স ন ৎ কু মা র ব ট ব্যা ল-র জীবনীচর্চায়
যে জন থাকে প্রানের মাঝে
আজ ভারতবর্ষের এক কৃতি সন্তানের কথা আপনাদের বলব। যিনি শুধুমাত্র একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন এমনটা নয়।তিনি ছিলেন উদারমনস্ক, শিক্ষাবিদ,ভারতবর্ষে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের পথিকৃত বা ভগীরথ বললে অত্যুক্তি হবে না ।
শ্রী,সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
ভূমি স্পর্শঃ-৫ ই জুন, ১৮৬৫ সাল,
গ্রাম- বাণীপুর ,
জেলা-হুগলি,
ব্রিটিশ ভারত
অমৃতলোকে যাত্রাঃ- ১৮ ই এপ্রিল(মতান্তরে ১৯ শে এপ্রিল) ১৯৪৮ সাল, বারানসী, উত্তর প্রদেশ, ভারত।
বাবা- কৃষ্ণনাথ মুখোপাধ্যায়।
স্ত্রী-চারুলতা মুখোপাধ্যায়।
ছেলে- সুব্রত মুখোপাধ্যায় ।
মেয়ে- রেণুকা রায় ।
তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার
প্রসারে অগ্রণী সৈনিক। সতীশচন্দ্র ভারতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ ছিলেন। তৎকালীন সময়ে বাংলা দেশের বিদ্বজ্জনেরা একথা একবাক্যে
স্বীকার করেন।
সতীশচন্দ্রের জন্ম হুগলী জেলার বানীপুরে। পরবর্তীতে কলকাতার ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বান স্কুলের তিনি ছাত্র ছিলেন। সতীশচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। অশ্বিনীকুমার দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (তাঁর সহপাঠী), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী অরবিন্দ, রাজা সুবোধ মল্লিক, নরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দ(তাঁর সহপাঠী), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ)এর মত মানুষদের সাথে তাঁর ওঠাবসা ছিল। তিনি পণ্ডিত শশধর তর্ক চূড়ামণির “ষট-দর্শন” (“হিন্দু দর্শনের ছয়টি বিদ্যালয়”) শীর্ষক বক্তৃতা শুনতে অ্যালবার্ট হলে উপস্থিত ছিলেন। এই সভার সভাপতিত্ব করেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মীয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এবং অন্যান্য সমস্ত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতার সাথে বাঁচুন”। সতীশচন্দ্র তীব্র ধর্মীয় স্বভাবের হিন্দু জীবন, চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসের উপর জোর দিয়েছিলেন।
তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে-ভর্তি হয়ে ১৮৮৬ সালে এমএ পাশ করেন। এবং ১৮৯০ সালে বি.এল. ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি নিজের নাম কলকাতা হাইকোর্টে উকিল হিসাবে নথিভুক্ত করান। ১৮৮৭ সালে তিনি বহরমপুর কলেজের ইতিহাস ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮৯৫ সালে তিনি উচ্চতর পড়াশোনার বিকল্প পদ্ধতির প্রথম প্রচেষ্টায় ভাগবত চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সতীশচন্দ্রের বাবা কৃষ্ণনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্রের শৈশবের বন্ধু এবং সহপাঠী। মিত্র তাঁকে কলকাতা উচ্চ আদালতে সরকারী নথির অনুবাদক হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। মিত্র প্রত্যক্ষবাদী মানবতা ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। তিনি কঁৎ দর্শনে বিশ্বাসী, মানুষ এবং সমাজের সেবক ছিলেন ।
নাস্তিক কৃষ্ণনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর দুই ছেলে , তিনকড়ি ও সতীশের মনে ও এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে কঁৎ এবং তাঁর দর্শন নিয়ে ভারতের মধ্যে প্রথম লিখেছেন তাই নয়, যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ এবং রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবল উদ্দীপনাপূর্ণ প্রত্যক্ষবাদী বন্ধুও তাঁর ছিল। ১৮৭৪ সালে, বঙ্কিম তাঁর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রত্যক্ষবাদ সম্পর্কিত শেষোক্ত জনের প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। এটি শুরু হয়েছিল এই ভাবে, “আমাদের দেশে সত্যিকারের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে কঁতের দর্শন নিয়ে প্রচুর চেতনা রয়েছে।” মনস্তাত্ত্বিক পরিশোধন নিয়ে লেখার সময় বঙ্কিম লিখেছিলেন– “যিনি মনস্তাত্ত্বিক ভাবে শুদ্ধ হয়েছেন তিনি হলেন সেরা হিন্দু, সেরা খ্রিস্টান, সেরা বৌদ্ধ, সেরা মুসলিম, সেরা প্রত্যক্ষবাদী।”
১৮৮৪ সালে, তাঁর দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের উপস্থাপনায়, বঙ্কিম ইতিবাচক ধর্মের প্রশ্নোত্তর থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন– “মানুষের অগ্রগতির সাধারণ আইন (…) এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যে মানুষ আরও বেশি ধর্মীয় হয়।”
সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় শুধুমাত্র একজন জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন না। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীশচন্দ্রের সহপাঠী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিবনাথ শাস্ত্রী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি তাঁদের দ্বারা বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শিক্ষাবিষয়ক আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্তস্বরূপ সতীশচন্দ্র ডন সোসাইটি(১৯০২) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সম্পাদক হন। এটি ছিল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে সৃষ্ট একটি অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। বঙ্গীয় ছাত্র যুবকদের আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ, তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষার বিকাশ ঘটানো, মানসিক শক্তিবৃদ্ধি ও চরিত্রগঠনই ছিল এর উদ্দেশ্য। এছাড়া জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও দেশপ্রেমের উদ্বোধন এবং হাতে-কলমে কারিগরি শিক্ষা ও স্বদেশী শিল্পের সার্বিক উন্নয়নও এ প্রতিষ্ঠানের আদর্শ বলে পরিগণিত হতো। শিক্ষাবিষয়ে স্বাদেশিকতা প্রবর্তনে ডন সোসাইটির দান অপরিসীম। ১৯০৫ সালের ৫ নভেম্বর সোসাইটির আহবানে জাতীয় শিক্ষা উদ্বোধনের জন্য এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। বিপুল জনসমাবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং হীরেন্দ্রনাথ দত্ত সে সভায় বক্তব্য রাখেন। সতীশচন্দ্র ছাত্রদের প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ ও সেখানকার পরীক্ষা বর্জনের আহবান জানান।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদ(NCE, ১৯০৬) প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রভূত অবদান রাখেন। এর অধীনে Bengal National College স্থাপিত হলে, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং সতীশচন্দ্র হন তত্ত্বাবধায়ক। ১৯০৭ সালে অরবিন্দ পদত্যাগ করলে সতীশচন্দ্র অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরের বছরই পদত্যাগ করেন।
১৯০৫ সালের ১০ অক্টোবর জারিকৃত ‘কারলাইল সার্কুলার’ (Carlyle Circular)-এর বিরুদ্ধেও সতীশচন্দ্র প্রতিবাদ করেন। স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত ও সফলতায় সতীশচন্দ্রের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করেন।
র১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই স্বদেশী শিল্পায়নের জাগরণে ডন সোসাইটি বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে। এ সময় সতীশচন্দ্রের সম্পাদনায় মাসিক ‘ডন’ (১৮৯৭) জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ও প্রচারে বিশেষ সুনাম অর্জন করে। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষিত যুবকরা এ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন এবং নানা স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। ডন পত্রিকা ছিল তাঁদের মুখপত্র, যা শিক্ষাক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রাখে। সতীশচন্দ্র ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এটি সম্পাদনা করেন। ‘বন্দে মাতরম্’ নামক দৈনিক ইংরেজি পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন (১৯২২) তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এ আন্দোলনে গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি সবরমতীতে যান এবং কিছুদিন Young India পত্রিকা প্রকাশে সহায়তা করেন। ১৯৩০ সালে তিনি রাজেন্দ্রপ্রসাদের বিহার বিদ্যাপীঠ পরিদর্শন করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। সতীশচন্দ্র ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ সাধু পুরুষ। তবে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণপ্রথা এবং প্রাদেশিকতার বিরোধী ছিলেন। শিক্ষাবিস্তার ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ব্রতী। সময়োপযোগী উপযুক্ত মানুষ তৈরি করার জন্যই তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৮ই এপ্রিল/( মনান্তর ১৯ শে এপ্রিল) কাশীতে তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করেন। আজ এই মহামানবের জন্মদিন ।যাঁর
সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গেছে ।কেউ মনে রাখেনি ।কিন্তু এই মহামানবের কীর্তি ভোলার নয়। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন।ভারতে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর যে অবদান, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আজকে যাঁরা নিজেদের স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বলে গর্বিত হন,যে মানুষটি তাঁর নিজের জীবনকে
এই কাজে সঁপে দিয়ে ছিলেন, তাঁকে একবার স্মরণ করবেন না? তবুও স্মৃতির স্মরণী ধূলায় ধূসর ।
আসুন আজকে এই মহামানবের শুভ জন্মদিনে আমরা নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানাই, আভূমি প্রনাম জানাই। সতীশচন্দ্রের মৃত্যু নেই ।তিনি আমাদের হৃদয়ের গভীরে মৃত্যুঞ্জয়।
তথ্যসূত্র ও অনুলিখন-– বন্ধুবর হিমাদ্রি বর্মন
(সৌজন্যে : বাংলাপিডিয়া)