দু র্গা প দ চ ট্টো পা ধ্যা য়-র প্রবন্ধ
কবিতা কি , কবিতা কেন
আমাদের শাস্ত্রে শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয় । ব্রহ্ম হল মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণাকে বোঝায়। এর অর্থ হল সৃষ্টির বস্তুগত, গুণগত, প্রামাণ্য ও অন্তিম কারণ। ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, এবং চিরসত্য ও পরমানন্দ – যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ ।
যেমন চিত্রকলার কথা ধরা যাক । পোর্ট্রেইট , পোর্ট্রেচার । যেখানে ফেসকো , ম্যুরাল , অ্যবস্ট্রাক্ট , ল্যাণ্ডস্কেপ যাই আঁকিনা কেন রঙের দরকার লাগে । টেম্পেরা ,গুয়াশ , চারকোল , ক্রেয়ন , প্যাস্টেল । কিন্তু আমারা ভেবে দেখিনি ছবির শৈল্পিকতার সাথে রঙের বস্তুগত সম্পর্ক কোথায় । একটি ছবি যে অর্থে ধ্বনিমাতৃক , ছান্দসিক ও আলংকারিক – সেখানে ব্যক্তি রঙের প্রাসঙ্গিকতা কোথায় থাকে । শূন্য । যেমন এক গ্লাস জল আধা গ্লাস এমন কি সিকি গ্লাস হলেও যে পূর্ণ থাকবে – এটা মানুষের ভাবনা । রঙের নয় ।
তাহলে ছবির জন্য রঙের প্রয়োজন কোথায় । আছে । এর উত্তর আছে শরৎচন্দ্রের দেবদাস গল্পের নায়িকা পার্বতী ( পারুর ) কপালে । ঠিক রঙের ভূমিকাও তেমনই । রেলের তৎকাল টিকেটের মতো একটি চটজলদি দাগ । যেখানে খণ্ডকাল মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নিরবধির প্রতীক্ষায় । আর সেই মাইস্টোন গুনতে গুনতে কালীকান্ত মাস্টারের হাত ধরে বিদ্যাসাগর পৌঁছে যাবেন কলকাতায় ।
অর্থাৎ রঙ-তুলি , কালি-কলম , ছেনি-হাতুড়ি কেউ স্থপতি বা স্থাপক নয় , নির্ণয় ও তার মীমাংসাকে স্থিরীকরণ করার এক মাধ্যম মাত্র । পটুয়ার রঙ , লেখকের কালিকলম , ভাষ্করের ছেনি হাতুড়ির অবস্থান হল চিনির বলদের মতো – বয় কিন্তু খায় না। তাই
শিল্পের কোন অঙ্ক নেই , যে যতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সে ততোই শিল্পীর সমীপবর্তী । শিল্পের অবস্থান হল ত্রিকোণ প্রেমের মতো । একদিকে ব্রহ্ম ( Brahma ) অপরদিকে বাগ্ময়তা ( eloquence ) মধ্যিখানে ‘ হোয়াট টু ডু ‘ মানুষ ।
এই যে দর্শন (Darshana) শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হিসেবে Philosophy শব্দটি ব্যবহার করা হয় । অথবা এই যে লজিক ( logic ) যাকে আমারা যুক্তিবিজ্ঞান বলি । ম্যাথম্যাটিক্যাল লজিক ( mathematical logic)
বুলিয়ান লজিক (Boolean logic) এই সবকিছুই আশ্রয়স্থল হল ব্রহ্ম । এই ব্রহ্ম হল আমাদের কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানের ঠিকাদার । ব্রহ্মের অবস্থান অনেকটা রামপ্রসাদের গানের মতো – ‘ তোমার কর্ম তুমি কর মা লোকে বলে করি আমি ‘ । এক গাছ যেমন ক্লোরোফিল বা পত্রহরিৎ তড়িৎচুম্বকীয় ভাধ্যমে সূর্যের আলো থেকে আলোকশক্তি শোষণ করে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করে, যার সাহায্যে উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে ও যাকে আমারা ক্লোরোফিল (Chlorophyll ) বলি । ব্রহ্ম অনেকটা সেভাবেই আমাদের ভালমন্দের যোগান দেয় ।
ক্রমে এইভাবেই তাৎপর্যের আনুকূল্যে একটি অন্তর্ব্যাপ্ত শব্দব্রহ্মের সৃষ্টি হয় , কার্যত যাকে আমারা ‘ বাক ‘ বলি।
বাক হল তরঙ্গের প্রাপ্তি ও স্পন্দনের অস্তিত্ব ।
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা বলছেন শিব হলেন এই মহাজাগতিক তরঙ্গের ( Cosmic waves )আদি শ্রষ্টা । শিব ও পার্বতীর যথাক্রমে তাণ্ডব ও নদন্তের পরিণতি হিসেবে ‘ ওম ‘ কম্পন উৎসারিত হয় ব্রহ্মাণ্ডে।
শিবের সৃষ্টি , স্থিতি , সংহার , তিরোভাব ও অনুগ্রহ এই পঞ্চক্রিয়ায় অভিব্যক্তি , একাধারে ধ্বংস ও সৃষ্টির পরিচায়ক – এর অনেক উত্তর আছে নটরাজরূপী শিবের দুই অভিব্যক্ত কর্ণভূষণে । দুই কর্ণে দুইরূপ অলংকার । দক্ষিণকর্ণে পুরুষ দেহের ও বামকর্ণে নারীদেহের ভূষণ । ” Art historian ” হ্যাভেল এই দ্বিভাষীক রূপকে এই বলে বর্ণনা করেছে – ” By which is expressed by nature of the Diety , combining both the male and female principle.”
এই তাণ্ডব ও লাস্যের যৌথ সমন্বয়ে মহাজাগতিক স্পন্দনের সৃষ্টি হয়েছিল । সম্ভবত পদার্থ বিজ্ঞানীরা একেই God particle বা ঈশ্বর কণা বলেছেন ।
বিজ্ঞানীদের ভাষায় ব্রহ্মাণ্ডের আদি হিগস্ বোসন কণা ।
যদিও ইদানিং বিজ্ঞানীরা যে ঈশ্বর কণার কথা বলছেন , সেকথা খ্রিস্ট জন্মের বহু আগে ভারতীয় ঋষিরা লিপিবদ্ধ করেছেন ঋগ্বেদের ১০ মণ্ডলের ১২৯ সংখ্যক সূক্তে । যেখানে বলা হয়েছে –
” নাসোদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ । কিমাবরীবঃ । কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্যম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্ ।। ন মুত্যুরাসীদমৃতং ন তার্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ । আনীদবাতং সধয়া তদেকং তস্মাদ্ধানান্ন পরা কিং চনাস ।। ”
যার অর্থ হল – এটা এমন এক সময় , যখন যা নেই তাও ছিলনা , যা আছে তাও ছিলনা । পৃথিবীও ছিলনা , অতি দূরবিস্তারী আকাশও ছিলনা । আবরণ করে এমন কি ছিল ? কোথায় কার স্থান ছিল ? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল ? তখন মৃত্যুও ছিলনা , জীবনও ছিলনা । রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিলনা । কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সহযোগিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিল । তিনি ব্যতিত আর কিছুই ছিলনা ।
এই অজ্ঞেয় , অপরিজ্ঞেয় , জ্ঞানাতীত ও অনধিগম্য শূন্য থেকে এক শব্দজগতের সৃষ্টি হল । এই শব্দের তাৎপর্যই হল ব্রহ্ম । ব্রহ্ম এক অপ্রসিদ্ধি সংজ্ঞা -একে ছোঁয়া যায় কিন্তু ধরা যায়না । সপ্তশতী শ্লোকাত্মক চণ্ডীতে বিশ্বের আদি মাতা এক স্থানে আপন অস্তিত্ব ব্যক্ত করেছেন , তিনি বলেছেন –
” অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা ।
একৈ বাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা ।। ”
যার অর্থ হল , বিশ্বে তুমি বলে কিছু নেই । তুমি আছ বা ছিলে এমনও নয় । সব কিছু আমার অস্তিত্ব। আমার ঐশ্বর্য ও প্রতিয়মানতা থেকে বহুবিধ তুমি-র জন্ম হয় । সুতরাং আমিই সৃষ্টি ও স্রষ্টা , আমিই বাজিকর আবার আমিই পুতুল নাচের পুতুল ।
। আজ বিজ্ঞানীরা যাকে বলছেন , অব্যক্ত ও আদিক্ষেত্র – প্রটোপ্লাজন ( Protoplasm ) সৃষ্টিবীজ – অথবা God particle নামে বিভূষিত করা হচ্ছে নটরাজ শিব হলেন সেই ” pre-space ” এর আদিরূপ । তাঁর তাণ্ডব বা নদন্ত হল মহাজাগতিক বিষ্ফোরণ (Cosmic explosion ) । সেই মহাজাগতিক ধ্বংস থেকেই সৃষ্টির উন্মেষ ঘটেছিল পরমাপ্রকৃতির ” লাস্য ” নৃত্যে । অর্থাৎ নৃত্যের হাত ধরেই সৃষ্টির জন্ম হয়েছিল । ধ্বংসেরও । নৃত্য হল ধ্বংস ও সৃষ্টির মহাজাগতি স্পন্দন । সেই অতীন্দ্রিয় স্পন্দনের আদি অস্তিত্ব হল – ওম । এই আদ্যবীজ থেকেই জন্ম , মৃত্যু , ও ক্রমে ভাষা এবং শব্দের প্রকরণসমুহের সৃষ্টি হয়েছিল ।
শব্দব্রহ্ম প্রসঙ্গে আচার্য ভর্তৃহরি লিখেছেন –
” একমেব যদাম্নাতং ভিন্নং শক্তিব্যপাশ্রয়াৎ।
অপৃথকত্বেঅপি শক্তিভ্যঃ পৃথকত্বেনেব বর্ত্ততে।।” (বাক্যপদীয় ১/২) । যার অর্থহল , শব্দব্রহ্ম শ্রুতিসমূহে একইরূপে কীর্তিত হয়েছে , সেই ব্রহ্মই ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আশ্রয় হওয়ায় , শক্তিসমূহ থেকে বস্তুতঃ অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পৃথক বা ভিন্নরূপে ভাসমান হয়। শক্তিসমূহ পরস্পর ভিন্ন হওয়ায় তার আধার যে শব্দব্রহ্ম , তিনিও ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হন। যদিও তিনি ভেদরহিত ।
এই শব্দ সহযোগে একটি কবিতা গড়ে ওঠে । কবিরা কবিতা লেখেন । শব্দ হল কবিতার পরিণাম কিন্তু পরিণতি নয় । কারণ পরিনামবাদ অনুসারে পরিনামীর কখনও মূল অবতরণিকায় ফিরে আসেনা । যেমন দুধের রূপান্তর দই হলেও দইকে কখনও দুধে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর নয় । কিন্তু পরিণামের রূপান্তর হলেও পরিণতি আবারও মূল অব্যয়ে ফিরে আসে । যেমন বুদবুদ – বুদবুদ হল জলের রূপান্তরিত পরিণাম কিন্তু বুদবুদ আবার জলেই রূপান্তরিত হয় ।
সুতরাং কবিতা লেখা যেতেই পারে কিন্তু কবিতা হল ৪৪০ ভোল্টেজে চুল শুকানোর মতো ব্যাপার । অসতর্ক তো বটেই এমনকি সতর্ক সত্ত্বেও ল্যাং খাবার আশঙ্কা থাকবে । কারণ শব্দ-ব্রহ্ম ।
কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত । সে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রদীপের গল্পের মতো । একই প্রদীপের আলোর একজন গীতা পাঠ করছে , একজন দলিল জাল করছে । কিন্তু প্রদীপ নির্বিকার । কবিতা বা অকবিতা যা কিছু লেখার আগে একথা আমাদের ভাবতে হবে ।