গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–হেঁতালপারের উপাখ্যান(সপ্তম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র সপ্তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(সপ্তম পর্ব)

 

অপু, দাদা ও মা

“We will draw the curtain and show you the picture.” The Twelfth Night, Shakespeare.

আর একটু বড় হয়ে জেনেছিলুম নদী মানে এক জলধারা, যা পাহাড়, পর্ব্বত বা মালভূমি থেকে নেমে আসে সমতলে,তারপর তা প্রবাহিত হয়ে সাগরে পড়ে। সেই অর্থে আমাদের সুন্দরবনের নদীগুলো নদীই নয়, এক প্রকার খাঁড়ি। সাগরের খাঁড়ি। আমি সত্যি কথা বলতে একটু ধাক্কা খেয়েছিলুম। কারণ, সেই সময়ের মধ্যেই আমাদের ওই নামহীন নদীটা আমাদের প্রাণপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আমি খাঁড়ি বলতে রাজি ছিলুম না একদমই। মা বলেছিল, ” ধুর! জলের ধারার কি কুনো নাম হয় রে! আমানকের এটাও নদী। ওসব গংগা, যমুনা বড়লোকেদের নদী, আর আমানকের এটা, এতো এক্কেবারে আমানকের। ” আমি কী বুঝেছিলুম জানি না, নদীটার প্রতি মায়া আরো বেড়ে গেছিল। নদীকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলুম। এপারে লবনাম্বু গাছেদের ভীড়, ওপারে ঘন অরণ্য। মাঝখানে জোয়ার ভাঁটা খেলছে। একটা দুটো নয়, কত কত নৌকা আসে যায়। দাঁড় বায়, হাল ধরে। বড় বড় ট্রলার যায়, মাছ ধরে ফিরে আসে, কেউ বা আসেই না আর। কেউ কাঠ কাটতে যায়, কেউ মধু ভাঙতে, কেউ কাঁকড়া ধরতে, কেউ চুনো মাছ ধরতে। কেউ জাল পেতে রাখে, জোয়ার ভাঁটার মাঝখানে তা ঝেড়ে আনে। কত নৌকা! কত জাল! হিসেব করে পারা যায় না। মাছ নিয়ে ডাঙায় এলে হৈ হৈ রব। মাছ বাছার হিড়িক। মাছ বেছে দিলে মাছ পাওয়া যায়। মা গিয়ে মাছ বাছতো। মাছ নিয়ে আসতো। কত নতুন নতুন মাছ খাওয়া শুরু হোল, তার ইয়ত্তা নেই। মাছের সাবাড় ছিল দুটো। একটা সাউদের আর একটা ক্ষেত্র বাঙালদের। বেন্তি জাল মাঝ নদীতে পাতা থাকতো। জাল ভাসিয়ে রাখার জন্য বড় বড় পিঁপে, কাঠের তৈরী পিঁপে জালের সংগে আটকে ভাসিয়ে রাখা হতো সারাক্ষণ। তার পর ভরনা হলে জাল ঝাড়া হতো। জোয়ার আর ভাঁটার মাঝখানে নদী যখন একেবারে থমথমে হয়ে যায়, যখন কোনোদিকেই প্রায় স্রোত থাকে না সেই সময়কে ‘ভরনা’ বলে। ভরনায় জাল ঝেড়ে তীরে আনা হলে লোক জুটে যেত। মাছ বাছার লোক। দীর্ণ শীর্ণ হাড়হাভাতের দল যেন। আমি আর দাদাও থাকতুম অনেক সময়। মাছ বেছে দিতুম। ভোলা, তোপসে,ফ্যাসা, খয়রা, বোমলা,লাল চিংড়ি আমেদি কত কী মাছ! আমরা পেতুম মাছ বাছার পারিশ্রমিক হরজয় মাছ। ‘হরজয়’ কোনো মাছের নাম নয়। বাদ দিয়ে দেওয়া, পড়তি মাছগুলোকে একসংগে ওই নামে ডাকা হতো। আমরা তাই নিয়ে বাড়ী ফিরতুম। তার ভিতর থেকে আবার বেছে নিতুম ছোট ছোট ফ্যাসা, আমেদি আর চিংড়ি। তাই খেয়েই আমাদের আনন্দের পরিসীমা ছিল না। প্রায় প্রত্যেকদিন মাছ খাচ্ছি, একি কম কথা! মা ঠিক ১০ বা ২০ গ্রাম তেলে দু তিনদিন চালিয়ে দিত। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে মা যাই রাধঁতো তাই সুন্দর হতো।
ভাঁটা হয়ে গেলে লোহার শিক নিয়ে অনেকে এপারের চড়ায় কাঁকড়া ধরতে যেত। এর ওর দেখাদেখি মাও যেত। আমিও যেতে শুরু করলাম। চড়া মানে ফাঁকা চড়া নয়। আগেই বলেছি লবনাম্বু গাছের জংগল। শ্বাসমূল, ঠেসমূলের ভীড়। তার মাঝখানে একটু একটু জল জমে থাকে। সেই জলে চিংড়ি, তাউরি ইত্যাদি মাছ থাকতো। সেগুলো গুড়ি জাল নিয়ে ধরা হতো। আমার মাও ধরে আনতো সেসব মাঝে মাঝে। আর এর আশেপাশেই অজস্র কাঁকড়ার গর্ত। শিক ঢুকিয়ে কায়দা করে কাঁকড়া বের করতে হয়। সে কৌশল রপ্ত করা সময়সাপেক্ষ নয়। গংগা ঘোড়ুই এই কৌশলটা বোধ হয় সব চাইতে ভাল রপ্ত করেছিল। শিক নিয়ে বের হয়ে গেলেই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সে অন্তত দু’কুড়ি কাঁকড়া ধরে আনতো।
এই চড়াটাই একসময় আমাদের রত্নখনি হয়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। মাছ কাঁকড়া তো আছেই। তার সংগে মাছি মৌএর চাক থেকে মধু খেতে পারতাম ইচ্ছেমতো। মাছি মৌ এক প্রকার মৌমাছি। আকারে ঘরে দোরে যে মাছি দেখা যায়, কিছুটা তার মতো। এরা হুল মারলে হালকা একটু যন্ত্রণা বা যন্ত্রণা প্রায় হয় না বললেই চলে। চাক থেকে এদের তাড়ানো সহজ। আমরা ছোটরা মাছি মৌএর চাক দেখলেই গগন তুলসী গাছের ডাল ভেঙে আনতুম। কী বিশ্রী গন্ধ তার! তাকে আমরা ‘বদাতুলসী’ বলতাম। তো সেই ডাল পাতাসমেত এনে চাকের উপর রাখলেই কেল্লাফতে। মৌমাছি গুলো চাক ছেড়ে দিত। আর আমরা চাকের কাঁদা ভেঙে হাত দিয়ে মধু ধরে খেতুম। সে ভীষণ এক আনন্দের ব্যাপার।
জংগলের গাছে গাছে তখন কতরকম পাখির বাসা। টিয়া, শালিখ, বনকাক, বক, বুনোহাঁস, আরো কত কিছু নাম না জানা পাখি। পাড়ার শ্রীকান্তদা আর শংকরদার সংগে মাঝে মধ্যে জংগলে গিয়ে পাখির বাচ্চা পেড়ে আনতুম। ক’দিন পোষ মানাবার চেষ্টা করতুম, তারপর মনে হয় অতিযত্নে মারা যেত। বুনোহাঁসের ডিম পেড়ে আনতুম।ভেজে খেতুম। ঠিক দেশি মুরগীর ডিমের মতো খেতে। আমার ডিম খেতে খুব ইচ্ছে করতো। মা মুরগী পুষতো। কিন্তু তার ডিম বেশিরভাগ সময় আমি আর দাদা বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে আসতাম। কেন না, তা থেকে চাল, মশলা,তেল কেনা হোত।
যা বলছিলাম। আমাদের নদীটাকে আমি কখনো হাত পা মাথা উরু জংঘা সমেত দেখিনি। আমার চোখের সামনে যতটুকু ছিল ততটুকুই ছিল আমার প্রিয় নদী। তার হাত কোথায়, পা কোনটা, আঙ্গুলের মতো কোনো শাখা খাঁড়ি কোথাও ঢুকেছে কিনা, যুবতী নাভীর মতো কোনো চকচকে জল কোথাও গুছিয়ে রেখেছে কিনা সযত্নে সেসব কিছুই জানতাম না। আমার নদী মানে তখন অগাধ জল, দুপারে ম্যানগ্রোভের ভীড় আর বর্ষায় মাতাল ঢেউ এবং শীতের লাজুক কুমারী যার বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুশুকের দল। নদী তখন হয়ে উঠেছে একটা আস্ত পৃথিবী। আমার মা আর গুড়ি জাল দিয়ে বাগদার পোনা ধরতো না। তখন টানা জাল। একবার টেনে এনে ঝাড়তে হতো। বাগদার পোনা, চিংড়িমাছ, চুনো মাছ আরো কত কিছু উঠে আসতো। মাঝে মধ্যে দু একটা নোনা বড়া সাপও উঠতো। তখন সাপখোপ দেখে আর অত ভয় করতো না। বরং সাপ খোপ দেখলে লাঠি নিয়ে তাড়া করতুম, মারতুম, খেলা দেখাতুম। একবার আমি মীন জাল টানছি। ওপার থেকে ভাঁটার সময় হলহল করে জলের ওপর দিয়ে একটা সাপ আসছে। তখন সার ভাঁটা। এপারে উঠতেই দেখি একটা কেউটে সাপ। তখন সাপ চিনতেও শিখে গেছি বেশ ভালো। যাই হোক, সে সাপ এপারে উঠতেই গংগা পেশাকে ডাক দিলুম। সে পাশেই জাল টানছিল। ” ও পেশা আ আ আ আ আ…. দ্যাখো, কেউটিয়া সাপ ওপাশনু আইসিয়া উঠছে। আইস’, আইস’ …” ব্যাস, গংগা পেশা এসে সেটা একটা লাঠি দিয়ে কৌশল করে ধরে কতরকম মসকরা দেখালো। শেষে মেরে ফেল্লো। সাপ মেরে পুড়িয়ে দেওয়া নিয়ম। বিড়ির কৌটা থেকে দেশলাই বের করে জংগলের শুকনো পাতা জড়ো করে পুড়িয়ে দেওয়া হলো সাপ। আগুনের আঁচ থেকে ধোঁয়া উঠতো। আমরা বলতুম ” ওই দ্যাখ, সাপের বিষ উঠেটে”।
চড়ায় তারামাছ, জেলিমাছ নিয়ে খেলতুম। কারেন্টমাছ গায়ে জড়ালে অদ্ভুত এক শিহরণ হতো। আমরা বলতুম, ” কারেন লাগছে গায়”। তখন অবশ্য সত্যিকারে কারেন্ট বা ইলেক্ট্রিসিটি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তখন আলো বলতে ল্যাম্পের আলো আর পুজা পাব্বনে হ্যাজাক লাইট ছাড়া আর কিছু জানতুম না।
নদীর ধারেই একটা বনবিবির মন্দির ছিল। মাটির ঘর, টালির ছাউনি। ওটা সাউদের। যাদের মাছের কারবার আর সাবাড় ছিল। বোশেখ মাসে পুজা হতো। রাত্রে কত কত হ্যাজাক লাইট আনা হতো। আর ‘দুখুু মিঞা’ যাত্রা হতো। বসিরহাট থেকে যাত্রা দল আসতো। আমি বসিরহাট মানে তখন বুঝতুম অনেক দূরের কোনো একটা জায়গা, সেখানে যে কেউ ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না। বনবিবির উপাখ্যান আমরা ছোট থেকে জেনে গেছিলাম। যাত্রা দেখে যে কদিন পর ভুলে যাবো, তার তো জো নেই। মন্দিরের মাটির দেওয়ালে বনবিবি, শাহাজংগিলা, দুখু মিঞা, তার দুখিনী মা, দক্ষিণ রায়, সবার নাটকীয় ছবি আঁকা ছিল। সেসব দেখে দেখে আমাদের বনবিবির উপাখ্যান মুখস্থ হয়ে গেছিল।
এই বনবিবি মন্দিরের পাশ দিয়ে আমাদের নদীটা যে কত দূর চলে গেছিল উত্তুরে, আমি অনেক পরে জেনেছিলুম। আর সেই নদীর পথ ধরে আমি একসময় পৌঁছে গেছিলুম অন্য এক শৈশবে। সেই শৈশব থেকে পিছটান মেরে আবার মোহনায়।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(ষষ্ঠ পর্ব)”

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *