিত্র সমালোচক।

ভয়েস অফ জঙ্গলমহল”র

লালজল ও তারাফেনীঃএকটি প্রাণের তথ্যচিত্র-মৃণালকান্তি মাহাত

লিখলেনঃ ভ বে শ   মা হা ত

একটা বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য হল, তারাফেনী নদীর সভ্যতা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে অনেক নিবন্ধও। তবে বেশিরভাগ জঙ্গলমহলের বাইরের মানুষের গবেষক ও লেখক কর্তৃক। তাই হয়তো অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে যায় জঙ্গলমহলের সংস্কৃতি কে না চেনার কারণে। এক্ষেত্রে ছবির গবেষক, পরিচালক ও বাকি কলাকুশলী রাও জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্র। নিজেদের চোখে নিজেদের ইতিহাস। তাই ছবির পরতে পরতে যত্ন ও ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট।
বেলপাহাড়ীর ভূমিপুত্র হপন মাঝির এশিয়াটিক সোসাইটি টে প্রদত্ত ভাষনের উপর নির্ভর করেই ছবিটি নির্মিত হয়েছে। সদ্যপ্রয়াত গবেষক কে ছবিটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলি যেমন ছিল নদী কেন্দ্রিক, ঠিক তেমনই বর্তমান জঙ্গলমহলের আদিবাসী – কুড়মী জনজাতির মানুষেরা ‘তারাফেনী’ নদীকে আশ্রয় করে তাদের সভ্যতার শিকড় গাড়তে থাকেন।
আমারই সমবয়সী কবি, গল্পকার, স্বল্প দৈঘ্যের চিত্র পরিচালক (Documentary) মৃণালকান্তি মাহাত এর লেন্সে উঠে এলো সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সৌন্দর্যায়িত বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের বেলপাহাড়ী এলাকার তারাফেণী নদী এবং তারাফেণী সভ্যতার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কিছুদিন আগেই আমিও এখানকার সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করে এসেছি। এখানে জল – জঙ্গল আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যেন সুদক্ষ চিত্রকার তাঁর সুনিপুণ দক্ষতা দিয়ে চিত্রায়িত করেছেন শাল-পিয়ালের জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে তারাফেণী নদী মহুয়ার গন্ধে মাতাল হয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। এমন সৌন্দর্য দেখে এবং মেখে সেদিন আমারও মাতাল হওয়ার উপক্রম।
কিন্তু মৃণালের দেওয়া তথ্যগুলি না থাকায় সেদিন আমি সমৃদ্ধ হতে পারিনি। সেদিনের সেই অসম্পূর্ণ তৃপ্তি আজ যেন সম্পূর্ণ হলো মৃণালের এই ‘লালজল’ তথ্যচিত্রটি দেখে। লালজল গ্রাম এবং এখানকার পাহাড় নিয়ে তথ্যচিত্রটি দর্শক বন্ধুদের মুগ্ধ ও সমৃদ্ধ করবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। লালজল গুহাতে রামস্বরূপ দেবশর্মা নামে সন্ন্যাসীর কথা আমরা জানতে পারলাম মৃণালের উদ্দ্যোগে এবং স্থানীয় রঞ্জিত মাহাত – এর মুখ থেকে। এখান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে আদিম যুগের মানুষের ব্যবহৃত পাথরের অনেক অস্ত্রশস্ত্র।
মৃণাল এর সাথে আপনারাও একমত হবেন যে, আমাদের আদিম ইতিহাস যা দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গলমহলের রুক্ষ পাথর হয়ে উপেক্ষিত, তা কোনো এক রাজকুমার এসে নতুন ভাবে উদঘাটন করবে বোবা পাথরের রাজকুমারীকে। আর মৃণালের ‘লালজল’ তথ্যচিত্রটির হাত ধরেই হয়তো তার সূচনা হলো।


সব শেষে যে কথাটা না বললে চলে না – তথ্য ও চিত্র, দুটোই মৃণালের হাতের জাদুর ছোঁয়ায় জঙ্গলমহলের পাহাড় – নদী ও জঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জীবন্ত রূপে ধরা দিয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের ওপর থেকে লালজল গ্রামের মনোরম চিত্র, পাহাড়ের ওপর গুহা এবং গুহা কেন্দ্রীক তথ্যচিত্রটি আপনাকে বারবার দেখতে আগ্রহী করে তুলবে।


ছবিটিতে কোন ঐতিহাসিক এর বক্তব্য নেই। থাকলে আরো এর বিশ্বাসযোগ্যতা আরো বেড়ে যেত। কিছু কিছু জায়গায় অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য ব্যাবহার করা হয়েছে, যা সময় বিশেষে দৃষ্টিকটূ লাগে।তবে মোটা-কথা এই তথ্যচিত্রটি অন্তত একবার বেলপাহাড়ি প্রেমীদের দেখে নেওয়া লাভজনক।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *