জয়ন্ত কুমার মল্লিক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(৪র্থ পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
চার
খাওয়ার পদ্ধতি – ১৫ই নভেম্বর, ১৯২০
কমলা-অমলা থালা থেকে কুকুরের মতো খেতো বা পান করত, প্লেটে মুখ নামিয়ে রাখত। শক্ত খাবার যেমন ভাত, মাংস ইত্যাদি হাত দিয়ে নয়, মুখ নিচু করেই খাওয়া সারতো। তরল খাবার, যেমন জল বা দুধ, তারা কুকুর ছানার মতো লেহন করে বা চেটে খেত। ১৯২০ সালের পনেরই নভেম্বরে খাওয়ার এই ধরণটি প্রথম লক্ষ্য করা হয়, যখন সারা গায়ের ঘা সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হবার পরে, তারা একটু বসতে এবং কিছুটা হামাগুড়ি দিতে শিখল।
১৯শে নভেম্বর, ১৯২০
ক্ষুধার্ত হলে গন্ধে গন্ধে তারা খাবার রাখার জায়গায় এসে বসে থাকত। ব্যাপারটা ১৯ তারিখে প্রথম লক্ষ্য করা হয়েছিল। তারা সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকত, আর খাবার না পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়ে আবার একটু পরে চলে আসত। যতক্ষণ না তারা খেতে বা পান করার কিছু পেত ততক্ষণ ছটফট করত, অধৈর্য হয়ে এই যাওয়া-আসা করতেই থাকত।
২রা ফেব্রুয়ারি, ১৯২১
পরে, যখন মেয়েরা আমার স্ত্রীর সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠ এবং পরিচিত হয়ে উঠল, তখন তারা তাঁর কাছে দেখা করতে আসত, তবে তার কাছাকাছি যেত না, কিন্তু সে যে ঘরে থাকত, সেই একই ঘরে রয়ে যেত, যতক্ষণ না তাদের খাবার বা পানীয় দেওয়া হত। এই আচরণ ১৯২১ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ্য করা যায়।
৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২১
আশপাশে কোথাও খাবার বা মাংসের ন্যূনতম গন্ধ তাদের আকৃষ্ট করত, এমনকি একটি মৃত প্রাণী বা পাখি কাছাকাছি পড়ে থাকলেও তারা এক্কেবারে সেই ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হত এবং সাথে সাথে সেই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারপরে সেটি গ্রাস করত, কেউ তাদের বাধা দিলেও একদম শুনত না। তারা খুব রাগ দেখাত এবং কিছুতেই সেটা ছাড়ত না, আঁকড়ে চেপে ধরে থাকত। যদি কেউ সেই খাবারটি ধরে টানাটানি করত বা ছিনিয়ে নিত তবে তারা সেই খাবারে অন্তত একটি বড় কামড় দিয়ে মুখভর্তি করে নিত, পুরোপুরি ছাড়ত না। এই আচরণ ওপরের তারিখে লক্ষ্য করা গেছে।
আমার স্ত্রী অর্থাৎ মিসেস সিং তাদের সেবিকা ছিলেন এবং অসুস্থতার সময় ও পরেও তিনি তাদের খাওয়াতেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা তাঁর কাছ থেকে খাবার চাইত। এই বিশ্বাস এবং প্রতিবার তাদের প্রত্যাশার পূর্ণতা তাদের পরবর্তীতে এক দারুণ সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল। যখন মেয়েরা তৃষ্ণার্ত হত তখন ছোটটি একটি অদ্ভুত আওয়াজ করত, “ভু, ভু,” এবং মিসেস সিং বুঝতে পেরে যেতেন যে অমলা জল চাইছে; কিন্তু কমলা তার জিভ দিয়ে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার ঠোঁট চাটত যেন তার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে এবং আমার স্ত্রীও বুঝে যেতেন যে কমলা তৃষ্ণার্ত।
ডিসেম্বর ১২, ১৯২০
এই তারিখে প্রথম লক্ষ্য করা গেল কমলা তৃষ্ণার্ত অবস্থায় অমলার মতো কোন শব্দ করেনি। তারা পানীয় হিসাবে জল খুব একটা খেতে চাইত না, কিন্তু সবসময় দুধ খেতে পছন্দ করত।
হাঁটা এবং দৌড়োনোর পদ্ধতি
কমলা আর অমলা মানুষের মতো দু’পায়ে চলতে পারত না। তারা চার হাতপায়ে চলাফেরা করত। চওড়া কাঁধে মাথা খাড়া, শরীর সোজা, নিতম্বের জোড়গুলোর ওপর ভর দিয়ে, উরু হাঁটুর সঙ্গে একটি স্থূল কোণ তৈরি করে এবং পা তুলে গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে এবং পায়ের সামনের অংশটি মাটিতে পায়ের আঙ্গুলগুলোর ওপর দিয়ে পেছনের শরীরের ভার ছেড়ে দিত। শরীরের সামনের অংশটি সোজা করে রাখা হাতের ওপর থাকত, মাটিতে ছড়িয়ে থাকা তালু এবং আঙ্গুলগুলো দেহকে চালনা করত। খুব দ্রুত চলার উপায় ধীরগতিতে বা দ্রুত গতিতে চলবার সময় ওরা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিত। এছাড়াও, যখন তারা ধীরে ধীরে চলাফেরা করত, সাধারণত তারা হাত এবং হাঁটু ব্যবহার করত, কিন্তু দ্রুত দৌড়াতে তা করত না। চার হাতপায়ে তারা খুব দ্রুত দৌড়াতে পারত এবং তাদের ছাপিয়ে যাওয়া সত্যিই একটি অসম্ভব কাজ ছিল।
ঘুমানোর পদ্ধতি
কমলা ও অমলা দু’জনেই ছোট শূকর বা কুকুরের ছানার মতো ঘুমোতো, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। যখন তারা মাটিতে শুয়ে থাকত, তখন তারা সাধারণত বসে বা হেলান দিয়ে, হাত-পা একসাথে করে কুঁকড়ে থাকত। তাদের ঘুম খুব হালকা ছিল; ন্যূনতম শব্দ পেলে তারা চমকে উঠত। তারা মধ্যরাতের পর কখনো ঘুমোতো না এবং রাতের বেলা নির্ভয়ে হেঁটে বেড়াতে ভালোবাসত। এই আচরণ ওই বয়সের মানব শিশুদের মত নয়।
১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯২১
ওই দিন দেখা গেল তারা অস্থিরভাবে উঠোনে টহল দিচ্ছে, আর সারাক্ষণ চেষ্টা করছে বাইরে বেরোনোর একটা পথ খুঁজে পেতে। ঠান্ডা বা তাপের অনুভূতি মানুষের মত তাদের ঠান্ডা বা গরমের সেরকম প্রকাশ বা উপলব্ধি ছিল না। শীতকালে আমরা তাদের পোশাক পরিয়ে দিতাম, কিন্তু তারা এই পোষাকে খুব বিরক্ত বোধ করত এবং তাদের একা রেখে দিলেই তা ছিঁড়ে ফেলত। আমরা রাতে তাদের কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তারা সেগুলো ফেলে দিত এবং বারবার বললে ছিঁড়ে ফেলত। তারা মোটেও ঠাণ্ডা অনুভব করত না এবং শীতল আবহাওয়াতেও তাদের শরীরে কোনো আবরণ রাখতে বা পোশাক পড়ে থাকতে পছন্দ করত না। তাদের কখনই সবচেয়ে ঠাণ্ডা মৌসুমে কাঁপতে দেখা যায়নি বা সবচেয়ে গরম দিনে বা রাতে ঘামতে দেখা যায় নি।
সেলাই করা কৌপিন- ১০ই নভেম্বর, ১৯২০
আমরা বাধ্য হয়েছিলাম তাদের সবসময় নগ্ন থাকার অনুমতি দিতে, শুধু একটি কৌপিন বা কাছা সেলাই করে তাদের কটিতে এমনভাবে পড়িয়ে দেওয়া হত যাতে তারা এটি কোনমতেই খুলতে না পারে। তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে এটি পরিধান করতে বাধ্য হত কারণ তারা এটি খুলতে বা ছিঁড়তে পারত না, তবে তারা প্রথমে এটি পরে খুব বিরক্ত বোধ করেছিল। এটা থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় তাদের সর্বদা ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত।
আমরা যখন তাদের দর্শনার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতাম, আমরা সর্বদা একটি ঢিলেঢালা পোশাক, যেমন একটি ঢিলেঢালা ফ্রক, তাদের গায়ের ওপর ফেলে দিতাম এবং তাদের ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসতাম।
গ্রীষ্মের সবচেয়ে গরমের দিনে, ১৯২০ সালের ১৫ই জুন এবং তারপরে যখনই তারা গরম অনুভব করত, তারা ঘরের একটি ঠান্ডা কোণ বেছে নিত এবং দিনের সমস্ত সময় এখানেই থাকত। অন্যরা যখন ঘামে ভিজে যেত, তারা আগের মতোই শুকনো থাকত, তারা ঘামত না বা তাদের ঘাম হত না। এমনকি গ্রীষ্মকালে যখন আমরা আমাদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য প্রচুর জল পান করতাম, তখন তাদের মোটেও পেত জল তেষ্টা পেত না। তারা শীতকালে যে পরিমাণ জল বা দুধ খেত, গ্রীষ্মকালেও সেই একই পরিমাণ জলীয় পদার্থ পান করত। তাদের প্রধান পানীয় ছিল দুধ এবং জল বেশি খেতে চাইত না। গ্রীষ্মকালে তাদের শরীর ঠান্ডাই থাকত এবং তারা গরমে অস্থির হত না। তাদের দেহের চামড়া ছিল খুব মসৃণ, সমান এবং খুব নরম। এটি মোটেই শুকনো খস্খসে বা শক্ত ছিল না, বা এটি মোটেও চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত ছিল না এবং কোনও ময়লা থেকেও মুক্ত ছিল।
কনকনে শীতের ঠান্ডায় সকালে তারা কটি কাপড় ছাড়া প্রায় উলঙ্গ হয়েই আমাদের সাথে ঘরের বাইরে বের হত এবং কখনোই কাঁপত না বা ঠান্ডা লাগার কোনো লক্ষণই তাদের মধ্যে দেখা যায় নি।
অবশ্য আগুন কি তা তারা জানত এবং আগুনের কাছে কখনো যেত না। তারা আগুন পছন্দ করত না, বরং আশেপাশের পরিবেশে উষ্ণতা ছড়ানো জ্বলন্ত অঙ্গারের শিখা বা লাল রঙের আভা দেখলেও ভয় পেত। তখন তারা ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে বা ছায়ায় ছুটে যেত যেখানে কোন আলো নেই। এই আচরণটি ১৯২১ সালের ২৪শে এবং ৩১শে ডিসেম্বর এবং ১৯২২ সালের পয়লা জানুয়ারিতে বারবার দেখা গিয়েছিল।
দৃষ্টিশক্তি এবং অন্ধকার। তারা অন্ধকার পছন্দ করত এবং সারা বছর তাদের ছাত্রাবাসের অন্ধকার জায়গায় থাকতে চাইত। যেমনটি আমি আগেই বলেছি, তারা তাদের মুখ ঘরের কোণার দিকে ঘুরিয়ে রাখত এবং একত্রে ঘন্টার পর ঘন্টা গান করত, হয়তো বা দার্শনিকদের মতো একটা বড় সমস্যা নিয়ে চিন্তা করত, তাদের চারপাশের জিনিসগুলোর দিকে কখনই ফিরে তাকাত না। দিনের বেলা সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত তারা সেই কোণ ছেড়ে যেত না। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা তাদের খাবার ঘরে নিয়ে যেতাম। এ ছাড়া যখনই তাদের ক্ষুধা লাগত, তারা নিজেরাই অল্প সময়ের জন্য বের হয়ে চলে যেত সেই জায়গায় যেখানে তারা জানত যে খাবার রাখা আছে।
১৫ই মার্চ, ১৯২১
তারা বেশি রোদ সহ্য করতে পারত না। যদি অল্প সময়ের জন্য রোদে থাকত তাহলে তারা হাঁপাতে শুরু করত, বা খুব জোরে জোরে শ্বাস নিতে আরম্ভ করত এবং তাদের নির্বাচিত অন্ধকার কোণে ছুটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করত। ১৯২১ সালের পনেরই মার্চ তাদের সূর্য সহ্য করার অক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়।
এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে তারা দিনের বেলায় যখন প্রখর সূর্যের আলো ছড়ায় তখন তারা ভালোভাবে দেখতেও পেত না। তখন তারা তাদের চোখ পুরোপুরি খুলতেও পারত না এবং প্রায়শই দ্রুত তাদের চোখ খুলত এবং বন্ধ করত, এক কথায় আলোক সংবেদনশীলতার কারণে তাদের চোখের পাতা পিটপিট করত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক চাপই এমন অবস্থার জন্য দায়ী। আমরা যদি তাদের রোদে রাখার জন্য জোর দিতাম, তারা চোখ বন্ধ করত এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করত।
১৯২১ সালের ২রা মার্চ
বেলা একটার দিকে একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। একের পর এক মাংসের হাড়গুলো তাদের সামনে রাখা হলো। তারা মাংসের ঠিকঠাক গন্ধ পেয়েছিল বটে, কিন্তু ছায়াময় জায়গায় বা রাতে যতটা সহজে হাড়গুলি খুঁজে পেত সেরকম মোটেই সহজে শনাক্ত করে ধরতে পারছিল না।
সেই কারণে রাতেই তারা বাইরে থাকতে চাইত এবং সম্ভব হলে খোলা মাঠে বা জঙ্গলে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করত। যেমনটি আমি আগে বলেছি, তারা রাতে অনেক ভাল দেখতে পারে এবং একটি নীল আভা ছড়ানো জিনিস বা প্রাণীর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
এখানে আসার প্রথম দিকে আলো দেখলে তারা ভয় পেত। অরফানেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম কয়েকদিনের জন্য আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম এই ভয় দূর করতে, যখনই ঘরে হারিকেন লণ্ঠন নিয়ে আসা হত তখনই তারা নিজেদেরকে লুকানোর চেষ্টা করত।
২৩শে অক্টোবর, ১৯২০
প্রথমবার আমি তাদের আলোর ভয় লক্ষ্য করলাম এই দিনে, রাতের বেলা। আমি তাদের উপস্থিতিতে একটি দেশলাই কাঠিও জ্বালাতে পারিনি। যদিও তারা দুর্বল ছিল এবং নড়াচড়া করতে পারত না, তবুও তাদের চেহারায় ভয়ের লক্ষণ প্রকাশ পেত এবং তারা তাদের ভাবভঙ্গিতে তার সামান্য প্রকাশও করত। দরজায় আঁচড় দিয়ে বের হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠা
সন্ধ্যার আগে লাল রঙের আকাশের মতো উজ্জ্বল দৃশ্য তারা পছন্দ করত। বিকেল সাড়ে ৫টায় প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ দেখায়। একমাত্র যে পরিবেশ তারা চাইত সেটি হল তারা নিজেরা একা একাই থাকবে। প্রথম যেদিন তারা হামাগুড়ি দিতে পারল সেই দিনই এটা লক্ষ্য করা গেছে।
২রা ডিসেম্বর, ১৯২০
এই তারিখে তারা প্রথমে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে যখন তাদের শরীরের ঘা প্রায় সেরে গিছল।
সূর্যোদয়ের পর তারা খোলা জায়গায় যেতে পছন্দ করত না; তারা অবশ্যই লুকানোর চেষ্টা করত। যদি ঘরে না থাকত তবে তারা অবশ্যই কোন কিছুর আড়ালে বা কোণ খুঁজে নিয়ে থাকত এবং যদি তারা খোলা মাঠে থাকত তাহলে তারা কাছাকাছি কিছু ঝোপঝাড়ের সন্ধান করত। এটি প্রথম দেখা গিছল যেদিন আমি এবং মিসেস সিং তাদের খুব ভোরে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম, যখন প্রায় চারটে বাজে, চারদিকে তখনও অন্ধকার, দিনটা ছিল ১৯২০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর।
প্রকৃতির ডাক
ওদের প্রস্রাব বা মলত্যাগ করানো প্রথমে আমাদের কাছে একটি সমস্যা ছিল। শিশুরা যে কোন স্থানে এবং যে কোন সময় প্রস্রাব বা মলত্যাগ করত। আমরা সময় জানতাম না বলে ব্যবস্থা নিতে পারি নি এবং তারা যখনই বেগ অনুভব করত তখনই প্রস্রাব বা পায়খানা করে ফেলত। বাড়ির বাইরে বা বাড়ির উঠানে প্রস্রাব বা পায়খানা করার অভ্যাস তৈরি করার জন্য আমরা সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় নিয়মিত তাদের বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করলাম। পরে দেখা গেল, যখন তাদের বাইরে না নিয়ে যাওয়া হতো, তখন তারা ঘরের ভেতরে, বা যেখানেই থাকত সেখানেই জায়গা নোংরা করে দিত। তখন আমি ভাবলাম তারা কিভাবে তাদের বাসস্থানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারত?
তাদের গুহার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল যে, তারা সারা রাত গুহার বাইরে ঘোরাঘুরি করত এবং সেই সময়ের মধ্যে প্রসাব-পায়খানা সবকিছু শেষ করে গুহায় ফিরে এসে সারাদিন সেখানে বিশ্রাম নিত। এটাও অনুমান করলাম যে শাবক এবং বাচ্চারা যখন নেকড়েদের সাথে বাইরে যেতে পারত না, তখন গুহার ভিতরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলে মা নেকড়ে নোংরা চেটে চেটে পরিস্কার করত এবং তাদের খাওয়ার পরে পড়ে থাকা হাড়গুলো মুখে করে বাইরে ফেলে দিত। তাই গুহায় কোন নোংরা থাকত না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই কুকুর-বেড়ালের মত নেকড়েরাও তাদের গুহাটিকে পরিষ্কার ও পরিপাটি রাখার জন্য একইভাবে কাজ করত। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে তাদের নিজেদের দেহকে মুছে পরিষ্কার করার কোন ধারণা নেই। নিজেদের পরিষ্কার করার জন্য তারা তাদের দেহের অপরিষ্কার বা নোংরা অংশ মাটিতে ঘষত, বিড়াল এবং কুকুরের মতই। আমরা তাদের গা ধোয়ার জন্য বাধ্য করতাম। যখনই আমরা মাঠে ঘুরে ফিরে আসতাম, মিসেস সিং প্রতিবার তাদের কাছে এজন্য উপস্থিত হতেন। এই ধোয়ামোছা করাতে তারা খুব বিরক্ত বোধ করত কারণ তারা কখনই গায়ে জল ঢালা পছন্দ করত না এবং ধোয়ার জন্য জলের কাছে যেতেও চাইত না।
৩১শে জানুয়ারী, ১৯২১
ওই দিন দেখেছিলাম যখন তারা তৃষ্ণার্ত ছিল তখন তারা একটি জলাশয় থেকে জল খাচ্ছিল কিন্তু যখন তারা বুঝতে পারত যে সেখানে তাদের গা ধোয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তারা খুব ছটফট করত এবং চান না করার অভিপ্রায়ে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ লড়াই করত। কুকুর বা বিড়াল যেভাবে গোসলের অনুমতি দেয় সেভাবে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাদেরকে গায়ে জল ঢালতে দিত। বেশ কয়েকবার জোর করার পর ধীরে ধীরে তারা বশ্যতা স্বীকার করল, যদিও তার জন্য অনেকটা সময় লেগেছিল।
ক্রমশঃ…
আগের পর্বগুলি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকগুলিতে—
জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা