ছবিঃ গৌতম মাহাতো
আদিত্য মুখোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
কবির কবিতার সাথে যাপন বহুকালের। এপার বাংলা ওপার বাংলার নানান বানিজ্যিক পত্র-পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে তার কবিতা পাঠককে বারবার মুগ্ধই শুধু করে নি,পাঠককে নিয়ে গ্যাছে সেই সব অনন্তের খোঁজে..
নারী
১
সামান্য শাস্তির জন্য চোরের ভূমিকা,
চুরি করে পালিয়ে বেড়াই।
যাই। কিন্তু কত দূর আর যেতে পারি
মাঞ্জার-সুতােয় বাঁধা থেকে।
মা-মণি তােমার জন্য আনন্দ-উৎসব
স্বর্ণজলি-আবাডাঙা ঘিরে।
কখন যে ভোকাট্টা হয়ে যাই
লাঙল-হাটায়।
ছােট-লাইনের ট্রেন অনায়াসে ফেরে,
আমার লাটাই
নারীর দুকুলে তুলে দিয়ে।
২
অসীমাদি-মুক্তা-রুনুতপতীর সারি
বিশ্বাকাশে নারীমাত্র নয়,
বহু বেশি তার চেয়ে ধরিত্রী সমান।
জ্ঞান হতে একান্তে দেখেছি
নারীতে নারীতে ভগবান।
সঙ্গদোষ
নতুন পাখির সঙ্গে গাছের আলাপ হলে–
ভাল লাগে। লাফিয়ে বয়স কমে যায়।
শুকনাে ডালেও এসে বাসা বাঁধে মুকুল-মঞ্জুরী
যেীবনের-খাজ ঘিরে নবীন-কিশােরী, নাকি নারী পাখিদের সারি।
গাছে ফুল, বুড়াে-হাড়ে জেগে ওঠে টাট্টুর ক্ষমতা
বুড়াে-বাঘ কৌশলে-কুশলী হয়ে ওঠে।
পাখি এলে, মাথার চাদরে ফোটে সবুজ-বাহার
চোখের কোণায় লাগে হার্বাল-মলম,
পাখি গেলে, হাহাকার বেজে ওঠে পাহাড়-চুড়ায়।
এপাখি এভাবে উড়ে বারােমাস কোথায় পালায়?
ডালে বসাে, ছড়িয়ে-জড়িয়ে থাকা সাপের মতােন,
রঙালি প্রেরণা-পাখি লক্ষ্মীর-আটন।
পাখির আলাপে গাছ উর্ধরেতা বাউল-সাধক
ট্রেনে-বাসে সঙ্গদোষ, গান গায় সাধন-সঙ্গিনী।
সত্য বলি, বয়স বাড়ে না কিছুতেই।
সহজিয়া
ছেলেটির বাড়ি বালিজুড়ি গ্রাম। নদী নেই কোনও পাশে
শীত পড়তেই ফুলবেড়ে তবু সেজে ওঠে বালিহাঁসে,
তিন-দিঘির পাড়ে আছে সেই দাঁতন-দেবীর থান
গণদেবতার জন্য দেশে-বা না তাঁকে নিয়ে লেখা গান।
রেলপথ দূরে দুবরাজপুর। আধারের ঘরে খিল ছেলেটি এখন কোলাঘাটে থাকে, এতটুকু নেই মিল, নদী আছে ঘরে, রূপনারায়ণ। ব্যারেল মেচেদায়
প্রিয় নারী তার-পাছছায়াটি, একেবারে নিরালায়।
শরৎ এলেই কাশফল-মা, শিউলি-ছােপানাে ঘাস অপুর-উঠোনে ছায়াছবি হয়ে জেগে থাকে বারো মাস,
এখানেও সেই পটে আঁকা রোদ-সকালের রানিবালা
মাটির গন্ধে ম-ম করে ওঠে—দুপুরে ভাতের থালা।
তবে কেন দূরে মনে হওয়া, বালিজুড়ি-কোলাঘাট
কেন যে হারায় প্রতিদিন তবু বালকের রাজপাট।
মাথা-উঁচু করে ফ্রেমে বধা ছবি,সেদিনের কত ভুল একই মাটি ছোঁয়া। নাড়িকাটা-মাঠ। জননীর নাভিমূল।
একই মাটি-কথা। একই পার্টি পাড়া। একই পাখি বুলবুলি
কনকচাঁপার একই সৌরভ। যেখানেই ফুল তুলি।
তবু সেই প্রাণ বুকের দেরাজে, মনে পড়া লােকগান…
এই বুঝি সেই পাঁজরের তলে-জন্মভূমির টান!
জন্মভূমি কি এতটুকু জমি? এতটুকু ঠাঁই? সেই বালিজুড়ি পানে?
মানতে পারি না। শুধু মনে হয়,—জন্ম আমার পৃথিবীর সবখানে।
মাটিতে মাটিতে যােগ জুড়ে আছে-বড়-আকাশের নীচে
ব্যথাহত দিন, একক-ভাবনা, বড় একপেশে মিছে।
সেলফোনে ভাসে নব-উত্থান-গলায় নগর-মালা
স্মৃতি-ভারতুর বাঁধনা-পরব। গাজনের গান।’বােধ’ জুড়ে ঝালাপালা
ই-মেলে পাঠাই চিঠি-পত্তর। এই গ্রামে বসে। বিশ্বটি আমলকী।
মানুষের গান শাপলা-শালুক। সবখানে জেগে থাকি।।
নির্মাণ
এইখানে সেই টাংশুলি গ্রাম। উঠোনে ঝোলানো নদী।
জালিবাগানের সাঁওতাল-মাঠ। তার থেকে দুরে কেদুলির নীলকুঠি।
ছোট ছোট সব রাজা-জমিদার। কথা গাথা তার অতীতের ধারাপাতে,
বীররাজা তাঁর স্মৃতিবাহী কালি। চৈত্য সিং-এর লাঙুলিয়া লােকালয়
অতীত এখানে বাদশাহী পথে সিউড়ি-ভাগলপুর।
আম জোড়া ঘাটে ইতিউতি ভাঙা ভাঙা।
প্রভু এসেছেন একদা এখানে বৈষ্ণব-চূড়ামণি,
তবু তো গোপাল চুরি গেছে সেই দ্বিতীয় বৃন্দাবনে
আজকে শিকড় হারিয়েছে তার, জনপদ উঠে যায়,
ক্লান্ত রাজনগর…!
হাহাকার বাজে সবখানে শুধু। গাঁয়ে-ঘরে বাড়ে আঁধারের অধিকার।
ঝুলে থাকে নদীর দুকূলে উজার হয়ে,
ভাণ্ডীরবন-ও আছে কতকাল
রথবাড়ি, আর গোপালের সীমানায়।
‘চোরচোর-বনে চোর বাড়ে রােজ দাদাগিরি বাড়ে, ছিনতাই পথেঘাটে
আঁধারের চোরা ঘুমে
মসনদ বেঁষে বীরভূম-রাজ সাঁওতাল বীরসহ,
গিয়েছিল এই পথে
চলাে আমরাও যাই।
শিবগাঁজন
মানব বন্দনা শুধু লােকায়ত মৃত্তিকা-মেলায়
দেবার্চনা নয়,
যাকে যা মানায়।
সঙের গাজন আর চৈত্রান্ত বিকেল
চড়কতলার মাঠে মজলিসে লােক, কত লোকে-
এ শিব চাষির।
ছড়ায় আকন্দ- কুঁড়ি আমকুশি মাঠের মহিমা
বােলানের গানে গানে ধূপ পােড়ে বেত্রগুচ্ছে জট।
এ শিব চাষির শিব, এ শিব কৃষক-শিব
দেবতা উপমা।
★★★