বিশ্বমিথের দরবারঃ(পর্ব তিন) কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

 

স্লাভিক মিথলজি(পর্ব তিন)

কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

ছবিঃ সু নি পা   ব্যা না র্জী 

মোরোনা

আগেরবার বলেই ছিলাম এই পর্ব থেকে শুরু করব বিশ্বমিথে বিশ্বভ্রমণ। কোন সভ্যতার কথা দিয়ে শুরু করব ভাবতে ভাবতে প্রথমেই মনে হলো সেই দেশের কথা, যে দেশের গল্পগুলো আমার মতো অনেকেরই শৈশবের সাথী ছিল। আন্দাজ করতে পারছেন কি? রাজপুত্র ইভানের দেশ, জাদুকরী ভাসিলিসার অঞ্চল; ওই যে যে সভ্যতায় লুকিয়ে আছে ডাইনি বাবা ইয়াগার কথা। লোককথার অন্তরালেও পুরাণকথা জেগে থাকে। আজ সেই স্লাভিক সভ্যতার মিথলজি নিয়ে শুরু করছি। একটা পর্বে তো কুলোবে না আর গল্প করেও মন ভরবে না, তাই পর পর কতগুলো পর্ব জুড়ে রুশ ও বল্কান সভ্যতার পুরাণ নিয়ে আলোচনা করে অন্য দেশে ঢুকব। এবারের পর্বে স্লাভিক দেব দেবীদের কথা বলি। কেমন?

এই স্লাভ সম্প্রদায় হলো ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষ যারা অধুনা রাশিয়া, বেলরাস, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাব্লিক, ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো, পোল্যান্ড, স্লভাকিয়া, স্লভেনিয়া, ইউক্রেইন – মোট এই তেরোটি দেশ নিয়ে স্লাভিক সভ্যতার বিস্তার। ভৌগলিক অবস্থানের জন্য এটি শীতপ্রধান। খ্রিষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের আগে, মানে খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের আগে এই অঞ্চল ছিল ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান উপজাতিদের বাস, এবং তারা ছিলেন প্রকৃতির উপাসক।

স্লাভিক পুরাণকথা অনুযায়ী পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে তিনটি ধারণা পাওয়া যায় –
প্রথমটির মতে, পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে গভীর জলরাশির থেকে।

দ্বিতীয়টি অনুযায়ী, হিন্দু পুরাণের মতো ব্রহ্মাণ্ড থেকে এক মহাবৃক্ষের উৎপত্তি যেটির মূল সমুদ্রের তলদেশে এবং ডাল-পালা আকাশচুম্বি যার থেকে প্রাণের উদ্ভব।

তৃতীয় মতানুসারে, সর্বশক্তিমান ঐশ্বরিক শক্তি দুর্বিনীত দেবতাদের বহিষ্কার করার ফলে তাদের দ্বারাই জগতের সৃষ্টি।
এই মতটি তুলনামূলকভাবে নতুন এবং খেয়াল করলে দেখা যায় যে এই মতের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট।

তবে স্লাভিক সৃষ্টিতত্ত্ব ও অন্যান্য মোটিফ নিয়ে আরও অনেক কিছু মজার কথা বলব আরও দুটি পর্বের পরে। কারণ তত্ত্বকথার জানার আগে শুভশক্তি ও অশুভশক্তির সাথে পরিচয় হয়ে গেলে আলোচনার সুবিধা হবে।

এবার বরং দেব – দেবীদের কথায় আসি। দেবতাদের দেইভস (Deiwos) বলে সম্মোধন করা হয়েছে প্রাচীন প্রায় হারিয়ে যাওয়া পুঁথিগুলিতে, যার অর্থ হলো আকাশসম্পর্কিত ও দৈবিক। শব্দটির সাথে ভারতের ‘দেব’ -এর কতো মিল, তাই না? আসলে ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই শব্দের প্রচলন ছিল তাই, গ্রীক, রোমান, স্লাভিক, কেল্টিক প্রভৃতি সভ্যতাতেই এই শব্দের প্রভাব আছে। তা যাই হোক এবার আসি গুরুত্বপূর্ণ স্লাভিক দেবতাদের কথায়।

স্লাভিক দেবতারাঃ
দজবগ

রড হলেন স্লাভদের সৃষ্টির দেবতা। ইনি দেবতাদের আদি পিতা। সৃষ্টির দেবতা বলেই বোধহয় এনার প্রতীক হলো ছয়টি পাপড়ির ষড়ভূজ।

পেরুন হলো বজ্র বিদ্যুতের দেবতা। তার অস্ত্র হিসেবে দেখা যায় নয় হাতুড়ি না হয় কুঠার। ইনি সর্বোচ্চ দেবতা বলেই প্রাচীন স্লাভরা বিশ্বাস করত। তার প্রতীক হিসেবে আঁকা হতো ওক গাছের মগডালে এক ঈগল পাখী। পেরুনের সাথে নয় সংখ্যার একটা যোগ আছে যা তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে।

স্ভারোগ বলে একজন দেবতার কথা পাওয়া যায় যার ব্যাপারে কিছু সংশয় আছে। কিছু মত অনুসারে ইনি অগ্নির দেবতা, কেউ কেউ বলেন ইনি সূর্যের প্রাচীনতম রূপ বা প্রোটো-সূর্য। মিথ অনুসারে, ইনি নাকি মহাজাগতিক নিদ্রায় মগ্ন, এবং যেদিন ইনি জেগে উঠবেন সেদিনই পৃথিবী ধ্বংস হবে বলেই বিশ্বাস।

দাজবগ ছিলেন স্লাভদের সূর্যের দেবতা। এই নামটির অর্থ হলো ‘দাতা’। সূর্যের কাছে মানব সভ্যতা সবসময়েই ঋণী। তাই সূর্যের দেবতাকে দানশীল কল্পনা করার কারণ সম্ভবত স্থানটি শীতপ্রধান অঞ্চল বলে। অগ্নিদেবতা স্ভারোগ ছিলেন তার পিতা। সূর্য দেবতাকে স্লাভ সম্প্রদায় পৃথিবীর রাজা মনে করতেন।

স্ট্রিবগ হলেন স্লাভদের পবন দেবতা। স্ট্রি শব্দের অর্থ হলো বহমানতা। ইনি একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড ও পূর্ব স্লাভ অঞ্চলের মানুষরা স্ট্রিবগকে পুজো করতেন।

ভেলেস বা ভোলোস ছিলেন স্লাভদের গবাদিপশুর দেবতা। তবে পরবর্তীকালে পশু-পাখির দেবতা হিসেবে ও সেই সুত্রে বন্যতা ও মৃতলোকের দেবতা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এনার ক্ষমতা অসীম। ইনি সুর, রহস্য, মৃতজগৎ, সম্পদ, ফলন, পশু-পাখির দেবতা। কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ ভেলেসকে অতিকায় ও বিষধর নাগের মতো ভাবতেন। ইনি দেবতা হলেও স্লাভদের মধ্যে পেরুন ও ভেলেসের দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী আছে। একজন আকাশের দেবতা ও অপরজন মৃতলোকের দেবতা বলে পরিচিত তাই প্রতীকদুটিও এমন বিপ্রতীপ।

ত্রিগ্লাভ হলেন তিন মাথাওয়ালা এক দেবতা যিনি একই সাথে সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের প্রতীক। তার তিন মাথা আকাশ, পৃথিবী ও পাতালের প্রতীক। তাকে কল্পনা করা হতো চোখের উপর কাপড়ের পট্টি বাঁধা অবস্থায় যা ইঙ্গিত দেয় তার পক্ষপাতহীনতার। এমনও বিশ্বাস করা হয় যে তিনি পেরুন, স্ভারোগ ও দাজভগের একত্রিত রূপ।

স্ভেতোভিদ ছিলেন স্লাভদের যুদ্ধের দেবতা। তার সাথে তিনি উর্বরতা ও সম্পদের দেবতা হিসেবেও পরিগণিত হতো। এনাকে চতুর্মুখী দেবতা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এই চারটির দুটি মুখ নারীর মতো দুটি পুরুষের মতো। আমাদের অর্ধনারীশ্বরের সাথে বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়।

সার্নোবগ ছিলেন স্লাভদের অন্ধকার, শৈত্য, অশুভশক্তি, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবতা। নাগ, বিষধর সরীসৃপ, প্রাণঘাতী প্রাণীদের দেবতা ইনি। পৃথিবীতে যেমন ভালো কিছু বর্তমান তেমনি খারাপেরও অস্তিত্ব আছে, ইনি সে সমস্ত খারাপের দেবতা বলে স্লাভ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস।

স্লাভিক দেবীরাঃ
দেবী-লাদা

লাদা হলেন স্লাভদের সুখ-শান্তি, গৃহস্থালি, প্রেম ও রূপের দেবী। তিনি মিলন, মিত্রতার প্রতীক। গ্রীকদের প্রসারপাইনের সাথে এর অদ্ভুত একটা মিল আছে। প্রসারপাইন যেমন মৃতলোক থেকে পৃথিবীতে এলে তার মা দিমেতরের ইচ্ছায় বসন্তকাল আসে, তেমনি স্লাভরা বিশ্বাস করে লাদা তার মৃতলোকের বাস ছেড়ে পৃথিবীতে এলেই বসন্ত আসে।

লেইলা বসন্তকাল, পবিত্রতা ও কৈশোরের প্রতীক। লাদার কন্যা তিনি। মেয়ে ও মায়ের মধ্যে কাহিনী অনুসারে গভীর বন্ধন তাই একে অপরের সাথে মিলে মিশে যায় লৌকিক বিশ্বাসে। লেইলাকে সুন্দরী কিশোরী রূপে কল্পনা করা হত। তিনি মুক্ত প্রকৃতির বুকেই থাকেন। বার্চগাছ দেবী লেইলার প্রতীক।

মোরানা বা মার্জানা হলেন স্লাভদের শুষ্কতা, কাল, এবং মৃত্যুর দেবী। তিনি দেবী লাদার কন্যা। মোরেনা, মারা প্রভৃতি নামেও ইনি পরিচিত। অশুচিতা, অশুভ শক্তির দেবী তিনি। কখনও তাকে বৃদ্ধারূপে , কখনও বা লম্বা ও এলোমেলো চুলের কালো বস্ত্র পরা নারীরূপে কল্পনা করা হয়। এই দেবীর সাথে হিন্দুদের কালীর তান্ত্রিক রূপের সাদৃশ্য খুব বেশী।

দেবী কুপালনিৎসা হলেন স্লাভদের রাতের দেবী। ভলগা নদীর ধারে তার বাস। দেবতা সেমার্গাল তার সাথী। পুকুর, ঝিল, সরোবর প্রভৃতির অধিষ্ঠাত্রী। পুশ্কিনের লেখায় এনাকে রাজহংসী রূপে পাওয়া যায়। নিস্তব্ধ, স্নিগ্ধ, রাতে, শান্ত দীঘির জলে তারাভরা আকাশের ছবি যেন দেবী কুপলনিৎসার প্রাকৃতিক রূপ। তিনি একাকিত্বেরও প্রতীক, কারণ আগুনের দেবতার সাথে স্নিগ্ধ রাতের দেবীর মিলন অসম্ভব। প্রকৃতির নিরিখে একটু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভেবে দেখলেও, উত্তরটা কিন্তু একই।

দেবী মোকোশ ছিলেন স্লাভদের জন্ম, উর্বরাশক্তির দেবী। তিনি নারীশক্তির প্রতীক। গৃহস্থালির দেবী তিনি রন্ধন ও কুটিরশিল্পের অধিষ্ঠাত্রী। এই দেবীর হাতে আঁকা হতো শিশ্ন যা উর্বরতার প্রতীক। তিনি নারী ও পুরুষ উভয়েরই যৌনশক্তির রক্ষাকর্ত্রী।

দেবী জোরিয়া ছিলেন স্লাভদের শুকতারার দেবী। সকালে তিনি উষা, নাম জোরিয়া উৎরেনজাজা, সূর্য অস্তকালে তিনি সন্ধ্যা যার নাম জোরিয়া ভেচার্নজাজা। স্লাভিক বিশ্বাস ইনি রোজ সূর্যের সাথেই মারা যান এবং উদয়কালে জন্ম হয় তার।

সে কি, বিশ্বমিথে বিশ্ব ভ্রমণের প্রথম দিনেই এত্ত গল্প করে ফেললাম! এটাই ভাবছেন তো, যে পরের পর্বে আর কিই বা বলার থাকবে? না, নিশ্চিন্তে থাকুন এ কেবল কয়েকজন দেব-দেবীদের কথা মাত্র। আরও অনেক আছে। আর উপদেবতাদের কথা তো আছেই। অন্ধকার শক্তির খোঁজ কার না থাকে! আর তাছাড়া শুরু করেছিলাম যাকে নিয়ে সেই রুশ উপকথা-খ্যাত বাবা ইয়াগার কথাও বলা হয়নি এখনও। পরের পর্বে থাকবে স্লাভদের অপশক্তি ও উপদেবতাদের কথা, যাদের ভয় পেত তখনকার মানুষ। আজ আসি, আবার কথা হবে আগামী সোমবার।

★দেবলীনার আগের পর্ব-

বিশ্বমিথের দরবার– লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

বিশ্বমিথের দরবার(পর্ব-দুই)-লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জী

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *