স্বপ্নধারার পর্বকথা(৬ষ্ঠপর্ব)
কলমেঃ শু ক্তি চ ট্টো পা ধ্যা য়
ছবিঃ সু নি পা ব্যা না র্জি
ধরুন, স্বপ্নে দেখলেন, অচেনা বা খুব চেনা কোন জায়গায় আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। কোন প্রয়োজনীয় জিনিস অথবা কাউকে হারিয়ে ফেলে আপনি তাকে প্রাণপণে খুঁজে চলেছেন। উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজছেন, কিন্তু সেই মানুষ বা জিনিসটা যেন আপনার কাছে খুব স্পষ্ট নয়, আবছা বা ছায়া-ছায়া অথবা ধারনাটাই হয়তো অস্পষ্ট, আর তা ধরাও দিচ্ছে না। কিন্তু আপনি খুঁজছেন। সেই স্বপ্নটা অনেক সময়ই পরিণতি পায় না। তখন কিন্তু সেটা বেশ অস্বস্তিকর হয়। আপনাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই এরকম নিশ্চয়ই হয়েছে, তাই না? আসলে, আপনার অবচেতন মন আপনাকে জানিয়ে দিতে চায় যে, আপনার জীবন থেকে হয়তো কোন মানুষ বা বস্তু(যা আপনার অত্যন্ত কাছের) হারিয়ে গেছে, বা অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে চলেছে। তাই মনোবিদরা বলেন, এই অবস্থায় হতাশ না হয়ে নতুন পথের দিশা খুঁজে, সেই দিকে পাড়ি দিতে।
আপনি ভাবছেন মেয়েটা এসেই আবার এরকম depressing কিছু ঘটনা বলতে শুরু করে দিল… কি করব বলুন? আমাদের জীবনে আনন্দের সাথে সাথে মানসিক অবসাদ, হতাশা, দুঃখ বা ভয় এগুলোও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী। মাঝে মাঝে ওরাই আমাদের চলার পথের বন্ধু, আবার কখন কখনও ওই বিষাদপূর্ণ আবেগগুলোই আমাদের চলার শক্তি যোগায়। যাক গে, তা যেটা বলছিলাম। এই রকম স্বপ্নের কথা শুনে মন খারাপ করবেন না। স্বপ্ন depressing হলেও, এই পর্বটা কিন্তু একটু অন্যরকম।
স্বপ্নে কখনও উড়েছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওড়া। না না ভুল বকছি না। বলুন না, স্বপ্নে কখনও উড়েছেন? হ্যাঁ, যদি উড়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে, আপনি কিন্তু বেশ মুক্তমনা ও স্বাধীন। আমি জানি, আপনি ভাবছেন, মেয়েটার মাথাটা একদম গেছে, তাই ভুল বকছে। আরে মশাই, তা না… আমি যেটা বললাম, সেটা ভ্রান্তি নয়। একটু বুঝিয়ে বলি, তাহলেই বুঝতে আর অসুবিধে হবে না। আসলে অনেক মানুষই কিন্তু ওড়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রথমবার ভয় লাগলেও প্রথম পদক্ষেপের পরই সেই ভয় তিনি কাটিয়ে ওঠেন। স্বপ্নের মধ্যেই সেই মানুষ একটি অজানা অনুভুতি অনুভব করেন। যেটি বলাইবাহুল্য আনন্দের এক অনুভুতি। স্বাধীনতার অনুভূতি এক আলাদাই অনুভূতি। এই স্বপ্নটা কিন্তু একদমই depressing নয়। জীবনে কোন খারাপলাগা, অসম অনুভূতি বা baggage থাকে, তাহলে তার থেকে মুক্তির সন্ধানই এই ধরনের স্বপ্নের অর্থ। কারণ, উড়ান তো শুধু প্লেনে বসে ওড়াই নয়। ভুললে চলবে না কিন্তু, বাস্তবে স্বপ্নের উড়ানও কিন্তু এরই মধ্যে পরে।
স্বপ্ন নিয়ে পুরাণের বেশ কিছু কাহিনী তো বলেছি আপনাদের, তাই আজ একটু স্বাদ বদল করা যাক। আপনাদের আগেই বলেছি এমন অনেকক্ষেত্রেই হয়, কোন বর্তমান ঘটনা, যা আমরা আগে দেখেছি বলে মনে হয়, সেটি স্বপ্নে দেখা কোন ঘটনা। এটিকে Déjà vu (দেজা ভূ) বলে। দেজা ভূ একটি ফরাসি শব্দ, যার অর্থ হল, “already seen” বা “পূর্ব দর্শিত ঘটনা”। অনেকে আবার এ’কে paranormal context-এ ব্যবহার করেন। তবে, অনেক মনোবিদের মতে এটি স্মৃতির অসামঞ্জস্য। যদিও, পূর্বে ঘটে যাওয়া স্মৃতির প্রবল প্রভাব পড়ে, যেমন, পূর্বে দেখা কোন স্থান, ঘটনা বা মানুষের সাথে পরিচয় বা তাকে ঘিরে ঘটা কিছু ঘটনা। এগুলোই অবচেতনে যা প্রভাব ফেলে স্বপ্ন দেখায়। তবে অনেকক্ষেত্রেই তা অবিশ্বাস্য হয়। এই ‘দেজা ভূ’ দু’ধরনের হয়, ১. Pathololgical Déjà vu, ২. Non-pathological Déjà vu. বিশেষত epilsepsy (মৃগীরোগী)-র রোগীদের স্নায়বিক সমস্যার কারণে এই ধরনের কিছু স্বপ্ন আসে। তবে, শুধু তাদেরই নয়, সাধারণ, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষদেরও(দুই-তৃতীয়াংশ) déjà vu হয়, যা non-pathological déjà vu নামে পরিচিত। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানেন? Survey করে দেখা গেছে, যে সব মানুষ সাধারণের তুলনায় দেশ-বিদেশে বা নতুন নতুন জায়গায় ঘোরেন বেশি অথবা যাঁরা film তুলনামুলকভাবে বেশি দেখেন, তাঁরা déjà vu বেশি experience করেন। Split perception তত্ত্ব অনুযায়ী দেজা-ভূ ঘটে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। প্রথমবার যখন আপনি অপ্রচলিত কিছু দেখেন, তখন এক অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি হয়। যা অনেকক্ষেত্রেই মানুষ আমল দেয় না। আসলে, আমরা যা দেখি, তাঁর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিসও আমাদের স্মৃতিতে থেকে যায় আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি স্মৃতি আমাদের মাথায় জমা হয়, যা রোমন্থনের মাধ্যমে এই ধরনের স্বপ্ন আসে। যা অনেক সময়ই এতো বেশি বাস্তব হয় যে, তা আমাদের মনে সাময়িক অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
আপনাদের আগেই বলেছি prophetic dream-এর কথা। সেখানেও কিন্তু চেনা জায়গার স্বপ্নের কথাই বলা হয়েছে। এবার আজ এই ‘দেজা ভূ’-র কথা শুনে থুড়ি, পরে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে, prophetic dream আর déjà vu কি একই নাকি আলাদা? আসুন, আপনাদের এই কৌতূহলের নিরসন করি। আসলে, দু’ধরনের স্বপ্নই খানিকটা এক, কিন্তু একটা সূক্ষ পার্থক্য থেকেই যায়। ‘দেজা ভূ’ হল, স্বপ্নে দেখা অতীত সংক্রান্ত কিছু ঘটনা, যা মানুষের মনে প্রভাব ফেলে। এই স্বপ্ন যিনি দেখেন, তাঁর কাছে ঘটনাগুলো এতটাই বাস্তবিক, যে সেটা যে স্বপ্ন সেটা তাঁর পক্ষে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হয়।
ঠিক সেভাবেই ‘প্রোফেটিক ড্রিম’-ও সেই স্বপ্ন, যে স্বপ্ন দেখার পর মানুষের মনে হয়, “আরে! ঠিক এই ঘটনাটাই, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম না?” অর্থাৎ, বুঝতেই পারছেন, এটি ভবিষ্যৎ দেখায়। ‘প্রোফেটিক ড্রিম’ মানুষকে ভবিষ্যতের কোন ঘটনা দেখায়। হয়তো স্বপ্নে আপনি এমন কিছু দেখলেন যার সম্মুখীন আপনাকে ভবিষ্যতে হতে হল, সেই স্বপ্নই হল ‘প্রফেটিক ড্রিম’। যদিও ‘দেজা ভূ’ আর ‘প্রোফেটিক ড্রিম’ দেখলে মানুষের অনুভূতি প্রায় একই রকম হয়, তবুও এই স্বপ্নগুলোর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ঠ্য ও তাদের পার্থক্যের কারণে, মনের অবস্থার কিছু পরিবর্তন দেখা যায়।
এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গ্রীক পুরাণের গল্প বলি আপনাদের। ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম এবং রানী হেকুবা’র সন্তান ক্যাসেন্ড্রা(Cassandra)। ক্যাসেন্ড্রা ছিলেন সুন্দরী ও অ্যাপোলোর উপাসক। এই ক্যাসেন্ড্রাকে একবার গ্রীক দেবতা অ্যাপোলো একটি বর(আশীর্বাদ) দেন। সেই বরে ক্যাসেন্ড্রা ভবিষ্যতদ্রষ্টা হবেন এবং দেবতার বরে হয়ও তাই। কিন্তু একসময় অ্যাপোলো ক্যাসেন্ড্রাকে প্রলুব্ধ করে তাঁর সতীত্বহানির চেষ্টা করেন। কিন্তু ক্যাসেন্ড্রা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে, অ্যাপোলো ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে অভিশাপ দেন, ট্রয়ের কোন মানুষই তাঁর ভবিষ্যৎবাণী বিশ্বাস করবে না। পাশ্চাত্য সভ্যতায় তাই আজও কেউ কোন ভবিষ্যৎবাণী করলে বা ওইরূপ কথা বললে, যদি তার কথা মিলেও যায়, তবুও তাকে ক্যাসেন্ড্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাহলেই বন্ধুরা দেখুন, পুরাণের ঘটনা বাস্তবের সাথে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে আছে যে, তাকে চেষ্টা করেও আলাদা করা যায় না। আর গল্প শুনতে আশা করি আপনাদেরও ভালই লাগে। তবে, আজকের পর্ব এখানেই শেষ করতে হবে। পরের পর্বে আবার নিয়ে আসব আরও কোন নতুন ধরনের বিষয়। আসলে স্বপ্ন যে যুগ-যুগান্তের ঘটনা, এ যে আদি-অন্তহীন…
আগের পর্বগুলো পড়তে অবশ্যই ক্লিক করুনঃ
স্বপ্নধারার পর্বকথা(৩-য় পর্ব) কলমেঃ শু ক্তি চ ট্টো পা ধ্যা য়
স্বপ্নধারার পর্বকথা(৪র্থ পর্ব) কলমেঃ শু ক্তি চ ট্টো পা ধ্যা য়