সমানাধিকারের সংজ্ঞাঃ মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি



বিশেষ নিবন্ধ 

                                               ছবিঃ প্রসেঞ্জিৎ মণ্ডল

                    সমানাধিকারের সংজ্ঞা
             গ্রামের অধিকাংশ মহিলাই বোঝেন না

                                    মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

  দেশে-বিদেশে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঘটা করে ‘কন্যাদশক’ ‘আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ’ উদযাপিত হচ্ছে। আর প্রতি বছর ৮ মার্চ ‘বিশ্বনারী দিবস’ হিসাবে দিনটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করে থাকি। নারীবর্ষ, নারীদিবস- এর গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে নারীদের অধিকার, তাদের সমস্যা, মর্যাদা, পুরুষদের ন্যায় সমদাবী ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমিতি- সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, আগামী দিনেও হবে। ভালো কথা। অবশ্যই এগুলোর প্রয়োজন আছে। কারণ এইসব আলোচনা, সভা-সেমিনার থেকেই আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হয়। বিশেষ করে যে আন্দোলনের সঙ্গে নারীদের প্রশ্নটি জড়িত।  
   কিন্তু যেভাবে দিনের পর দিন দিকে দিকে সর্বত্র নারীদের উপর অবিচার, নিপীড়ন, নিগ্রহ করা হচ্ছে তাতে করে প্রশ্ন জাগছে সত্যিই আমরা তেমনভাবে নারীদের সম্মান করতে পারছি তো?
   এটা দুর্ভাগ্য- আমাদের সমাজে নারীরা আজও নানদিক দিয়েই বঞ্চনা, অবমাননা ও অবজ্ঞার শিকার। যাকে আমরা নারীমর্যাদা বলি তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লঙ্ঘিত, ভূ-লুণ্ঠিত। আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমানাধিকারের সংজ্ঞাটাই অধিকাংশ নারীদেরই বুঝতে দেওয়া হয় না। তাদের সম্মান করার বদলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা। শিশুকাল থেকেই একটি কন্যাসন্তানের উপর যে অনাদর, অবহেলার পাষাণভার চাপিয়ে দিই সেই ভার সে সারাজীবন ধরেও এতটুকু লাঘব করতে পারে না। শুধুমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারণেই নারীদের প্রতি একটা একটা ভেদরেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। একজন নারীরও যে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা থাকতে পারে সে ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, গুরুত্ব দেওয়া হয় না তারও একটা স্বাধীনসত্তা আছে। গ্রামীন মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা তো আরও খারাপ। বলা যেতে পারে ভয়াবহ। একটু বেশি মাত্রাতেই বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার আমাদের দেশের গ্রামের মেয়েরা। মেয়েদের এই বঞ্চনার দিকগুলি যেমন তুলে ধরেছে সেমিনারগুলি তেমনি নারীবাদী আন্দোলনকে গতিশীল ও জোরদার করবার এক মুখ্য ভূমিকাও গ্রহণ করেছে।
   তবু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- এই যে নারীবাদী আন্দোলন চলছে এর সুফল বা কল্যাণ গ্রামীন মহিলাদের উপর কতখানি পড়ছে? শহরের মহিলারা সেখানকার পুরুষদের তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে নেই- তা তাদের কাজকর্মেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেখানে মেয়েরা স্কুল-কলেজ যাচ্ছে, পড়াশোনা করছে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি-বাকরি করছে। অর্থাত্‍ পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে হাঁটার একটা প্রশংসনীয় প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 
   কিন্তু গ্রামের মহিলাদের ক্ষেত্রে এই দৃশ্য তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে কী? উত্তর-না। নারী আন্দোলন গ্রামের মহিলাদের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। সম-অধিকারর দাবি জানানো তো দূরের কথা-এখানকার অধিকাংশ মহিলাই সমানাধিকারের সংজ্ঞাটা জানে না। গ্রামীন মহিলারা বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকার মহিলারা পুরুষদের সৃষ্টি সামাজিক প্রথা ও নিয়মকানুনে সামান্যতমও আঘাত হানতে পারেনি। এদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, যুক্তি বিচারবোধ তেমন নেই বললেই চলে। বিবাহিতা নারীরা তাদের স্বামীর কথাতেই উঠ-বোস করে। ডাইনে বললে ডাইনে যায়, বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। 

