প ল্ল ব ব র ন পা ল-র কবিতাগুচ্ছ
অমুক আর তমুকের মাঝখানে
ভারতবর্ষ আর মাতৃস্তন্য
মৃত মায়ের মৃত স্তনে মুখ ঠেকিয়ে আছে যে এখনো জ্যান্ত শিশু
অতিমারী কি তা সে জানে না
সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে কিছু শোনেনি সে
নাগরিকপঞ্জী এমপিআর রামমন্দির – না
এমনকি নিজের দেশকেও সে চেনে না
কিন্তু সাচ্চা দেশপ্রেমিকের মতো
সে চেনে তার সত্যিকারের দেশ
মা-কে
জানে মাতৃস্তন্যের ভালোনাম মন্দিরচূড়ো
আর ঐ স্তনবৃন্তেই লেখা আছে
তার খিদেমুক্তির সপ্তকাণ্ড রামায়ণ
সেই মৃত মায়ের মৃত স্তন
আর জ্যান্ত শিশুর জ্যান্ত ঠোঁটের
মাঝখানে
বিরক্তিকর কয়েকটা ডাঁশ মাছি
ভক্তি-ভনভন ভুল সুরে এখন
দেশপ্রেমের কেত্তন গাইছে
–
ঝড় আর বৃষ্টি
ঝড় আর বৃষ্টির মাঝখান দিয়ে
সেতারে আঙুল-টানে যেমন মিড়
অবসন্ন পা তেমনি টেনে টেনে
আরোহে খিদে রাগের ঋষভ ছুঁয়ে থাকে
ঝড় আর বৃষ্টির মাঝখান দিয়ে
ডাস্টবিন থেকে রাস্তায় উঠে আসে
ক্লান্ত-ক্লিষ্ট ক্রুশবাহী যিশুর হাত ধরে
ভাঙা বোতল তোশকছেঁড়া মেঘতুলো ছাইপাঁশ
ঝড় ছুঁড়ছে মারণ অবজ্ঞাধুলো
আর বৃষ্টি ছেটাচ্ছে রাসায়নিক বিষ
যেন একদিক থেকে জয়ের উল্লাস
আর অন্যদিকে ছেঁড়া ফুলপাপড়ির চরণামৃত
ঝড় আর বৃষ্টির মাঝখান দিয়ে
কাঁধে কঙ্কালসার মা, আর
পোয়াতি বউয়ের হাত ধরে
এক আকালের থেকে অন্য আকালে
টলতে টলতে হেঁটে যাচ্ছে
চোরাভাঙা এবড়োখেবড়ো খানাখন্দী
একশো তিরিশ কোটি চওড়া রাস্তা —
চৌমাথার নকশা ফলকে লেখা
ভারতবর্ষ
তেলেঙ্গানা আর ছত্তিশগড়
জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে
পেটের মধ্যে মুখ গুঁজে
ফুটপাথে ঝিমোতে ঝিমোতে
লেজের সিসি ক্যামেরায়
পিচুটিক্লান্তিতে অন্ধকার দেখা চোখ
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ির রাস্তা খুঁজছিলো
একটা আটবছরের গণগণে দুপুর
রাষ্ট্রের কাঁসরঘন্টায়
বিসর্জন বাজাতে বাজাতে
তেলেঙ্গানা থেকে ছত্তিশগড়
প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার লম্বা
রবার্তো কার্লোসের ফ্রিকিক
নেমে এলো অবসন্ন পিঠে
উড়ে যাবার আগে
চামড়া ঢাকা হাড়গোড় সহ
আস্ত শরীর থেকে
বিচ্ছিন্ন হলো সিসিক্যামেরা
আগুন রাস্তার ওপর
ছিটকে এসে পড়লো
জামলো মকদমের চোখ
আর মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে
তার ফেলে আসা শৈশব আর
আব্বু-আম্মা-দাদা-দাদি–
চোখ পাথর হয়ে গেলেও
দৃষ্টি
রবার্তো কার্লোসের ফ্রিকিকের মতো
উড়ে চললো মাতৃভূমির গোলপোষ্টের দিকে
নাক আর ঠোঁট
নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে
এক চিলতে সরু লিকলিকে দেশ
যেন দুপাশের দুই উশকো-দাড়ি গালের
সংযোগ রক্ষাকারী নিরীহ বিদ্যাসাগর সেতু
যেন দুই স্বর্গীয় মহাদেশ মুখোমুখি যুযুধান
সেই সেতুর দুই প্রান্তে
মানচিত্রে যার নাম পানামা —
ওপরে অতলান্তিক নিচে প্রশান্ত
ওপরে শ্বাসঝড় আর
নিচে কথার মস্ত বড়ো কারখানা
এই পানামা নামক নোম্যানস্ ল্যাণ্ডে
ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে বাস
একদল দ্বিপদী জন্তুর —
যারা কথা ও শ্বাস দুটোই
প্রতিবেশী দুটি দেশ থেকে ধার করে
আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপন করে
গুগুলজ্যাঠা বললেন –
সেই জঙ্গল উঠে আসছে পর্বতে
বার্নাম উঠে আসছে ডানসিনানে
ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত সেক্সপিয়র থেকে রবিঠাকুরে
নোম্যানস্ল্যাণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবী জুড়ে
কাঁধ ঝাঁকিয়ে জ্যাঠা বলে চলেছেন –
ওরে, পা নামা এবার
আর উত্তরে
পা গুটিয়ে বসে দ্বিপদীদের ফিসফিস স্বগতোক্তি –
টুমরো, এন্ড টুমরো, এন্ড টুমরো
ইউরেকা আর ইউরেকা
পুরুষাঙ্গ আর যোনিদ্বারের মাঝখানে
তীব্র গোপন এক মাংসাশী খিদের শহর
যতোক্ষণ খাদ্যের অনন্ত যোগান, খিদেও সুন্দর
পাহাড়-নদী-অরণ্য আর
মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টির মাঝখানে
খুনসুটে চড়াই চাদরে পায়রাপটির পটশিল্প
এমনিতে ঝাঁ চকচকে যৌনগন্ধী ম ম
কিন্তু শহরের বৃহত্তর ঘিঞ্জি এলাকায়
অন্য এক প্রাগৈতিহাস খিদের অতিমারী
হাড় জিরজিরে ফুটপাথে অনন্ত উকুন সহবাস
শান্তি সমৃদ্ধির ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে
যে কোনো হ্যাবোলখ্যাবোল অর্গাজমে
কবিতার বীজতলার পিনকোড লেখা থাকে না
বরং লিঙ্গ আর যোনি পরস্পর যুযুধান
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ময়দানে
আর শুকনো বেজন্মা বীর্যের মুক্তোদানা ঘাড়ে
ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে
দৌড়ে যাচ্ছে
পরিযায়ী পিঁপড়ের দল
জীবন আর মরণ
জীবন আর মরণ
উইম্বলডনের ঘাসে দুদিকে যুযুধান দুজন
মাঝখানে জালের পাশে সিঁড়ির ওপর বসে
আমি অনন্ত হাতপাখা
অনর্গল ঘাড় এদিক ওদিক করতে করতে
প্রায়শই গুলিয়ে ফেলি
কোনদিকে জীবন আর কোনদিকে মরণ
এ যুদ্ধে আমার ভুমিকা শুধু
শেষ বাঁশি বাজিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা
হরিহর আর রবিশঙ্কর
ইনকিলাব আর জিন্দাবাদ
শব্দদুটির মাঝখানের ফাঁকে মুখ গুঁজে
কাকেশ্বর একমনে শ্লেটপেন্সিলে অঙ্ক কষে
সাত দু’গুণে চোদ্দর চার, হাতে রইলো …
বাতাসের বিষাদ রঙ মেখে
হুমড়ি গাছের চিলেকোঠা শিকড় ডিঙিয়ে
হাড় জিরজিরে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক গ’লে
হরিহর ডাক দিলো – দুগ্গা-আ-আ
আর রবিশঙ্কর তারসানাইয়ে বাজালেন
যুদ্ধ রাগ – বন্দিশে মা নিষাদ
এই হরিহর আর রবিশঙ্কর
দুগ্গা আর তারসানাইয়ের মাঝখানের
মুহূর্তের পারমাণবিক ডেসিমেলে
কাকেশ্বরের আবহ গণিত–
সাত দু’গুণে চোদ্দর চার
প্রতিবারই কী আশ্চর্য–
হাতে থেকে যায় প্রলেতারিয়েত পেন্সিল
আর মূল অঙ্কের মুনাফা পুঁজিসহ
খেয়ে যায়
হিজিবিজবিজেরা
ইনকিলাব আর জিন্দাবাদ
দুটি নির্জন দ্বীপ হয়ে
র্যাফায়েলের সৃষ্টিচিত্রের ভঙ্গিতে
কোনমতে বেঁচেবর্তে থাকে
যেন চারুলতার শেষ দৃশ্যের
দুটি পাথর-হাত
আর সেই দু’হাতের মাঝখানে মুখ গুঁজে
কাকেশ্বর একমনে শ্লেটপেন্সিলে অঙ্ক কষে
সাত দু’গুণে চোদ্দর চার, হাতে রইলো …