গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস-“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৮তম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র ১৮তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৮তম পর্ব)

ফিরে দেখা

 

“Life’s but a walking shadow…”  Shakespeare (Macbeth)

ফিরে দেখা জিনিসটা অনেকটা দীর্ঘদিন বাইরে থাকবার পর ঘরে ফেরার মতো। বিদেশ বিভুঁই যতই আরাম আর বিলাসে কাটুক না কেন রিটার্ন টু নেটিভল্যাণ্ড হলো একটা নষ্টালজিয়া। তা সে তার ভিতর যত কষ্ট দুঃখ এবং যন্ত্রণার ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতি থাকুক , যতখানি স্বপ্নের অপমৃত্যু থাকুক, যতখানি বেদনার পাড়ভাঙা বন্যায় ডুবে যাওয়া ঘরবাড়ির বিবর্ণ জানলা দরজা জেগে থাকুক জীবন্ত জীবাশ্মের মতো।

আমি জানি না একটা জংলী দ্বীপ যার আগাপাশতলা একটা প্রাগৈতিহাসিক মোড়কে বাঁধা, যে জীবন জীবন নয়, যে অশ্রু শুধুই জল ছাড়া কিছু নয়, যে অন্ধকার আস্ত দিনের চৌখসে বাকি বিশ্বের নজরে পড়ে না, অথবা নজরে পড়লেও তা নিতান্ত অবজ্ঞার যোগ্যও নয়, গাছ গাছালি, জংগলের গহীন অন্ধকারে মানুষ সাপ গাঙ যেখানে একাকার; মানব সভ্যতার অমন নির্মম কবরস্থানের ইতিহাসহীন যাদুঘরে কে কবে কেন স্মৃতির সরণি ধরে যেতে চাইবে, আমি জানি না। আমি দর্শনের কথা বলছিলুম আপনাদের। সেই দর্শনেই একটা গভীর খুঁটি পোঁতা আছে আমার নিজের সমুদ্রে যে, পৃথিবীর  ইতিহাস আসলে মানুষেরই ইতিহাস। মানুষের আসা যাওয়া, সভ্যতার ধ্বংস জন্ম, এত এত মৃত্যুহীন পথচারী যাদের প্রত্যেক পদক্ষেপে জেগে উঠে সভ্যতার নিশান, তাদের ইতিহাস ও ইতিহাসহীনতা নিয়েই কাগুজে ইতিহাস, যা মোটা মোটা বইতে লেখা আর যে বইএর মাঝখান থেকে কেউ খাবলা মেরে ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে নিয়েছে  দু চারটে দশটা পাতা। হয়তো সে হারিয়ে যাওয়া পাতায় লেখা ছিল গভীর অনুরাগের অনেক ছোট ছোট কাহিনি, আঁকা ছিল কয়েকটা ঢ্যাঙ্গা খালি পা আর ছেঁড়া জামা পরা লোকের ছবি।

আমি আর শম্ভু হেঁটে যাচ্ছি দীর্ঘ পথ। আসলে পথ ছিল শম্ভুর, আমার ছিল মত। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল এ পথে শম্ভু দিশাহীন হয়ে পড়বে। এ পথ তার জন্য ফুল নয়, কাঁটা রেখেছে পরতে পরতে। কিন্তু, আপনি আমি,  আমরা সবাই জানি মাঝে মধ্যে আমাদের খুব মনে হয়, বুক চেপে ধরে বলি, আমি যেন ভুল হই, আমার ধারণা যেন ভুল হয়। একবার আমাদের জংগলে একটা মরা শুশুক জোয়ারের জলে ভেসে এসে একটা গাছে আটকে গেছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে মানুষের লাশ, মরে পচে ফুলে গেছে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না,  তারপর যত লাশ এসেছে ভেসে, দৌড়ে দেখতে যাবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে মনে মনে চেয়েছি, কাছে গিয়ে যেন দেখি ওটা মানুষ নয়, শুশুকের লাশ। হয়তো মরা লোকটার হাত দেখা যাচ্ছে , পা দেখা যাচ্ছে, তবুও বলছি, ভাবছি আর মনের উপর জোর দিয়ে বিশ্বাস করাতে চাইছি ওগুলো শুশুকের পাখনা৷ জলে জংগলে মানুষের লাশ দেখে ভয় কিংবা কান্না পেত না, ভয় বা কান্নার একটা আবহ নিজের ভিতরেই ভয়ংকর একটা ঘন্টা বাজিয়ে দিত “অর বৌ কী খাবে? টকাগুয়া কী খাবে? ” শম্ভুর সংগে পথে হাঁটছি বটে, কিন্তু আমার ভিতর দুটো মানুষ যার একজনের মস্তিষ্ক আর অন্যজনের হৃদপিণ্ড ছাড়া কিছু নেই,তখন সে পথ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত।

সাত সকালে বেরিয়েছি দু’জনে। আমাদের দ্বীপের বাইরে অন্য একটা দ্বীপে,বলতে গেলে  অন্য একটা দেশে যাচ্ছি। অন্য একটা সভ্যতায় যাচ্ছি আমরা যেন আসলে। গোটা দ্বীপটা হেঁটে নৌকা পেরোতে হবে। ঘন্টা মিনিটের হিসেব বলতে পারিনে, তবে এটুকু জানতুম সাত সকালে বেরোলে হেঁটে খেয়া ঘাটে যখন যাবো তখন জলখাবারের বেলা হয়ে যাবে। আমাদের সময় আমরা সময় অনুযায়ী কাজ করতুম কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের কাজের নাম দিয়েই সময়ের হিসেব করতুম। এই যেমন জলখাবারের বেলা, গা ধোয়ার বেলা,ভাত খাবার বেলা এইরকম আর কি! কাঁচা রাস্তা, দু’পাশে পাকা ধান তখন রাস্তার উপরে এসে মাথা লুটোচ্ছে। ঘাসে ঘাসে শবনম সকালের নতুন সূর্যের রাঙা আলোয় ঝলমল করছে। শম্ভুর খালি পা ভিজে যাচ্ছে তার ছোঁয়ায়। আমার পায়ে একজোড়া চপ্পল ছিল। কিন্তু শিশিরজলের দৌরাত্মে বারবার ভিজে পা হড়কাচ্ছিল, তাই খুলে অনেকক্ষণ হলো হাতে নিয়ে হাঁটছি। খেয়া পেরিয়ে ওপারে গিয়ে পরে নেবো। শম্ভুর গায়ে একটা পুরানো বগলছেঁড়া জামা, কোমরে একটা পায়ের কাছে ফেঁসে যাওয়া প্যান্ট। আমি বল্লেম ” নৌকা পারি করিয়া তুই জুতাগা পরবু”

জুতা?

হঁ

কাই?

এই তো আমার গুয়া।

কেনি?

শ্লা, বকাচদা, তুই গৌরির সংগে দ্যাখা করবু, পায়ে জুতা নাইলে খেরাপ লাগবেনি?

খেরাপ লাগবে কেনি?

জাঁইনি,তবু তুই পরবু।

শম্ভু একগাল হেসে ফেল্লে,

শ্লা, বৌর সাথে দ্যাখা করতে যাইটি, ব্যা হওয়া বৌ। আর অখঁ জুতা জামা এগা লিয়া ভাবার টাইম?

শম্ভু হেঁটে যাচ্ছে, কোথাও মনে হবার জো নেই যে সে গৌরির সংগে দেখা করতে যাচ্ছে। দ্বীপের বাইরে যতক্ষণ না বেরিয়েছি জীবনে জানতুমই না, শম্ভুর মতো প্রেমিক হয়। সে অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছে, নাঙ্গা পায়ে, পায়ের নখের আগায় জমাট বেঁধে আছে আমাদের গাঙের আঠালো কাদা। তার হাতে একটা নাইলনের হাতল ছেঁড়া ব্যাগ। তার মধ্যে আছে পৃথিবীর সেরা বস্তু, এক গাছা চুড়ি। আমার দীনতা মাফ করবেন, আমি আজ অব্দি অমন দুর্লভ দামী জিনিস নিয়ে কাউকে ভালবাসার একটা নিটোল বিন্দুর দিকে হেঁটে যেতে দেখিনি।

খেয়া ঘাটে যখন পৌঁছালুম, তখন সূর্য আজ সারাদিন কতটা নির্মম হয়ে জ্বলবে তার আভাস দিচ্ছিল। শম্ভু তার নাইলনের ব্যাগ থেকে একটা কুড়ি পয়সা বের করল। তখন খেয়া ভাড়া দশ পয়সা ক’রে ছিল। নৌকার গলুইর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে পয়সাটা দিয়ে দিল। এক হাঁটু কাদায় নেমে খেয়া পেরোতে হতো তখন। আজ যেমন দু পাশে ঘাটে কত দোকানদানি, লোক জন, সন্ধ্যা হলে আলোর ব্যবস্থা, কংক্রিটের ঘাট, মোটরচালিত নৌকা, তখন এসব ভাবার সাহস আর জ্ঞানের সীমা কোনোটাই আমাদের ছিল না। এক হাঁটু চটচটে কাদা মেখে নৌকায় উঠলুম। নৌকার গলুইর দিকে একটা কাঠের বাটাম মেরে গলুই থেকে ওই বাটাম অব্দি একটা জামচট পাতা থাকতো, একটা দড়ি লাগানো বালতি থাকতো ওখানে। ওই বালতিতে করে জল তুলে ওখানে পা ধুতে হতো। ছোট্ট গাঙ। এখানেও দু ধারে ঘন জংগল। ঘন ম্যানগ্রোভের ভিতরে সরু একফালি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে ঘাটের জন্য। ওপারেও তাই। তবে এ গাঙ আমাদের গাঙের কাছে নিতান্ত শিশু। এ শুধু আকারে ছোট নয়, তার উদ্দামতা আর যৌবন কোনটাই আমাদের গাঙের মতো নয়। জল এখানে সারাবছরই প্রায় শান্ত থাকে। তাই কুমীর এখানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়। চরে শুয়ে থাকে, জলে ভুস করে ভেসে উঠে, লেজের ঝটকায় একেবারে ধার থেকে তুলে নিয়ে যায় শিকার। এ গাঙ নিয়ে আগে বলেছি, পরেও বলবো আরো।

খেয়া পেরিয়ে ওপারে গিয়ে একটা পুকুরে হাত পা ধুয়ে পুকুরের পাড়ে বসলুম। শম্ভু ব্যাগ থেকে গামছায় বাঁধা মুড়ি বের করল। সংগে কাঁচা পেঁয়াজ। পেট পুরে মুড়ি খেয়ে দুহাতে করে পুকুর থেকে জল তুলে খেলুম। শম্ভু ঢেঁকুর তুলে বল্লে ” অখঁ অনেক রাস্তা, চ, উঠ”

আবার হাঁটা। এখন যেখানে বাস স্ট্যাণ্ড, মোরাম ঢালাই চাতালে লোকেরা দোকান নিয়ে বসে, ডাবওয়ালারা হাঁকায় ” কচি ডাব, খায়া পইসা দুবো” বলে, সেটা সেকালে নোনা ধুলোয় ভর্তি একটা চাতাল ছিল। গ্রামের বুড়িরা এসে নুনবাড়ি দিত। চৌকো খুলে ধুলো এনে ভর্তি করতো। তারপর নোনা জল এনে ঢেলে দিত, ধুলো ভেদ করে বিষের মতো নোনা, হালকা হলুদ রং এর জল চুঁইয়ে পড়তো সেই চৌকোর পাশে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা অপেক্ষাকৃত ছোট একটা চৌকোয়। শীতের শুরু থেকে শেষ অব্দি যখনই দেখো, একদল বুড়ি ঝিনুক নিয়ে ধুলো তুলতে ব্যস্ত। সেই চাতাল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ছোট ছোট বানি গাছের পাতলা জংগল। তার ভিতরে জোয়ারের সময় মহিলারা সুতলি ফেলতো কাঁকড়া ধরার জন্য, কেউ কেউ জলের মুখে গজিয়ে থাকা কচি ছনছনে সবুজ গিরা শাক তুলতো। একটা বাজার ছিল, কিন্তু  বাজার বল্লে লোকের মধ্যে যে অভিজাত ধারণার জন্ম হয়, সেটা তেমন কিছু ছিল না। তাও এ অঞ্চলের সেরা বাজার ছিল সেটাই। কাপড় দোকান,  চা দোকান,  মায় সোনার দোকানও ছিল একটা। দোকানগুলো সবই মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি। এখনকার মতো অত নিরাপদ ছিল না। তাই দোকান চুরি হওয়ার থ্রিলিং গল্প শুনতে পাওয়া যেত মাঝে মধ্যে।

চাতাল ছাড়িয়ে চলে এসেছি অনেকটা। এখানে রাস্তার ডান দিকে একটা মাটির দেওয়াল দোচালা ঘর। একটা চায়ের দোকান। সামনের পাতা চটের উপর একটা গামছা পরা লোক বসে পেল্লাই হাতে বাঁধা বিড়ি টানছিল। দোকানে একজন বয়স্কা মহিলা পান সাজাচ্ছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলুম ” কাকা, গপা’ নগর যাবো, কুন রাস্তা?”

লোকটা বিড়িতে একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বল্লে ” গপা’ নগর? কুনঠি? ”

সাঁতরাবাজার।

অহ। সজা অউ রাস্তা।

তেষ্টা পাচ্ছিল। দোকানদার মহিলাকে বল্লুম ” একটু জ’ খাবো?”

সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। চটের উপর থাকা মগ নিয়ে আমি শম্ভু দু’জন জল খেলু। শম্ভু জল খেয়ে হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বল্লে ” ক’এর জ’ স্বাদ লাগচে”

সাঁতরার বাজারে যখন পৌঁছালুম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাজারের দোকানপাট সব বন্ধ। খোলা থাকলেও আমাদের কোনো কাজ নেই। শুধু কেষ্ট দাসের ঘর জানাটা জরুরি। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলুম কেউ কোথাও নেই। বাজার ছাড়িয়ে চলে এসেছি। এখানে ঘরও খুব বেশি নেই। এখানে একটা তো, মাইল কি আধ মাইল দূরে আর একটা। খুব ফাঁপরে পড়ে গেলাম। একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করা যায়, হঠাৎ দেখলুম পিছন থেকে আমরা যে পথ ধরে এসেছি সেই পথেই একজন লোক মাথায় বিরাট এক কাপড়ের পেটি বয়ে নিয়ে আসছে। ঠিক বাবলা গাছটার কাছে এসেছে আমি তড়িঘড়ি বল্লেম ” কাকা, কেষ্ট দাসের ঘর কুনটা জাঁও?”

লোকটা মন্ত্রের মতো থমকে দাঁড়ালো। ইশারায় মোট নামাতে বল্লে। হাতে হাতে ধরে আমি আর শম্ভু নামালুম।

কেষ্ট দাসের ঘর খুঁজট?

হঁ কাকা।

কে হয়?

একটু আমতা আমতা করছি কী বলবো, সহসা শম্ভু বল্লে ” আমার বৌ সৌটি রয়”

লোকটার চোখমুখে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন খেলে গেল। বল্লে,

বৌ?

“হঁ কাকা ” শম্ভু উত্তর দেয়।

নাম কী বৌর?

গৌরি।

লোকটার চোখমুখ কেমন কঠোর হয়ে গেল।

কীর্কম বৌ?

আমি ব্যা করতিলি। তারপর গৌরিকে তার মা বাপ এঠি তার মামুর দরে পাঠি দিছে। আমার সংগে মিশতে দিবেনি বলিয়া।

অহ।

লোকটা কী যেন একটু ভাবল, তার পর ঠোঁট ফাঁক করে মাপা হাসি হেসে বল্লে “কেষ্ট দাস এখাঁয়ে আর রয়নি।”

রয়নি! কাই রয়?

না রয়, কিন্তু এখঁ নেই। এখঁ কাকদ্বীপে আছে। সেটি কুটুম দরে যাইছে।

কাকদ্বীপ? কাকদ্বীপ কুন্ঠি?

কাকদ্বীপ অনেক দূরে।

শম্ভু দমে গেল। সে ধপাস করে বসে পড়ল রাস্তার উপর। আমি কিছু বলবার মতো না পেয়ে চুপ করে রইলুম।

কী আর করবু কচি, পরে একদিন আসবু।

শম্ভু চুপ করে আছে। তারপর সহসা উঠে পড়ে বল্লে,  তাও কুন ঘরটা একবার কও।

আর একটু যাইতে হবে। এক কাজ কর কচি, আমি ঘরে যায়া কাপড়ের পেটিটা রাখিয়াইসি। সকানু খাইনি, পাথরের বাজারে যাইতলি দকান লিয়া। তোন্নে বুস, আমি ঘরে যাব আর আইসবো। তোনকে কেষ্ট দাসের দরে লিয়াবো।

শম্ভুর চোখ মুখ চকচক করে উঠল। সে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে আবার বাবলা গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। আমি লোকটার মাথায় কাপড়ের পেটি তুলে দিলুম। লোকটা চলে গেল।

শম্ভু আমার দিকে তাকাল। তারপর ব্যাগ থেকে গামছায় বাঁধা বাকি মুড়িটা আমাকে দিয়ে বল্লে ” খাবু?”

না।

কেনি?

ভাল্লাগেনি।

আমার উপরে রাগ করচু?

কেনি?

আমার জন্যে তোর কষ্ট হ’টে।

ধুর শ্লা।

শম্ভু কিছু বল্লে না আর। ব্যাগ থেকে সযতনে বের করে আনে মূল্যবান কোহিনূর।  এক গাছা চুড়ি। হাতে নিয়ে পরম মমতাভরে নেড়েচেড়ে দেখে। নিজের হাতের কালো চামড়ার উপর রেখে বলে,

ধুর শ্লা।

কী হইল রে?

এগা শুধু গৌরির ছাড়া কারুর হাতে মানিবেনি। কী কউ?

কী বলতে হয় এক্ষেত্রে জানি না আমি। তবুও মাথা নেড়ে বল্লুম “হঁ”

হঠাৎ সূর্যের উপর একটা সাদা মেঘের আস্তরণ চলে এল। গোটা বিশ্ব চরাচর যেন ছায়ায় ঢেকে গেল। দুটো লোক সাইকেল চালিয়ে এল। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে একজন বল্ল ” কেষ্ট দাসের ঘর কে খুঁজতল রে?”

আমান্নে।

একটা একমনি থাপ্পড় এসে পড়ল আমার গালে। আমি ঝটকা সামলাতে না পেরে ছিটকে মাটিতে পড়লুম। অন্য লোকটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই শম্ভু গর্জন করে উঠল ” অই খানকির পো, তুই অপুকে মারলু!” বলেই ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর। লোক দুটো নৃশংস রক্তখেকো হায়নার মতো শম্ভুকে মাটিতে ফেলে দিল। ইচ্ছেমতো কিল চড় লাথি ঘুসি মারতে লাগল। আমি উঠে দৌড়ে গিয়ে শম্ভুর উপর শুয়ে পড়লুম। আমার নাকে এসে একটা লাথি পড়ল। গলগল করে নাক থেকে রক্ত পড়তে লাগল। রক্ত দেখেই হোক আর যে কারণেই হোক, লোক দুটো আমাদের ছেড়ে দিল। ” যা শ্লা, বেধুয়া বাচ্চা। আইজ ছাড়িয়া দিলি। ভাগ!” নাইলনের ব্যাগটা পড়েছিল। একটা লোক তার ভিতরে হাত ভ’রে গোটা চারের পাঁচ টাকার নোট ছিল তা হস্তগত করে পাশের ঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে দিল ব্যাগটা। অন্য লোকটা, ছড়ানো ছিটানো কাচের চুড়িগুলো তার জুতো পরা পা দিয়ে ভেঙে কুচি কুচি করে দিল। শম্ভুকে একটা সজোরে লাথি মেরে একটা বিশ্রী গালাগাল দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ল।

মুহুর্তে কী সব হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলুম না। শম্ভু উঠে বসল। “অই শ্লা আগের লোকটা যায়া…” কথা শেষ করার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে শম্ভু। আমি বল্লুম

শম্ভু।

আমার দিকে তাকাল সে। তারপর চুচ্চুড়ি গাছের ডাল ভেঙে এনে আঠা লাগিয়ে দিল আমার নাকে। আমাকে বুকে টেনে নিল। একটা গরম নিশ্বাস ছেড়ে বল্ল ” তোর খুব লাগচে না, অপু?”

আমি কিছু বল্লুম না। শম্ভুর জামার ছেঁড়া জায়গায় পা ঢুকিয়ে ছিঁড়ে এক পাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে লোকগুলো। তার কপাল, ঠোঁট, পায়ের গোড়ালি স্পষ্ট ইংগিত দিচ্ছে লাথি ঘুসির চিহ্ন।

শম্ভু

উঁ

কাই?

ঘরে

গৌরির সংগে দেখা করবনি?

না

কেনি?

পারবুনি।

শম্ভু চুপ করে গেল।

তোর ভালোবাসা সত্যি হইলে গৌরিকে কউ আটকিয়া রাখতে পারবেনি।

শম্ভুর মুখে রা নেই। সে নীচু হয়ে ভাঙা চুড়ির টুকরো গুড়োচ্ছে। একেকটা টুকরো গুড়িয়ে প্যান্টের পকেটে রাখছে।

অপু

হঁ

তোর কাছে পইসা আছে?

হঁ, একটা আধূলি আছে।

চ’

ঝোপের মধ্য থেকে মুড়ি সহ গামছাটা পেলুম। পুকুরে নেমে কোমর অব্দি ভিজিয়ে নিলুম। চোখে মুখে জল দিলুম ও পেট ভরে জল খেলুম। এখন ফেরার পালা।

খেয়া ঘাটে যখন পৌঁছালুম সন্ধে হয়ে এসেছে। পশ্চিমে নদীর বাঁকে জল লাল হয়ে উঠেছে। পুব দিকের জংগলের গায়ে একটা লোক জলের মুখে দাঁড়িয়ে জাল দিচ্ছে। একটু দূরে একটা কুমীর ভেসে উঠল ভুস করে। পুবের জল হয়তো লাল হয়ে উঠবে এক্ষুণি।

ক্রমশঃ

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন–

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৭তম পর্ব)”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *