জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(২-য় পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
দ্বিতীয় অধ্যায়
অক্টোবর ২৮, ১৯২০ – থেকে – ৪ঠা নভেম্বর, ১৯২০
আমি বৃহস্পতিবার, ২৮শে অক্টোবর, গোদামুড়ি ছেড়ে আসি এবং চতুর্থ নভেম্বর অর্থাৎ আর এক বৃহস্পতিবার মেদিনীপুরে পৌঁছাই এবং আমার স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে এসব বিষয়ে কিছু বলিনি। আমরা পথে দেরি করেছিলাম, মেয়েদের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় থেমেছিলাম। তারা এই যাত্রাটি বেশ উপভোগ করেছিল। আমরা নিরাপদে এতিমখানা (Orphanage)-য় পৌঁছে, তাদের উদ্ধার এবং বাঁচানোর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা যেদিন পৌঁছেছিলাম সেদিনই তাদের এতিমখানায় ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের কেবল অসহায় শিশু হিসাবে গ্রহণ করা হল। তারা এতটাই দুর্বল এবং রোগা ছিল যে তারা চলাফেরা করতে পারত না, তাই তাদের অসাধারণ ইতিহাস সম্পর্কে কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারে নি। আমি আমার স্ত্রীর অনুমোদনের জন্য বাচ্চাদের আবিস্কারের পুরো ঘটনা খুলে বললাম, তাকে খুব অনুরোধ করলাম যেন কাউকে কিছু না বলা বা কোনোভাবেই ঘটনা প্রকাশ না করা হয়। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই যে সে তার প্রতিশ্রুতি চমৎকারভাবে রক্ষা করেছিল।
নভেম্বর ২৪, ১৯২০
কয়েকদিন পর মেয়ে দু’টো যখন একটু শক্তপোক্ত হল আর দাঁড়িয়ে চানও করতে পারল, তখন তাদের মাথার জট পাকানো চুল কেটে দিলাম। আর তাদের দেখতে একদম পালটে গেল। আমি ধারণা করলাম বড়টির বয়স আট বছর এবং ছোটটির প্রায় দেড় বছর কম অর্থাৎ সাড়ে ছয় বছর। আমরা বড় মেয়েটির নাম রাখলাম কমলা ও ছোট মেয়েটির অমলা।
আমি যখন কমলা এবং অমলাকে প্রথম জঙ্গলে দেখেছিলাম, তখন তারা খুব সুস্থ এবং শক্তপোক্ত ছিল। কিন্তু ২৩শে অক্টোবর যখন আমি তাদের স্টকেডের ভেতরে দেখলাম সেই সময় কয়েকদিন অনাহারে তাদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। তাদের পূর্বের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার আগেই সারা শরীরে এক অদ্ভুত ধরণের ঘায়ে ভরে গিছল। এই ঘাগুলো হাঁটুতে এবং কব্জির কাছে হাতের তালুতে বেশ বড় ছিল এবং অনেকটা মাংস খয়ে গিছল যা চারদিকে হাঁটার ফলেই তৈরি হয়েছিল। ঘাগুলি খুব ভয়ঙ্কর দেখতে হয় গিছল এবং মাংসের গভীরে চলে গিছল। কখনও কখনও, তাদের কুষ্ঠরোগীর মতো দেখাচ্ছিল। হাঁটু এবং তালুতে আক্রমণ করার পাশাপাশি, তাদের পা, কনুই এবং গোড়ালি পর্যন্ত সেই ঘা প্রসারিত হয়েছিল। একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যেন তারা কুষ্ঠরোগী ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের ওষুধ ছিল কার্বলিক সাবান, কার্বলিক লোশন, আয়োডিনের টিংচার, জিঙ্ক এবং বোরিক অ্যাসিড। আমার স্ত্রী এবং আমি কার্বলিক লোশন এবং কার্বলিক সাবান দিয়ে ঘা ধুয়ে ফেলতাম এবং বোরিক তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ করতাম এবং যখন ঘাগুলো দানাদার তৈরি হতে শুরু করত, তখন আমরা সেগুলিকে আয়োডিন লোশনের টিংচার দিয়ে ধুয়ে ফেলতাম, শুকিয়ে গেলে, বোরিক এবং জিঙ্ক অ্যাসিড ছিটিয়ে দিতাম এবং তুলো দিয়ে তাদের ব্যান্ডেজ করে দিতাম। আমরা নিজেরাই সবকিছু করেছি এবং পাছে তারা ধরা পরে যায় সেই ভয়ে ডাক্তারকেও ডাকিনি। আমাদের দুর্দান্ত স্বস্তি হল যখন আমরা দেখলাম যে ঘাগুলি দানাদার হয়ে পুরোপুরি লাল রঙে পরিণত হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তাদের তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগেছে।
৫ই ডিসেম্বর, ১৯২০
৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে ওদের ঘা সেরে যায়। শিশুদের স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতি হয় এবং দিনে দিনে তারা শক্তিশালী হয়। আমি দেখলাম ওরা কাঁচা মাংস এবং কাঁচা দুধ খুব পছন্দ করে। পূর্বে উল্লেখ করেছি, তাদেরকে শুধুমাত্র কাঁচা দুধে খেতে দেওয়া হয়েছিল। আমরা ভয়ে তাদের আর কিছু দিতে পারিনি পাছে তারা আরও হিংস্র হয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। তারা সেই খাদ্য এবং উদ্ভিজ্জ খাবার খেয়ে ভাল উন্নতি করেছিল।
