অ নি মে ষ সিং হ-র গুচ্ছকবিতা

পরিচিতিঃ অনিমেষ সিংহসুবর্ণরেখা নদীর ধারে তার নিবাস তাই নিজেকে তিনি বলেন সুবর্ণরৈখিক। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর থেকেই তার যাবতীয় সাহিত্যচর্চা। অনিমেষের কথায়- “কবিতা লিখি, খাইদাই ঘুমাই। ভারতীয় নাগরিক। শারীরবৃত্তীয় সব কাজ স্বাভাবিক। কলকাতা থেকে কয়টা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এইটুকুই…” তিনি বলেন এর বাইরে আর কিছুই জানা নেই আমাদেরও আর বেশি কিছু জানার থাকেও না বা হয়তো থাকে, সেটা সময় বলবে, পাঠক বলবেন। আজ বাইফোকালিজম্-র পাতায় তাঁরই গুচ্ছকবিতা রইল পাঠকদের জন্য।

 

অ নি মে ষ সিং হ-র গুচ্ছকবিতা

 

পদ্মপুকুর ও একটি মেয়ের শুভবিবাহ

 

এরপরও কী পাখি ডেকে তুলবে তোমাকে? কী ভাবো! এতো ঐশ্বর্য নিয়ে ভালো থাকা যায়? আলোর ভারে ঝুঁকে আসবে তোমার মলয়পর্বত। আগুনের তাপে দগ্ধ হবে আমাজন। এই গ্রাম ছেড়ে যারা গেছে বিগত দিনগুলোতে, তারা কেউ স্পর্শ করেনি জন্নাত।
এরপরও কী তুমি চলে যাবে, শরীরে পদ্ম নিয়ে? পদ্মের ঝিল নিয়ে তুমি কেন যাবে মাফিয়ার স্বর্গে! দেবতার পায়ে রোজ, একটি করে ফুল দিতে দিতে যবে হারাবে জৌলুস – স্বর্গ নেবে না ফিরিয়ে শুকনো পুকুর। গ্রাম ছেড়ে গেছে যারা, তারা কেউ স্বর্গ দেখেনি।
চলে যাবে কেন, কবিতা লেখা হবে না একটিও, তোমাকে ছাড়া, কবিও তো স্বর্গীয়। এ গাঁয়ে যুদ্ধ শুরু হবে– তুমি ছাড়া সমস্ত ফুল হবে অস্ত্র। তুমি ছাড়া গাছের ওপর দিয়ে ছুটে যাবে রাজপথ। কেন যাবে, তোমার কৃষ্ণচূড়া মরে যাবে অবসাদে। যাবে কেন মাফিয়ার রাষ্ট্রে?

 

যুগের শেষপ্রান্ত থেকে ফিরে

এ যুগের শেষপ্রান্ত থেকে ফিরলাম এইমাত্র –
ওখানে মেয়েরা খুব ভালো আছে, স্বাস্থ্য আছে।
ছেলেরা মহাসুখী, মেদ হীন ঝরঝরে শরীর।
দেয়ালে দেয়ালে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে, প্রতিটি মানুষ কৃষক এবং কৃষাণী।
গাছে গাছে ভরপুর শহর।
পিঠে সবারই দুটো ডানা আছে- নানা রঙের।
সরকারি ডানা দুটোই যা কালো এবং ছোটো করে ছাঁটা ঠিক যেমন মিলিটারী-ম্যান চুল কাটে এখন…

যুগের শেষপ্রান্ত থেকে ফিরছি-
চুমু ও প্রেম দেখেছি চূড়ান্ত স্বাধীন ;
যদিও কিছু লোক আলোর কাটারি নিয়ে ধর্মের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে-
কারও কারও ডানা কেটে ফেলে এবং প্রবল চিৎকার করে তার
আত্মাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায়—–
কতো সাল হবে মনে নেই, ক্যালেন্ডার নেই ঘরে;
হাওয়া মোরগ আছে বাইরে, উঁচুতে

এ যুগের শেষপ্রান্তকে আমি সবুজ বলেছি, তোমরা কেউ কেউ শিউলী বা শ্রাবণ অথবা রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া
কিম্বা পাখির নামে ডাকতেই পারো-।
ওখানে-
হাসপাতালে সব জন্মদিনের কেক কেটে বৃদ্ধ ও অসুখী মানুষেরা উদযাপন করে হৃদয়ের কাল।
বুকের আঁধার কাটিয়ে ঘর ফেরে অসুস্থ মানুষ।
তাস খেলার শব্দ শুনেছি, ক্যারামবোর্ডের টুংটাং, গিটারের মিহিন সুর এমনকি বাঁশির শব্দ শুনেছিলাম হাসপাতালের গর্ভগৃহ থেকে!

যুগের শেষপ্রান্ত থেকে ফিরলাম এইমাত্র ;
আমারও দুটো হৃষ্টপুষ্ট ডানা ছিলো —
যতোই পিছিয়ে এসেছি তোমাদের দিকে,
ছোটো হতে হতে সেই ডানাদুটি উধাও হয়েছে!
তবুও শুনছি এসে এখানে বিজয়ের ধ্বনি
যাদের শিরদাঁড়া বাঁকা তারাও বলছে হুররেএ…

 

পাখি ও প্রযুক্তি এবং জন-গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ অথবা একটি কামুক কবিতা

 

পাখিটাকে ধরব! তার বর ভাববে, উড়ে গেছে উৎকৃষ্ট কাম ও প্রেমের দিকে।
কী বন্য এই কাম!

পাখিটাকে ধরে ফেলব! পুরে ফেলব খাঁচায়। দখিনের বারান্দায় গেরুয়া গোধূলি নামলে-
চুমু খাব তার মলয়পর্বতে;
এবং একহাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরলে-
পাখিটার যন্ত্রণা হবে?

পাখিটাকে ধরে ফেলা, কতো সহজ। জাল ছড়িয়ে দিয়েছি পৃথিবীর আনাচকানাচে।
পাখিটাকে ধরে নিলে, তার দুধের শিশুগুলো মাতৃস্তনের কথা ভাবতে ভাবতে
বস্তিতে ফুটপাতে খোলামেলা কাম নিয়ে বড়ো হবে
ধর্ষক হতে পারে কী!
অথবা মাফিয়া!
সামান্য কারণে কারো বুকে ছোরা গেঁথে দিতে
হাত কাঁপবে না একটুও….;

যার মাতৃস্তন কেড়ে নিয়েছি,
তাকে, রাষ্ট্রদ্রোহী বলাটা কী ঠিক হবে?

পাখিটাকে ধরে ফেলব। প্রতিটি অঙ্গ খাব।
গণতন্ত্র আমার, পেটের ভিতরে কাম। স্বাধীনতা খাব, গণতন্ত্র আমার

 

জন্মমৃত্যু

মৃত্যুর মতো কালো কয়লাও নয়।
মৃত্যুর মতো সাদা কিছু নেই, বকপাখিটিও নয়।
এভাবে চলেছি, ফুল দেখে দুল দেখে। তোমাকে ফুটিয়েছি লাল।
আমাকেও কতো হলুদে ফোটালে-।

দেখ তবু, মৃত্যুর মতো কেউ আহত করে না।
তুমি শুধু ঝিলমিল রোদের মতো, ভেজা ভেজা রামধনুর মতো
শরীরে ছড়িয়ে দিলে চাঁপার সুবাস

মৃতদেহে একবার ফিরে এসেছিলো পাখি। আর কিছু মনে নেই-
কীভাবে জন্ম হলো, কীভাবে প্রেম এসে খুলে দিলো মৃত্যুর প্যান্টশার্ট –
কিছু মনে নেই।

কোথাও মধুমাস –
দারুণ চলছে প্রেম। সবুজ ধানের দুধ গাঢ় হয়ে সন্ধ্যা নামে কোথাও
মিছরির মতো মিঠা তোমার তাকানো —
এটুকুই বেঁচে থাকা;
কৃষকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কৃষক হয়ে ওঠা এবং
বৃষ্টির দিনে অবশ্যই ধান বুনতে বুনতে মরে যাওয়া–

এটুকুই রঙিন ;
এটুকুই জন্মানো…

৬টা৩০ সকাল ২৩০৫২০২২

 

ফুটবলমাঠ

 

ছেলেটির বয়স আমার মতন, নদী ও পাথরের মতন বয়েস।

ছোটো বেলায় ক্লাস ফাইভের মেয়েটিকে, নিমকাঠির আংটি দিয়েছিলো
সীতা চুরি খেলার সময়, বেছে ঠিক তাকেই আনত চুরি করে

ছেলেটিকে কৃষ্ণচূড়া ঘিরে থাকে

আর একটি সুবর্ণরেখা নদী
আর একটি বকুল ফুলের দেহ

ছেলেটিকে ঘিরে থাকে চাঁদ আর সূর্য এবং নক্ষত্রমন্ডল
এবং ছায়াপথ
এবং মহাবিশ্ব
এবং সময়ের ডানা

ভাইটিকে বলেছি, মাঠভর্তি মানুষ
তুমি গোল দিও না
ফুটবলটি ছুটুক পায়ে পায়ে, হৃদয়ে বসন্তে
চুম্বনে কৃষিকাজে
ফুটবলটি ছুটুক-

মাঠভর্তি মানুষ, তুমি গোল দিও না।

©অনিমেষ সিংহ
মে,২০২২

২০২১

দুটো চড়ুইপাখি ফুড়ুৎ করে উড়তে গিয়ে
গান হয়ে গেল!
তার বুকের দিকে চলে গেল শিয়ালদা স্টেশন,
আমি সেই শহর ছেড়েছি, শূন্য হব বলে।

মহেঞ্জোদারো যাওয়া হলো না!
নতুনকরে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো তার আগে–

রাষ্ট্রের সাথে আমাদের
পুঁজির সাথে আমাদের
মাফিয়ার সাথে সাধারণ মানুষের।

জয়িতা এসেছে,
হিন্দুমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে তার।
বুকে, লালপদ্ম দুটি।
চোখে, কমলার ঝিল।

জয়িতার বর বিটকয়েন রাখে মুঠোতে।

আমার এতেও কিচ্ছুটি যায়-আসে না।

সুগারকিউবে পিঁপড়েটির মতো, উষ্ণ-তরলে ডুবে গেছেন হরেনমাস্টার!
তাঁর ধুতি ছিঁড়ে চাকার দাগ মোছে মর্গের খালাসি

আমার তাতে কী!

গান্ধীজির পাশে জোনাকি জ্বেলেছে কয়েকজন
আমি তার স্তব্ধ পায়ের নীচে বসে থাকি

রাস্তাগুলো বন্য শুয়োরের মতো গোঁতা মারে ;
গঙ্গানদীর দিকে সরে যাব ভাবি-
অথচ, শুয়োরগুলো রাস্তা কিনে নিলো-

 

ভাড়াটে খুনি

সুদীর্ঘ চুম্বনের পরে,
খুন করার ইচ্ছেটা মরে যায়!
পাখির পালকে জড়িয়ে রাঙা ভোর নামে,
রক্তের মতো লাল হয়ে থাকে সভ্যতা।

খুন করার ইচ্ছেটা মরে যায়।

পালঙ্কে এলানো দেহ, ভরাট স্তন
ঠিক যেন, লালপদ্ম দুখানি, প্রস্ফুটিত হবে খুব সকালে।
চিবুকে ছোট্ট একটি তিল, নিঃসঙ্গ বুলবুলি পাখি।
ঠোঁট দুটো গোলাপি শঙ্খচিল।

–এমন সুন্দর
মরে যেতে ইচ্ছে করে তার বুকের বিভঙ্গে,
নাভির প্রদীপে—।
প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর মতো,
তার মতোই মুহূর্ত সকল।

খুন করার ইচ্ছেটা মরে যায়।

অস্ত্রখানি ফেলে আসি ঊরুসন্ধিতে তার,
কখনো গোলাপ হয়ে ফুটবে–
রক্তের মতো লাল…

 

বালিঘড়ি

রাতের কাছে নিস্তব্ধ প্রহর
বালিয়াড়ি জুড়ে লণ্ঠনের রমরমা
চুপিচুপি কারা যেন নদী শুষে খায়

সকালে সারা গাঁয়
বালি ওড়ে এবং
শ্রীমতীর সিঁথি ঢেকে যায়

দুপুরে ছেলে ও মেয়েরা মরুভূমি টপকে ফেরে স্কুল থেকে ঘরে
ক্লান্ত সাঁঝের গর্তে চলে যেতে যেতে
মা’কে বলে–

“এদিকে রূপকথার গল্প নেই কেন!
কেন এদিকে মানুষেরা ধনুকের মতো হাঁটে?
কেন, বাবার গলায় বাঁধা ফেট্টিতে
তিনরঙ ফিকে হয়ে আসে?”

মা, আঁচলে মুখ ঢেকে সেতুটার মতো,
সর্বাঙ্গ বিছিয়ে রাখেন

যারা ওপারে যেতে চায়
তারা যেন ভোরেই আগেই যেতে পারে–

 

রত্না

প্রেমের মতো নরম করে আয়-

কাকপক্ষীর সাথে এ সংসার,
ঈশ্বর শুয়ে থাকে বইয়ের তাকে
এমনকি জংধরা সাইকেলটায়!
প্রেমের মতো স্বাধীনতা চেয়েছিলাম,
পস্কো থাকত না শিল্পীর জন্য এখানে–।
কবে আসবি! গুলমোহরের সব ফুল ঝরে গেলে
নার্সিংহোম তুলে নেবে এ দেহ,
তিনমাত্রার ঢেউ এসে টেনে নিয়ে যাবে বর্ষাভেজা কালো রাস্তায়–

বন্দুকের গুলির মতো বাচ্চারা আজকাল ;
ডুবন্ত জাহাজ খোঁজে তোর শরীরে,
শরীরে তোর খোঁজে, ছুটি কাটানোর মন্দারমনি!

নৌকার রোমান্টিসিজম বোঝে না।
ছইভর্তি সুখ, তুই আসবি কবে! ল্যাম্পপোস্ট ভিজে গেছে বর্ষায়
তরল আলোর প্রভা ছড়িয়ে পড়ছে বেগনবেলিয়া গাছে,
সুবর্ণরেখা থেকে ভেসে আসছে শীতকাল–
গৃহস্থের জানালাটা জমকালো বেশ,
ফুটপাত নীল।
প্রেমের মতো রিকশা ধরে আয়।

হলুদ শাড়ির পাড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো দুলিয়ে
কবে আসবি –
জাহান্নামে প্রদীপ জ্বালাতে!

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *