পথের লেখা
লিখলেনঃ কৃষ্ণা মালিক(পাল)
গৃহিণী(এক)
শুধু রান্নাবাটি। আর ছুটন্ত ঘোড়া ,কিংবা ফুল- প্রজাপতি ঘরের এখানে ওখানে যেখানে যেমন মানায় ঘড়ির সঙ্গে টিক্ টিক্ করতে করতে। কঠিনপাচ্যের ইংরাজী ফেল।তার বদলে আসান বোনা, রিফু করা, কাঁথা সেলাই।কুরুশ কাঁটায় পুজোর থালার খুঞ্চিপোষও।… কাঁটায় কাঁটায় ঘনিয়ে আসে ঝড়ঝঞ্ঝা – চারপাশে জেগে থাকা বাঁকা নখ । উগলে আসা কালচে রঙা ডলি সুতোর কঠিন পাক – বাদলা দিনের আগুন – আর একলা হলে জ্যোৎস্নায় পোড়া তরকারির গন্ধ।-বুনতে বুনতে নিজেকে ছাড়িয়ে যায় নিজে।
থতমত সর্বদা। যেন শুকনো পাতা হাওয়ার টানে গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যে যাবে বোঝে না! মন – একটা ঝুপসিকোণা দোনামোনা মেঘ।ঝরবে, না কি ঢোঁক গিলে নেবে? কেউ যখন বকে দেয় , টেনে হাওয়ায় একটাও কথা ছুঁড়ে দিতে পারে না। তখনই কথা বলতে গেলে চোখ থেকে ঝরে পড়ে।
কেউ এগিয়ে দেয় নি যত্নের থালা। বরং সবার গ্রীষ্মদিন নিভিয়ে দিয়েছে তেলহলুদ লাগা আঁচলে।
এই আর কি! দুঃখসুখের পাঁচমিশেলি গেরস্তবাড়ির বড় বৌ ।তবু গৃহিণীরা কিছু বেশি খোঁজে। শুধু চেনে না ‘বেশি’টা কী?
অথচ তারও তো কিশোরীবেলা – ? রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছুটন্ত ধুলো, আর ফ্রকের কুঁচি খেলেছে হাওয়ার সঙ্গে?
এখন পানের তবক মোড়া দুপুরে খোলা চুলে পিঠ ঝাঁপানো রোদ। তবু নিজস্ব আছে কিছু গোপন বাক্সবন্দী।
একদিন মরচে রঙা সুর ভাসানো তোরঙ্গ খুলে পুরোনোর গন্ধ নিলো। বাক্স ভর্তি জল। জলের শয়ানে এক বুড়োর ছবি আর একটা পাথরের হার। ছবি তার বাবার। বুড়ো কোথায় নাকি খাঁচার দাঁড় কেটে চোখ ছানতে গিয়ে এনে দিয়েছিলো তাকে। পাথর থেকে গোলাপি রঙ ঠিকরোচ্ছে। তার আভা যত তার গালে লাগে ততই চোখ থেকে গঙ্গোত্রী গলতে থাকে।
ছবি হাতে নিয়ে সাত চড়ে রা না কাড়া ঠোঁট কুরুশ কাঁটায় কথা বুনতে থাকে একা একা।
সজল চোখের হাম্বারব(দুুই)
সকাল দরজা খোলার পর থেকে তারাদের রান্নাবাটি শুরু হওয়া পর্যন্ত। সদর দরজায় মাটির রোয়াকে বসে থাকে তো বসেই থাকে। আনা। সারাদিনে ওর সঙ্গে একবার দেখা হবেই।সবার সঙ্গে তার কথা,অবিরত মুখ দিয়ে লালের সঙ্গে ঝরে।ওর কথা না বুঝলেও হৃদয় বুঝি, তাই কিছুক্ষণ বলাটা অভ্যাস।
ঠোঁট ঠেলে বেরিয়ে পড়া উঁচু অপরিচ্ছন্ন দাঁতে অনাবিল হাসি।সদ্য গাইএর বাৎসল্যে চোখ হাম্বা ডাকে। সামনে দিয়ে যে কেউ যাক, তাকেই সে উপহার দেয় ওই হাসি আর কথা।
অন্যথা শুধু দেবুর বেলা। ওই রাস্তা তার নয়। ও রাস্তায় সে গরল ছড়ায়। ওই রাস্তায় দেবু জীয়ন্ত মানুষকে মরণ দিয়ে গাঁথে।
দেবু নিষ্ঠুরতা করে আনার সঙ্গে।–“আনু, ও আনু! তোমার বৌদির সঙ্গে একবার দেখা করে এসো। তোমাকে সে যেতে বলেছে।”
আনুর নরম চোখে কঠিন আগুন জ্বলে ওঠে।কুঁজো পিঠ তুলে বাঁকা বাঁকা হাতে ঢিল কুড়িয়ে আক্ষেপ আর অপমান ছুঁড়ে মারে।অবিশ্রান্ত চিৎকারে আর কান্নায় ছটফট করে।
দেবতার পিঁড়ি নড়ে যায়, দেবু না!সে তখন হাসির ব্যাপারি।
দেবু যেদিন বিয়ে করে ঠাকুরতলায় জোড়ে প্রণাম করতে এলো, সেদিন আনার অন্ধ নৌকো ঝড়ের রাতে। কেঁদে, হিজিবিজি বকে ইশারায় বলেছিলো ও দেবুর বিয়ে মানতে পারছে না। দেবুর বৌ ও-ই হবে!
অবাক না হবার মতো লোকের অভাব ছিলো। দুঃখবোধ ব্যাকরণ খুলেছিলো কেউ কেউ।কেউ শুধু সাদা চোখে আকাশ দেখেছে। কিন্তু কেউ তার দুঃখ সারিয়ে নৌকো তীরে আনেনি।
দার্শনিক(তিন)
সকাল ৮টা।
ছয় ঋতুতে দেখন-অভ্যস্ত ছয় রূপ তার। দিনে যেতে আসতে দু-বার দেখা। আমাকে দেখেই হেসে ওঠে।গাঁও বুড়োর মতো হিরণ্ময় বলিরেখা জাগিয়ে প্রতিদিন এক কথা, “খবর বলো, খবর বলো –!”
দূর! তোমায় কী খবর দেব? তুমি তো আসমানসম নীরব। তবু দিগন্ত ছাড়িয়ে পাখিডানা চোখে দুনিয়া দেখে নাও।সব খবর তোমার কাছে।তুমিই দেবে।
“সময় খারাপ”।
মানে ধরি না কথাটার।সবাই বলে সময় খারাপ।বাবা বলেছে।ঠাকুর্দা বলেছে।সময়ের চির সাবু-বার্লি, সে মাছের ঝোলভাতে কোনোদিন সেরে ওঠেনি।তাই এটাই বৈশ্বিক স্বাভাবিক।
“একদল চলে যায় তীর্থযাত্রীর মতো আলপথ ধরে।একদল আসে।তাদের দেখি , তবু ঠিক চিনি নাকো।তারা যেন বিশেষত্বহীন মানুষপিন্ড। শুধু ভেতরে কেউ কাঁকনঝুপুস পা, গেরুয়া প্রান্ত দেবদারু, গোপন ছোরার শ্বাসনালী। চোখে শিশির ঝরা লবনাম্বু, কিংবা আপাদমস্তক গড়িয়ে যাওয়া দাউদাউ টায়ার।
কেউ দেখে না সর্বংসহা তৃণ সবুজে ভেঙে পড়ছে। কাপড় জড়ানো ফুটবল পায়ে উড়ে বেড়ায় ফড়িং।আকাশ উথলে হাসিখুশি জলরঙ।সবাই হেঁটে যায় অপরিচিতের মতো”।
তার এসব কথা শুনতে শুনতে আমি পার হয়ে যাই। বিদায় জানাই। ও পাশ ফিরে শোয়।