২১শে-র গল্পঃ ভাষা সংকট

২১শে-র গল্প 

ভাষা সংকট

                                       

অনুশ্রী তরফদার
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২০ 

মনিকার আজ মনটা বড় অস্থির  হয়েআছে ।রিমি স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই মনিকার মাথায় চিন্তা টা বারবার নাড়াচাড়া করছে।কিছুতেই মনকে স্থিতু করতে পারছেনা।আজতো স্কুল থেকে ফিরেই রিমি তার কাছে আবার তার প্রশ্নের উত্তর চাইবে ।এই পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে মনিকার প্রথমবার মনে হয়েছে  এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর তার  জানা নেই ।সহজ সরল শিশু মনের প্রশ্ন । রিমি মনিকার পাঁচ বছরের মেয়ে ।সে শহরের একটা নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রী ।নানা ঔৎসুকতা নানা প্রশ্ন এই বয়সের মনের মাঝে উঁকি মারে ।সবে সে নিজের মতো করে জীবনকে দেখতে চিনতে ও কিছু শিখতে চাইছে ।আর তার সব জিজ্ঞাসা মনিকার কাছেই । সুদীপ অর্থাৎ মনিকার স্বামী রিমির বাবা ব্যস্ত মানুষ ।বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত ।সারাদিনই বাড়ির বাইরে । কখনো কখনো ট্যুরে মাসের কুড়ি দিনই শহর ছাড়া । সাড়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট বাড়িতে আর কেউ থাকেনা ।সুদীপের মা বাবা মনিকার বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই গত হয়েছেন । তাই সংসারে লোক বলতে তারা মাত্র তিন জন ।সেই জন্য মেয়ের সব ঝক্কি ঝামেলামনিকা কেই সামলাতে হয় ।কোন কোনদিন সুদীপ যখন বাড়ি ফেরেরিমি তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বোনে ।তাই বাবা ও মেয়ের কাছে আসা খুবই কম ।সেসব তো বাস্তব পরিস্থিতি , জীবন সংগ্রাম এর কথা ।কিন্তু সমস্যা হয়েছে গতকাল রিমিরপ্রশ্নে ।বাসে করে স্কুল থেকে ফেরার সময় উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কথোপকথন থেকে রিমি মাদার টাংও মাতৃভাষা শব্দ টা শুনেছে । মাদার টাং শব্দ টা রিমির কাছে  খানিক পরিচিত থাকলেও মাতৃভাষা টা সেনতুন শুনেছে । রিমি স্কুল থেকে ফিরেই মনিকা কে প্রশ্ন করে বসে মামাতৃভাষা কাকে বলে ? আমাদের মাতৃভাষা কি ?মনিকা তার ছোট্ট মেয়ের প্রশ্ন শুনে একটু চমকে যায় ।কিছুক্ষণ থেমে বলে সোনা আমরাযে ভাষায় কথা বলি যেটা আমাদেরজন্মগত ও জাতিগত সেটাই মাতৃভাষা ।আমরা তো বাঙালি তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ।রিমি মায়ের উত্তরে যে আশ্বস্ত হয়নি সেটামেয়ের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলো মনিকা । হঠাৎই রিমি বলে ওঠে মা আমরা তো স্কুলে ইংরেজি তে কথাবলি আবার কোন সময় হিন্দি তে ।তাহলে বাংলাই কেন শুধু আমাদেরমাতৃভাষা হবে ?মনিকা ভালো করেই জানে বর্তমানে টিভির দৌলতে সববাচ্চারা নিজের ভাষার চেয়ে হিন্দিতে বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে ।রিমি কে স্কুল বাসে উঠিয়ে দিতে গেলে বাসস্ট্যান্ডে রিমি ও তার সহপাঠীরা
একে অপরের সঙ্গে হিন্দি তে ও 
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে ।অনেক বোঝানো স্বত্বেও তারা 
সেটাই করেথাকে ।যাই হোক এবার মনিকার মুখ গোধূলি বেলার আকাশের মতো কমলাটে গোলাপি হয়ে ওঠে ।সে মনে মনে ভাবতে শুরু করে এ কোনচরম সংকটের মুখে আমাদের ভাষাঅস্তিত্ব ? কি উত্তর দেবে মেয়ে কে ?সমাজে নিজেদের পজিশান বজায়রাখতে ও পরিবেশ কে অনুকুলে রাখতে তদুপরি মেয়ের ভবিষ্যতেরকথা মাথায় রেখে মনিকা ও সুদীপরিমি কে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করেছিল ।ভর্তি করার সময় প্রথম ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি কে তারারেখেছিল । এবং ক্লাস ফাইভে উঠলে তৃতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেবে সেটা ভেবে রেখেছিল।কারন সর্ব ভারতীয় স্তরে পড়তে গেলে বা চাকরির ক্ষেত্রে ও এই দুটিভাষাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে ।আবার বিদেশে পড়তে গেলে বা চাকরি সুত্রে গেলে ইংরেজি তে দক্ষহওয়া আবশ্যক ।কিন্তু ভেবে দেখেনি তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে ।যাই হোক তখনকার মতো মেয়ে কেবোঝানোর জন্য মনিকা রিমি কে দেশের বহু জাতি বহু ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বলতে শুরু করে ।সে বলে পাঞ্জাবি দের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি , গুজরাটি দের মাতৃভাষা গুজরাটি , অসমিয়া দের ভাষা আসামি এভাবে তামিল , তেলেগু ,উড়িয়া যতটা সম্ভব উদাহরণ দিয়েবোঝাতে চেষ্টা করে যায় । মায়ের কথা রিমি কতটা বুঝতে পারে তাবোঝা না গেলেও রিমির দ্বিতীয় প্রশ্নশুনে মনিকার মাথায় যেন একসাথেঅজস্র তার কাঁটা মাথা ফুটো করে খুঁচিয়ে অস্থির করে তোলে ।রিমি বলে মা আমাদের ক্লাসের ম্যাম ইংরেজি তে কথা বলতে বলেছে , কিন্তু আমরা যেহেতু ইংরেজি তে ভালো করে কথা বলতে শিখিনি  তাই হিন্দি তে কথা বলতে দেয় 
মাঝে মাঝে । কিন্তু বাংলা তে কথা বললে পানিশমেন্ট দেবে ।এবার বলো মা আমাদের মাতৃভাষা কোনটা বাংলা, হিন্দি না ইংরেজি ? মনিকার মুখ দিয়ে আর একটি কথাও বের হয়না।সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রসঙ্গঘোরানোর জন্য বলে সোনা মা তুমিকখন স্কুল থেকে ফিরেছ , হাত মুখধুয়ে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবেতো !সন্ধ্যে বেলাতে হোমওয়ার্ক আছে না ? চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো । রিমি আবার বলে মা তুমি বললে না তো কোনটা আমাদের মাতৃভাষা ? মনিকা বলে কাল তোমাকে বলবো । এখন চলো তো মা তোমার তো খিদে পেয়েছে ,আমরা এখন গল্প করতে করতে খাওয়া টা শেষ করে নি ।ঘুম থেক উঠে রিমি  এই প্রসঙ্গে আর একটিও কথা বলেনি। শুধু রাতে শোয়ার সময় বলে কালউত্তর দেবে তো মা ? মনিকা মেয়েরমাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেহ্যাঁ দেব ।আজ রিমি কে স্কুলে পাঠানোর পর থেকে মনিকা ভেবেইচলেছে কিভাবে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দেবে ।প্রত্যেকেরই অধিকার আছে নিজের মাতৃভাষা তে কথা বলার ।মাতৃভাষা ছাড়া কি কেউ নিজের আবেগ অনুভুতি অন্তর অভিব্যক্তিকে বাইরে বের করে আনতে পারে ?তার মনে পরে যায় বাবার কাছে 
শোনা ভাষা আন্দোলনের কাহিনী ।কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে অধুনা বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপরে জোর করে উর্দু ভাষা কে চাপিয়ে দিয়েছিল । তাদের বাধ্য করেছিল উর্দু তে কথা বলতে লিখতে ও বিভিন্ন স্কুল কলেজ 
বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলার  পরিবর্তে উর্দু ভাষা কে বহাল 
করতে ।নিজের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে সেই সময় অসংখ্য তাজা প্রাণ একটা শিক্ষিত যুগ শেষ হয়ে গেছে ।কত মায়ের কোল খালি হয়েছে কত শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে ।অবশেষে তাদের আন্দোলন ও বলিদান  সার্থক হয় ।বহু দুর্মূল্য প্রাণের বিনিময়ে সেখানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় । তারপর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারী  দিনটি শুধু সেখানেই নয় গোটা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান পায় ।আরও শুনেছে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার অধিকারের আন্দোলনের কথা।অথচ সেই বাংলাতেই বাংলা  ভাষা কে অপমানিত হতে হচ্ছে ।তার মনে পরে যায় স্বামী বিবেকানন্দের কথা ,তিনি বলেছিলেন ব্রাহ্মণ যুগ , ক্ষত্রিয় যুগ , বৈশ্য যুগ ও শুদ্র যুগেরকথা ।এখন সেই বৈশ্য যুগের সময় ।যেখানে ব্যাবসার জন্য মাতৃভাষাকেও প্রায় বিক্রি করে দিতে হয়েছে ।বিশ্বায়ন ও ব্যাবসার কথা মাথায় রেখে আমরা নিজেদের ভাষাকেকোণঠাসা করে আন্তর্জাতিক বাজারের কথা মাথায় রেখে বিদেশিভাষাকে প্রধান স্থানে বসিয়েছি ।আমরা মুখে অনেক বড় বড় কথা বললেও নিজেদের সন্তান কে ভর্তিকরি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ।যে কোন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান , দোকান , বাজার , ষ্টেশন , হাসপাতাল সব জায়গাতেই প্রাধান্যপায় ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা ।ব্যতিক্রমি কিছু সরকারি কাগজে হয়তো বাংলা অপশন থাকে ।ইন্টারভিউ দিতে গেলেও এই বাংলার মাটিতে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষাতে পারদর্শী হওয়া আবশ্যক ।ওদিকে বর্তমান সরকার ও হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ।আঞ্চলিক ভাষাও সেখানকার  মানুষ কে নানাবিধ কৌশলে কোণঠাসা করতে চাইছে সরকার । এরা চাইছে এক জাতি এক ভাষা ।এর চেয়ে অপমানজনক আর কিছু নেই ।সব কিছুই ব্যবসায়িক আঙ্গিকে হচ্ছে ।কিছু ধনকুবের কে খুশি করতে দেশের পরিকাঠামো তুলে দেয়া হচ্ছে  তাদের হাতে । এসব তো গেল বড়দের কথা। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা এসবের কি বোঝে ।কি করে বোঝাবে মনিকা ওকে ? অনেক ভেবে মনিকা মনে মনে একটা উত্তর তৈরি করে ।সে তৈরি মেয়ের সামনে নিজের সামান্যবিদ্যে বুদ্ধি দিয়ে একটা যুতসই  উত্তর দিতে ।রিমি স্কুল থেকে ফিরেই মাকে বলে মা এখন বলবে তো কোনটা আমাদের মাতৃভাষা ? মনিকা মুখেহাসি এনে বলে হ্যাঁ মা বলব ।তুমি আগে পরিষ্কার হয়ে খেয়ে নাও তারপরে আমি বলব ।মেয়ের খাওয়া শেষ হলে হাত মুখ  ধুইয়ে  মুছিয়ে মনিকা একটা  কমলালেবু     ছাড়িয়ে রিমি কে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে সোনা মাতুমি কার কাছ থেকে কথা বলতে শিখেছ ? রিমি বলে তোমার কাছ থেকে তো শিখেছি । মনিকা বলে আমিও আমার মার  কাছ থেকে কথা বলতে শিখেছি । তাহলে তুমি কোন ভাষাতে আমার কাছে কথা বলতেশিখেছ ? মেয়ে বলে মা তুমি কি বোকা !নিজেই বাংলাতে কথা বলতে শিখিয়েছ আবার নিজেই জিজ্ঞেসকরছ ? মনিকা বলে হ্যাঁ সোনা তুমিঠিক বলেছ ।তাই আমরা মায়ের কাছ থেকে যে ভাষাতে কথা বলতেশিখি যে ভাষায় কথা বলি সেটাই আমাদের মাতৃভাষা ।আমরা বাঙালি তাই আমদের মায়ের ভাষা বাংলা।আমরা এই ভাষাতেই কথা বলি ।ইংরেজি হোল আমদের শেখার  জন্য এমন একটি ভাষা যা শিখলে  আমরা এই পৃথিবীর প্রায় সব  দেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে  পারব কথা বলতে পারব আর  আমাদের  দেশের বাইরে গিয়েও কাজ করতে পারব ।আর হিন্দি হোল আমাদের দেশের এমন একটি ভাষা যে ভাষাতে অনেক মানুষ কথা বলে ।আবার তোমরা সহজেই এই ভাষা বুঝতে শিখতে ও বলতে পারো ।তাই তোমরা হিন্দি তে বেশি কথা বল ।দেশের বেশির ভাগ জায়গায় তুমিগেলে এই ভাষাতে কথা বলতে পারবে ।কিন্তু নিজের ভাষা কে কখনো ছোট করতে নেই ।তোমাদের স্কুলের ম্যাম তোমাদেরকে অনেক বড় মানুষ হওয়ার জন্যইংরেজি ও হিন্দি তে কথা বলতে বলেছে ।কিন্তু সোনা তুমি বাড়িতে একটু বাংলা বললেও বাসে বন্ধুদেরসাথে বা অন্য কোথাও গেলে বাংলাতে কথা বলতে চাওনা কেন ?তুমি কি তোমার মা কে মা না বলেতোমার বন্ধুর মা কে মা বলে ডাকবে?রিমি বলে কাভি নেহি ।ওহ সরি , না আমি কাওকে মা বলে ডাকব না ।তুমি তো আমার বেস্ট মা ভালো মা।মনিকা তখন বলে তাহলে বাংলা কে তোমার মাতৃভাষা না বলে তুমি  অন্য কোন ভাষাকে মাতৃভাষা  বলবে  তুমি সেটা ভাবো রিমি ।তারপর আমায় জানাবে ।রিমি বলে না মা আমি তো এখন একটু জানলাম যে আমাদেরমাদার টাং মানে মাতৃভাষা কেবলবাংলা । এখন থেকে স্কুল ছাড়া সবসময় আমি বাংলাতেই কথা বলব ।তুমি আমায় বাংলা লিখতে পড়তেশিখিয়ে দেবে মা ?মনিকার চোখে আনন্দে জল চলে আসে । সে আবেগ সামলাতে না পেরে মেয়েকেজড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় ।সে পেরেছে উত্তর দিতে , হেরে যায়নিসে । শুধু মনে মনে বলে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি আমরা । ভবিষ্যতের উচ্চাশায় আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে এনে দাড় করিয়েছি ।নিজেদের সংস্কৃতি ,ঐতিহ্য  ও  নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করা এবং সম্মান করার দায় আমাদের সবার ।           

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *