গপ্পো
লেখা ও ছবিঃ রাকেশ সিংহদেব
প্রকৃতি প্রেমের আরেক নাম।ভালোবাসার কোনও বাটখারা হয় না তা লেখকের সাথে না যাপন করলে বোঝা বড্ড দায়।মূলত রাকেশ একজন ছবিওয়ালা।আর তার চর্চার আধার সেই সব অবলা জীবজন্তু পশু পাখি।নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায়।এই মুহূর্তে কাজ করছেন হাতি নিয়ে।বিভিন্ন “পরিবেশ বাঁচাও” সংস্থার সাথে জড়িয়ে ফেলেও তিনি নিরঙ্কুশ।একক।তিনি জানেন ভালোবাসতে ফেরৎ পেতে নয়।ইনি বাইফোকালিজমেরও অন্যতম সদস্য।
কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি।তাই মাছ ব্যতিরেকে বাঙালি তার অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। আমাদের পাতে মাছই যদি না থাকে তবে সেই পাত সম্পূর্ণ হয় কি করে!তাই মাছের নানা পদই বাঙালিকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে।অনেকেই মজা করে বলেন- “বাঙালি মরলে মেছো ভুত হয়”।
প্রায় প্রত্যেকটি রান্নাঘরেই মাছ নিয়ে নানান পদ তৈরির গবেষণা অদ্যাবধি দিব্যি চলে আসছে।মাছ আছে তাই বাঙালি আছে।
মাছ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রয়েছে নানা ছড়া, কবিতা ও গল্প। বাংলা উপন্যাসে রয়েছে মাছ, মাছ ধরা ও জেলেদের জীবন নিয়ে নানা কাহিনী। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন, ‘খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে/ পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।’ ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বাঙালির অন্যতম ব্যঞ্জন বা তরকারি হিসেবে মাছ রাঁধার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন- ‘কৈ ভাজে গণ্ডাদশ মরিচ গুঁড়িয়া আদারসে’। পশ্চিমবাংলার চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকে মাছ উৎকীর্ণ রয়েছে। গবেষকদের ধারণা ফলকটি চতুর্থ শতকের হতে পারে।
মাছ ভাত আর বাঙালি এই ত্রয়ী আদি অনন্তকাল ধরে অবিচ্ছেদ্যতার বন্ধনে আবদ্ধ। মাছের খোঁজে নদীমাতৃক বঙ্গভূমির নদনদী, খালবিল, জলাভূমি, জলাশয়ে চালিয়েছে অভিযান। নেশা থেকে পেশায় মাছের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার রসনাতৃপ্তির আস্বাদ! এই তৃপ্তি আজও সুপুষ্ট করে চলেছে মৎসপ্রিয় বাঙালির জাত্যাভিমান! এই তালিকায় কতশত মাছের নাম সংযুক্ত হয়েছে, আবিষ্কার হয়েছে হাজারো লোভনীয় রেসিপি আবার সময়ের সাথে হারিয়েও গেছে এর অনেক কিছু।ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হতে হতে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া এরকম এক স্বাদু জলের মাছ হল চেলা মাছ। লম্বাটে ও চ্যাপ্টা দেহের এ মাছটির রং সাদাটে বা উজ্জ্বল রূপালী এবং দেহের উপরিভাগ সবুজাভাব বা ঈষৎ ধূসর বর্ণের। স্থানীয়ভাবে এই মাছটি চেলা, জুলুং, ছলুং (পশ্চিমবঙ্গ) কাটারী বা নারিকেলি চেলা (বাংলাদেশ) নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Salmostoma bacaila (Hamilton)। পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৮ সে.মি. এর অধিক হলেও সচরাচর ৬-৮ সে.মি. আকারের মাছই বেশী দেখা যায়।
চেলা মাছের চচ্চড়ি অমৃতসম। চেলা মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু। এই মাছ দিয়ে টমেটোর অম্বল বা টক একটি বিখ্যাত খাবার। চেলা মাছ লাল করে ভেজে ঝোল রান্না করে বাঙালিরা। বাজারে সর্বদাই টাটকা অবস্থায় এ মাছটি পাওয়া যায় এবং ক্রেতাদের কাছে এ মাছটির ভাল চাহিদা রয়েছে। অতুলনীয় স্বাদ ও পুষ্টিমানের জন্য চেলা মাছ অনেকেরই প্রিয়। চেলা মাছে ১৪.৬ শতাংশ প্রোটিন, ৪.৩ শতাংশ ফ্যাট ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিভিন্ন খনিজ উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও লৌহ থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় এই চেলা মাছ বাঙালি জীবন ও বাঙালি রান্না-বান্নার সংস্কৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন বাজারে আর এই চেলা মাছের সচরাচর খোঁজ পাওয়া যায়না।
চেলা মাছ পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা সহ সকল ধরনের মিষ্টি জলের জলাশয়ে পাওয়া যায়। এরা পরিষ্কার ও জলজ উদ্ভিদ বিহীন জলে থাকতে পছন্দ করে। জলের উপরের স্তর থেকে খাদ্য গ্রহণকারী এ মাছ পোকামাকড়ের শূককীট, ছোট আকারের পোকামাকড় ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। জলে কোনো পোকামাকড় পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে চেলা মাছ এসে সেটাকে আক্রমণ করে ছিঁড়ে ফালা ফলা করে খেয়ে ফেলে। মাছ শিকারিরা ঠেলা জাল, মশারি, ধর্ম জাল, পাতলা কাপড় ইত্যাদি দিয়ে এই মাছ ধরে।
চেলা মাছ বর্ষার মৌসুমে হালকা স্রোতযুক্ত জলাশয়ে প্রজনন করে থাকে। আবাসস্থল নষ্ট, অতিরিক্ত আহরণ, অবৈধ মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহার করে মৎস্য আহরণের ফলে বর্তমানে এ মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। আমাদের রাজ্যের অধিকাংশ স্বাদুজলের নদ নদী, পুকুর নালা, খাল বিল নগরায়নের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে বা বিভিন্ন ভাবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে চেলা মাছের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। মেদিনীপুর সংলগ্ন কংসাবতী সহ অন্যান্য নদ-নদীগুলো শিল্পবর্জ্যে এবং কীটনাশকের মারাত্মক দূষণের শিকার হওয়ায় ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এই মাছ।
★★★