                                       

   ধান সেদ্ধ, মুড়ি ভাজা, স্বামী-সন্তানের জন্য খাবার প্রস্তুত করা, তাদের খাওয়ানো দাওয়ানো, তারই মাঝে গরু-বাছুর দেখাশোনা করা, মাঠে-গোঠে যাওয়া- এই নিয়েই এদের ব্যস্ত থাকতে হ্য়। এর বাইরে অন্য জীবন এরা বোঝে না। এরা বোঝে রাঁধার পর খাওয়া-খাওয়ার পর রাঁধা। স্বামীর বকাঝকা, গাল মন্দ সবই নির্বিবাদে হজম করতে হয়। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। প্রতিবাদ করতে গেলেই কপালে জোটে প্রহার ও অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন-নির্যাতন।
   কেন এরকমটা হচ্ছে? উত্তর একটাই- শিক্ষার অভাবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীসমাজ পিছিয়ে আছে বলে অর্থাত্‍ তারা তেমনভাবে স্বাবলম্বী নয় বলে। শিক্ষার আলোটা সেরকমভাবে না পড়ার জন্য গ্রামের মেয়েদের বন্দিদশা আজও ঘুচেনি। পুরুষদের একচেটিয়া শাসনব্যবস্থাকে ইচ্ছায় হোক- অনিচ্ছায় হোক মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। একেই তো গ্রামে নিরক্ষরের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে আবার মহিলারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে নারীর সম্মান ও তাদের মর্যাদা। 
   গ্রামের মহিলারা এখনো কতখানি বঞ্চনার স্বীকার, অবহেলার পাত্রী তা গ্রামে গেলেই টের পাওয়া যায়। খুব ছোটবেলা থেকেই কন্যাসন্তানদের বঞ্চনার কাল শুরু হয়ে যায়। দেখা গেছে- কোনো পরিবারে হয়তো দু’টি সন্তান। তার একটি ছেলে, একটি মেয়ে। পুত্রসন্তানটিকে যেভাবে আদর যত্ন করা হয়- তার অনেকটাই কম জোটে কন্যাসন্তানটির ভাগ্যে। বৈষম্য শুরু এখান থেকেই। এখান থেকেই কন্যাসন্তানটির উপর একটা ভেদরেখা টেনে দেওয়া হয়।
   কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মা-বাবাই কন্যাসন্তান চান না। চাইলে কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো ঘৃণ্য ও পাশবিক ঘটনা আকছার ঘটতো না। কন্যাসন্তান মানেই একটা দায়, বাড়তি বোঝা মনে করে অনেক বাবা-মা-ই। আবার দেখা যায় কোনো পরিবারে হয়তো পরপর দু’টি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। এই সময় যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হোত তাহলে পরিবারটা যেমন ছোট থাকত, তেমনি মেয়ে দু’টোও মানুষ হবার একটা সুযোগ পেত। 
   কিন্তু দু:খের ব্যাপার ঐ কন্যাসন্তান নিয়ে মা-বাবার চাহিদা মেটে না। একটা অন্তত পুত্রসন্তান চাই। পুত্রসন্তান না হলে বংশরক্ষা করবে কে? পুত্রসন্তানের এই অতিরিক্ত চাহিদা ঐ সংসারে দেখা গেছে শেষ পর্যন্ত করুণ পরিণতি ডেকে এনেছে। তাগা-তাবিজ, মাদুলি-কবজধারণ, ঠাকুর-দেবতাদের মন্দিরে যাওয়া ইত্যাদিতেও ফল হয়নি। আবার কন্যাসন্তান জণ্মগ্রহণ করেছে। এইভাবে একের পর এক সন্তান সংখ্যা বেড়েছে। আর কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে ঐ মহিলার কপালে জুটেছে চরম লাঞ্ছনা এবং নির্মম অত্যাচার।
   আর আশ্চর্য ঘটনা! কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয় মহিলাকেই। পুরুষদের নয়। নারী আন্দোলন চলছে ঠিকই- কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এইসব ধ্যান-ধারনা এবং অজ্ঞতার মূলে তেমন আঘাত আজও হানতে পারেনি যা থেকে এই বৈষম্য দূর হবে। গ্রামীণ মহিলাদের সমস্যা আগে যেমন ছিল এখনো তাই আছে। বিশেষ কিছু হেরফের হয়নি। এরজন্য পুরুষের কায়েমী স্বার্থ যেমন দায়ী তেমনি দায়ী মহিলারা নিজেরাও। মহিলারা তেমনভাবে জাগতে পারছে না। জাগার চেষ্টাও নেই- নেই কোনো আগ্রহ। দু’একজন মহিলা যদি পুরুষদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে তবে অন্যান্য মহিলাদের সমর্থন সে পায় না। মেয়ের দোষটাকেই তারাও বড়ো করে দেখে। গ্রামে এক-দু’জন মহিলা যারা চাকরি-বাকরি করে তাদের দেখে অন্যান্য মহিলারা যে শিখবে সে আগ্রহও নেই। বরং ঐ সব মহিলারা চাকরি করা মেয়েটির শুধু দোষ খোঁজার চেষ্টাই করে। অবাধ সময়ের বেশির ভাগটাই পরচর্চা ও পরনিন্দা করে কাটিয়ে দেয়। যার ফলে নারী বৈষম্যের জগদ্দল পাথরটা আজও সরছে না। 
   বিগত কয়েকটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এই উদ্যোগ নিশ্চয় প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু নির্বাচিত ঐসব মহিলা প্রতিনিধিরা কতটা নিজ বিচার-বুদ্ধির জোরে কাজ করেন, তাদের স্বাধীনতাও কতখানি দেওয়া হয় তাতে প্রশ্ন ও সন্দেহ দুই-ই থেকে 

                                   

যায়। তবু বলবো এই পদক্ষেপ নারীসমাজের স্বাধীকারের প্রশ্নে এক বলিষ্ঠ চিন্তা-ভাবনা। গ্রামীণ মহিলারাও এই ক্ষেত্রে অনেকটা সুযোগ পাচ্ছেন। 
   এতদসত্ত্বেও বলা যায় গ্রামাঞ্চলের নারী আন্দোলন এখনো পর্যন্ত তেমন দানা বাঁধতে পারেনি। যে অন্ধকার ছিল সেই অন্ধকারেই পড়ে আছে। নারী জাতির প্রতি অবমাননা তাই বেড়েই চলেছে। একটা সমাজ বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে চলে নারী-পুরুষ উভয়েরই কর্মপ্রচেষ্টা ও সম্মিলিত প্রয়াসে। একজনকে পিছনে রেখে উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। নারী জাতিকে পিছনে ফেলে তো নয়-ই। যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বলেছেন- “উড়তে জরুরি পাখির দু’টি ডানাই/ উন্নয়নে চাই নারী-পুরুষ সবাই”। 
   নারীরা শুধু সন্তানের জন্মই দেয় না। সেই সন্তানের শিক্ষায়  প্রথম কাজটা শুরু হয় মায়ের হাত ধরেই। মায়ের সু-শিক্ষার ফলে সন্তানটি একদিন দেশের ভবিষ্যত্‍ নাগরিক হিসাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। সেই মায়েদের অবহেলা, অনাদর, অশিক্ষা, নির্যাতন কখনোই কাম্য হতে পারে না। মেয়েরা যাতে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পায় সেই দিকটি আমাদের সবাইকে দেখতে হবে। এরজন্য সঠিক পরিকল্পনা নেওয়ার প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনি আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটানো দরকার। নইলে যতই ঘটা করে ‘কন্যাদশক’, ‘নারীবর্ষ’ এবং ‘নারীদিবস’ পালন করা হোক না কেন কাজের কাজ কিছু হবে না। এই মহান ভাবনায় ভাবিত হতে হবে আমাদের- একটি বলিষ্ঠ সমাজগঠন নারীর সাহচর্য ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। 

    
                                  ★★★
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *