ধারাবাহিকের পরবর্তী অংশ
আবিষ্কার
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
দুই বন্ধু বসে বসে গল্প করছিল। একথা সেকথায়
হরি কথায় এসে পড়ল দুজনে। একজন অল্প –
বিস্তর ধার্মিক ছিল। সে অন্য জনকে বলল, চল
বন্ধু, আজ ত্রিনয়নী গ্রামে হরিবাসর বসছে। খুব
বড় দল। কীর্তন সম্রাট সাধন ভট্টাচার্য আসছেন,
খুব বড়ো গাইয়ে। হরিনাম শোনা খুব পুন্যের।কিছু
ঈশ্বর নামগুনগান শোনা যাবে। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, হরিনাম শুনব, যখন বৃদ্ধ হবো। সংসার থেকে যখন অবসর নেব। এই জগত ব্রহ্মান্ড যখন স্বাদহীন ‘ আলুনি ‘ লাগবে তখন যাব হরিবাসরে। এখন আমাদের স্ফূর্তিতে থাকার সময়। তার চেয়ে বরং চল জলসা ঘরে। একজন নামজাদা বাইজী এসেছেন। যেমন মধুর গলা, তেমন জলসা জমানোর ক্ষমতা। তিনি সুরের – যাদুকরী।অসাধারণ। আমি সেখানে যাচ্ছি। তুই আমার সংগে বরং সেখানেই চল। না হলে যা, গিয়ে ধম্ম- টম্ম কর। ধার্মিক বন্ধু হরিবাসরে একদম সামনের সারিতে গুছিয়ে বসেছে। আর ভাবছে ওর সংগে জলসায় গেলেই হত। আমি কী মূর্খ!এখানে বসে হরিনাম শুনছি! ধিক আমাকে! আর বন্ধুটি কত ভাগ্যবান! কেমন স্ফূর্তি করছে! আর অন্য বন্ধুটি জমিয়ে বসেছে একবারে মঞ্চের সামনে। আর ভাবছে ছি :, ছি:, আমি এক অভাগা, হতভাগা, পাপী। না হলে এই পাঁকের মধ্যে বসে আছি? আর বন্ধুটি কত সুন্দর এক পরিবেশে বসে ঈশ্বর- কথা শুনছে।পুন্যময় কথা- শুনছে। আনন্দময়- কথা শুনছে। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ “সব মনের মধ্যে। শুভ- অশুভ, মন্দ- ভাল, সুকথা-কুকথা সব ওই অন্দরমহলে। ভেতর- বাড়িতে। মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ। আর যার মন মলিন তার সব
অপবিত্র। তাই নিজের মনকে আগে চেনো। মনকে
“পাকা ” মন বানাও। দ্যাখোনি, যতক্ষণ ঘি কাঁচা
থাকে কড়াইতে, ততক্ষণই কলকল শব্দ করে।
ভালো মত গরম হলে আর কোনো শব্দ নেই।
খালি গাড়ুতে জল ভরতে যাও, দেখবে ভকভকানি শব্দ উঠছে। ভরে গেলে আর শব্দ নেই। বিচার কতক্ষণ? বুদ্ধি কতক্ষণ? যতক্ষণ না তাঁর সেই আনন্দময়ের খবর পাওয়া যায়! সেই কল্যানময়ের হদিশ মেলে!
মধুপানের আনন্দ পেলে মৌমাছি আর ভনভন করে না। আর কোনো শব্দ নেই। সব শব্দের সমাপ্তি। হরিবাসরে বসে যদি কেউ মনে ভিন্ন চিত্র আঁকে সে পাপী। যদি তার মনে কুপ্রবৃত্তি আসে, সে
হতভাগা। আর অন্যদিকে, যদি কেউ জলসাঘরে
লাস্যময়ী নর্তকীর সামনে বসে ঈশ্বরকে চেতনায়
আনতে পারে,ভগবানকে মনে আনতে পারে – সে পুন্যবান, সে ভাগ্যবান পুরুষ।
সেই দুই বন্ধু একদিন একসাথে দেহ রাখল। ধার্মিক বন্ধু যে হরিবাসরে গেছিল- যমদূতেরা এসে তাকে নিয়ে গেল যমালয়ে। আর যে বন্ধু জলসাঘরে নাচ গান শুনতে গেছিল – বিষ্ণুদূতেরা এসে তাকে সাদরে নিয়ে গেল বৈকুণ্ঠধামে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কথা প্রসঙ্গে বলেছেন,”হবিষ্যান্ন খেয়েও, দেবস্থানে বাস করেও কেউ যদি কামিনীকাঞ্চনে মন ফেলে রাখে, ধিক তাকে। আর কেউ যদি নেশা ভাঙের আসরে বসে, মদ মাংস ভক্ষন করেও শ্রীবিষ্ণুর চরন অংকন করে মনে, সেই বাহাদুর,সেই পরম ভাগ্যবান, পরম পুন্যবান।
হৃদয় আকাশেই চিন্তামনীর আভাস। মনের
মন্দিরেই আছে সৎ- অসৎ বিচার। বিচার করবে
কে? তুমি। মনের বিচারক তুমি স্বয়ং। তাই বিচার
করতে হবে তোমাকেই। গ্রহণ ও মনে, ত্যাগ ও মনে। কী গ্রহণ করবে? আর কীই বা ত্যাগ করবে? ত্যাগ করবে কামনা। না, আমার তেমন কিছু চাই না। মোটা ভাত, মোটা কাপড়। বেশি চাইলেই মনে বাবুয়ানি আসবে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চাই।আমার কোনো কামনা নেই। লোভ ত্যাগ হবে তাহলে। স্বার্থপরতা খুব বাজে। তাকে আগে ত্যাগ করো।দম্ভ,আমি পার্টির নেতা। পুলিশ প্রসাশন আমায় ডরায়। আমার কাছে চালাকি নয়। এটা দম্ভ। খুব খারাপ। মনে জন্মালেই শেষ করে দাও। মনের মধ্যেই ওকে গলা টিপে মারো। না হলে, ওই তোমার সর্বনাশের কারণ হবে। এই সব আমার নয়। তোমার। “তোমার ” ভাব আনা ভালো। এখানে “তোমার ” অর্থাৎ ঈশ্বরের। তোমার ভাবলে মনে স্বার্থপরতার জন্ম হয় না। লোভ, হিংসা – এরা পালাতে শুরু করে। ঈশ্বরের কাছে শুধু ” নির্বাসনা ” চাইবে। বলবে হে ঠাকুর আমার মনে কোনো “বাসনা “যেন না জাগে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাই উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন, “দ্যাখোনি,একটু সুতোর আঁশ থাকলে সেই সুতো আর ছুঁচের মধ্যে যায় না। ঐ আঁশটুকু বাদ দিলে তখন সুতো সুন্দর ছুঁচের মধ্যে চলে যায়। তেমনি মনের মধ্যে একটু ‘ কামনা বাসনার ‘ আঁশ থাকলে সেখানে আর ভগবান নেই। কী অপূর্ব ব্যাখা ঠাকুরের। এক সাধু, শহরে এসেছে অন্য শহর থেকে। হেথা -হোথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দালান বাড়ি, এ পথ,সে পথ রাজপথ, মন্দির, মসজিদ, অফিস, আদালত সব দেখে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। পথে আর এক মুসাফির সাধুর সংগে তার দেখা। মুসাফির সাধুরা ঝোলাঝাপ্টা, লোটাকম্বল সব সঙ্গে নিয়ে ঘোরে। সে বাইরের সাধুকে ডেকে বললে, “এ্যাতো যে চারদিকের রঙ দেখে বেড়াচ্ছো,বলি তোমার পোঁটলা পুঁটলি রাখলে কোথায়? কোনো চোর -বাটপারের চোখে পড়লে তো সব ফরসা করে দেবে।”
— “কেন? আগে বাসা ঠিক করলাম। তারপর ঘরদোর সাফসুতরো করলাম, তালা চাবি আনলাম। পোঁটলা পুঁটলি ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে – তারপর বেরিয়েছি।”
আগে ব্রহ্মজ্ঞান। তারপর ঈশ্বর – অন্বেষণ। শেষেঈশ্বরের মাধুর্য্য আস্বাদন। তাঁর লীলায় বিশ্বাস হলেতবে পূর্ণব্রহ্ম জ্ঞান। সাধু মহারাজের ঘর খোঁজা আর পোঁটলাপুটলির সঙ্গে কী অসামান্য তুলনামূলক ব্যাখায় ঠাকুর প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়েছেন ঈশ্বর-তত্ব।আর এই আমাদের মত গৃহবাসী সংসারী ভক্ত জীবনের ঘূর্নাবর্তের ওঠা পরা। এ তাঁর অনুপম রূপকল্প। আগে চেতনা তারপর চৈতন্য। আগে পূজা
তারপর প্রার্থনা। আগে খোঁজা তারপর পাওয়া।
আগে সিঁড়ি তারপর ছাত। ঠাকুর বলতেন, “সময় পেলেই নাম করো। হরিনাম। হাতে হাতে তালি দিয়েই করো। নামে রুচি আসাটাই দরকার।
রুচি এলেই বাড়বে আগ্রহ। আগ্রহ থেকেই একাগ্রতা। একাগ্রতার পিছনেই আসবে আকুলতা। ঈশ্বরের জন্য প্রানের মধ্যে আকুলি-বিকুলি। শুরু তো করো, দেখবে ঠিক পৌঁছে গেছ একদিন সেই চরণাবৃন্দ ধামে। “
ভগবান ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।
চ ল বে…