১৯শে ডিসেম্বর, ১৯২০
এই দিন বাচ্চারা তাদের পায়ে এবং হাতে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা নড়াচড়া করতে সক্ষম হয়েছে, তবে আগের মতো নয়। তারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতেও পারেনি, যদিও আমরা তাদের এজন্য খুব চেষ্টা করেছিলাম। ধীরে ধীরে তারা শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে তারা চার হাতপায়ে চলতে শুরু করে এবং পরে দৌড়াতেও পারে। যখন তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হল, তারা কাঠবিড়ালির মতো খুব দ্রুত দৌড়াতো এবং তাদের ছাড়িয়ে যাওয়া সত্যিই খুব কঠিন ছিল।
২১শে ডিসেম্বরে,
আমরা তাদের আর একটি কুড়িয়ে-পাওয়া অজ্ঞাতপরিচয় শিশুর সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ দেখলাম, তার নাম ছিল বেঞ্জামিন। ১৯১৯ সালের ৮ই জানুয়ারী বুধবার তাকে জঙ্গলের শুকনো পাতার মধ্যে থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়, তখন তার পাঁচ মাস বা তারও বেশি বয়স। শিশুটিকে বারোই জানুয়ারি পুটা নামে এক এতিমখানায় ভর্তি করা হয়। তার ছিল শোকাবহ ইতিহাস। এই শিশুটির বয়স ছিল প্রায় এক বছর। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখছিল, হাঁটা শুরু করার আগে শিশুদের মতো। নেকড়ে-বাচ্চারা এবং সে ঘরে একসাথে মেলামেশা করত এবং খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা ভেবেছিলাম যে এই যোগাযোগটি তাদের নড়াচড়ার পদ্ধতিকে উন্নত করার একটি খুব ভাল উপায় এবং কথা বলা এবং অভ্যাসের মাধ্যমে তাদের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও খুব সহায়ক হবে।
ডিসেম্বর ৩১, ১৯২০
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, হঠাৎ একদিন, একত্রিশে ডিসেম্বরে, বেঞ্জামিনকে নেকড়ে-শিশুরা কামড়ে ধরে এবং মোটামুটিভাবে আঁচড়ে ফেলে। এরপরে বেঞ্জামিন কখনই তাদের ধারেকাছে আসেনি এবং সর্বদা তাদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। তাদের দেখে সে ভীষণ ভয় পেত।
এই ঘটনা থেকে ধারণা করলাম ওদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে এবং বুঝতে পারলাম যে বেঞ্জামিনের থেকে কমলা-অমলা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, তাই তারা ছেলেটাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। এরপর যখন তারা সম্পূর্ণরূপে জানতে পারে যে সে তাদের মত একজন নয়, তখন তারা তার সাথে মারামারি করে, যা ছেলেটাকে এতটাই ভীত করেছিল যে সে তাদের সঙ্গ একেবারে ছেড়ে দেয় এবং পরে তাদের কাছে আর আসেনি।
প্রথম থেকেই কমলা-অমলা নির্জনতা প্রিয় ছিল। তারা ঘরের এক কোণে একত্রে কুঁকড়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত, যেন কোনো বড় সমস্যা নিয়ে ধ্যান করছে। ঘরের মধ্যে যা চলছে সেসবের প্রতি তারা বেশ উদাসীন ছিল। কোনো কিছুতেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়নি। তারা সেখানে বসে সারাক্ষণ গান করত। যদি আমরা মাঝে মাঝে তাদের স্পর্শ করে এবং কোনও কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতাম তবে তারা কেবল কড়া দৃষ্টিপাত করত, আর যেন কিছুই দেখছে না এমন ভাব করে দ্রুত তাদের চোখ আবার কোণে ঘুরিয়ে দিত। আমরা কখনই তাদের একা রাখিনি, তবে সবসময় ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েকটি অনাথ শিশুকে ঘরে রেখেছিলাম। তার দুটি কারণ ছিল- প্রথমত, তাদের পাহারা দেওয়া, যাতে তারা পালিয়ে না যায়; দ্বিতীয়ত, তাদেরকে অন্যান্য শিশুদের সাথে মেলামেশা করানো। বাচ্চারা খেলবে, বকবক করবে এবং ঘরে ঘোরাফেরা করবে, কিন্তু এই জিনিসগুলি তাদের মোটেই আগ্রহী করে তোলেনি। তারা বেশ আগ্রহহীন এবং উদাসীন ছিল।
লজ্জা বা ভয়
তারা প্রথম থেকেই লাজুক ছিল। এই লজ্জা আমি ভয় ভেবেছিলাম, বিশেষ করে তাদের উদ্ধার এবং পরবর্তীতে ধরার পরে, তারা তখন পরিচিত শাবক এবং নেকড়েদের সন্ধান করছিল। এটা লক্ষণীয় ছিল যে তারা ওদের সঙ্গ এবং মেলামেশা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে তো এখানে তারা পাচ্ছিল না, তাই অন্য শিশুদের সাথে বা কারো সাথেই মিশতে অস্বীকার করেছিল। তারা কোন সময় শিশুদের উপস্থিতি সহ্য করতে পারত না, এবং সর্বদা তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত। ঘরে অন্যদের উপস্থিতি তাদের কোন কিছু করতে দিত না, এমনকি তারা মাথা এক দিক থেকে অন্য দিকে সরাতো না বা একটু ঘুরতে, পাশ পরিবর্তন করতেও চাইত না। এমনকি তাদের দিকে তাকালেও তারা আপত্তি করতো। তারা নিজেরা ছাড়া মানব সমাজকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছিল। যদি আমরা তাদের কাছে যেতাম, তারা মুখব্যাদান করে এবং কখনও কখনও তাদের দাঁত দেখাতো, যেন আমাদের স্পর্শ বা সঙ্গ দিতে নারাজ। এই ব্যবহার সর্বদা, এমনকি রাতেও, লক্ষ্য করা গেছে।
জানুয়ারী ২৯, ১৯২১
২৯শে জানুয়ারী, শনিবার, একবার তারা পালিয়ে যেতে চাইলে, রোদা নামে একটি মেয়ে তাদের পালাতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা তাকে এমন কামড় এবং এমন আঁচড় দিয়েছিল যে সে তাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ওরা দৌড়ে বেরিয়ে কম্পাউন্ডের বাইরে ল্যান্টানা ঝোপে ঢুকে পড়ে। তারা কাঠবিড়ালির মতো দ্রুত ছুটেছিল এবং তাদের অতিক্রম করা যায়নি। তারা ঘন ঝোপের ভিতরে ঢুকে পড়ার পর তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের খুঁজে পাবার জন্য আমাদের ঝোপঝাড়ে বাড়ি মারতে হয়েছিল। তাদের খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন কাজ ছিল, কারণ তাদেরকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সেখানে নীরব ছিল। মানুষের সংগে মেলামেশা ও মানুষের বাসস্থান এড়িয়ে চলা তাদের স্বভাব ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের খুঁজে বের করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, কিন্তু তাদের মনোভাব অপরিবর্তিত রয়ে গেল।
স্বাধীনতা
এসব সত্ত্বেও তাদের কখনই বন্ধ করে রাখা বা শৃঙ্খলিত করা হয়নি, তবে সর্বদা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছিল, এতিমখানার শিশুদেরকে তাদের প্রহরী হিসাবে রাখা হয়েছিল। বেঞ্জামিন এবং রোডাকে কামড়ানো এবং আঁচড় দেওয়ার পরে, কোনও শিশু কখনও তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি, যদিও আমি লক্ষ্য করেছি যে ছোট বাচ্চারা তাদের নিজস্ব উপায়ে তাদের খুশি করার চেষ্টা করেছিল, যার মাধ্যমে এই অদ্ভুত প্রাণীদের প্রতি তাদের ভালবাসা এবং স্নেহ দেখিয়েছিল। তারা তাদের সাথে খেলার জন্য তাদের প্রলুব্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এতে তারা খুব বিরক্ত হত এবং তাদের চোয়াল খুলে, তাদের দাঁত দেখিয়ে এবং মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ করে তাদের ভয় দেখাত। তাই তাদের এবং শিশুদের মধ্যে কোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করা আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কমলা আর অমলা ওদের মোটেই পছন্দ করেনি।
নভেম্বর, ১৯২০ থেকে জানুয়ারি, ১৯২১
আমাদের সাথে তাদের মেলামেশার এই পর্যায়ে, প্রায় তিন মাস, কেবল আমাদের নয় সকলের ক্ষেত্রেই, তাদের আবাসে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল এবং নড়াচড়া এবং খেলা অপছন্দ ছিল – সংক্ষেপে, সব মানুষের থেকে দূরে থাকাই তাদের কাছে শ্রেয় ছিল।
তারা এখানে জঙ্গলে তাদের সঙ্গী খুঁজে পায়নি; তারা নেকড়েদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে পারেনি; তারা তাদের আরামদায়ক গুহা মিস করছে, এবং কাঁচা মাংস বা দুধ খেতে পারছে না। ফলস্বরূপ, তাদের পুরানো পরিবেশের চিন্তা তাদের মনে প্রচন্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তাদের ভাবনা ছিল কিভাবে তাদের পূর্বের বাসস্থান এবং সঙ্গ পুনরুদ্ধার করা যায়। এই বাস্তবতা তাদের ধ্যানমগ্ন ও নিঃস্ব করে তুলেছিল।
ক্রমশঃ