অতীতে বাংলায় হিন্দু রাজত্ব, শাসন ব্যবস্থাঃ
কলমেঃ দু র্গা শ ঙ্ক র দী র্ঘা ঙ্গী
এক
অতীতে শাস্ত্রের ব্যবস্থানুযায়ী হিন্দু সমাজ পরিচালিত হোত ; প্রধানত: মনু শাস্ত্র অনুসারে এবং পরাশর, বশিষ্ট ও জিমুতবাহনের ধর্ম্ম শাস্ত্রানুযায়ীরাজারা প্রজাপালন করতেন। ঋণ-গ্রহন, ধন-দান, পরস্ত্রীগমন, নরহত্যা, ব্যাভিচার, চুক্তিভঙ্গ প্রভৃতিবিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ রাজার নিকটে উপস্থিত করা হোত। রাজা তিনজন সুবিবেচক, সুপণ্ডিত, ব্রাহ্মণ অমাত্যসঙ্গে নিয়ে বিচার করতেন। বিচারের শাস্তি ছিল খুবই দু:খজনক। এই ব্যপারে মেগাস্থিনিসের বিবৃতি:-
“Person convicted of bearing false witness mutilation of his extremeties. …………
not only suffers in return the loss of the samelimb, but his hair also cut off. If any one causes an artisan to loss his hand
or eye he is put to death. “প্রাচীন কালে বাংলাদেশে হিন্দু ব্যতীত অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল না। আর্যরা প্রথমে অনুন্নত অনার্যগণকে
হিন্দু সমাজে শূদ্র রূপে স্থান দিয়ে সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভেদ ও
অনৈক্যের জন্য জাতিভেদ এবং আর্য ও অনার্য গণের সংমিশ্রণে ফলে হিন্দু সমাজের বিশুদ্ধতা
রক্ষার জন্য অস্পৃশ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় সমাজ পদ্ধতির উৎপত্তি ও বিবর্তনের সম্বন্ধে ডঃ ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত মহাশয় লিখেছেন “পৌরাণিক যুগে অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজে দৃঢ়বদ্ধ ছিল।
বঙ্গসমাজ ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে প্রখ্যাত পণ্ডিত, লেখক বিনয় ঘোষ মহাশয় নৃতত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছিলেন এই ভাবে- “বিভিন্ন মিশ্র-সংস্কৃতির বিন্যাসে এক -একটি মৌলিক সাংস্কৃতিক উপাদানের তাৎপর্য-বদলের অনেক উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে থেকে দেওয়া হয়। নরবলি বা উৎসর্গ-প্রথা (human sacrifice) একটি সুপ্রাচীন আদিম প্রথা। নিষাদ ও কিরাত (Indi-Mongoloid) জাতির সংস্কৃতি তে এই প্রথার গভীর তাৎপর্য ছিল।…. আর্যদের মধ্যে পুরোহিত ব্রাহ্মণ শ্রেণী একে ‘অধর্ম’ বলে নিন্দা করলেও ক্ষত্রিয় রাজারা দীর্ঘকাল এই প্রথা পালন করেছেন। বৈদিক সাহিত্যে ও মহাভারতে অনেক উপাখ্যান- উদাহরণ আছে। ( Survival of the prehistoric Civilisation of the Indus Valley.R.P.Chanda) ক্রমে এই প্রথা য় আর্যীকৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন মিশ্র-সংস্কৃতিতে বিন্যস্ত হয়ে তার তাৎপর্যও বদলেগেছে। “
খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিল।’ বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ অঙ্গ ও মগধ দেশকে সঙ্কীর্ণযোনী বা আংশিক আর্যীকৃত বলা হয়েছে, কিন্তু পুণ্ড্রবঙ্গ ও
কলিঙ্গ দেশ আর্যবহির্ভূতৎ অঞ্চল বলেন উপেক্ষিত হয়েছিল। প্রকৃত আর্যীকরণ অনেক পরে হয়েছিল।
উত্তর বঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের অনেক পরে পশ্চিম বঙ্গের
প্রকৃত আর্যীকরণ আরম্ভ হয়েছিল। পরে পরে বৌদ্ধ ধর্মের এই প্লাবনে হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা শিথিল হয়েছিল।
দুইঃ
আবার অষ্টম শতাব্দী থেকে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রভাব
কমে গেছল। হিন্দু ধর্ম্মের পুনরুত্থান হয়েছিল কারণ হিন্দু সমাজের শঙ্করাচার্য্য, কুমরিল ভট্ট
প্রভৃতি ধর্ম্মাচার্য্যগণের আবির্ভাব হয়েছিল এবং প্রচার হয়েছিল। বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রচার
দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছিল। নবম শতাব্দীর মধ্যে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে হিন্দু-ধর্ম্মের নবজাগরণ
হয়েছিল কিন্তু বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল
দীর্ঘদিন প্রায় ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত।
ভিন্ন culture- complex এ পরিবর্তন লক্ষনীয়।
বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রের এই culture complex
আদিম সমাজের ধর্ম কর্ম ও ধ্যনধারনা বদলে গেছল ও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল মৌলিক সংস্কৃতি থেকে।
আমাদের দেশে তন্ত্রাচারের শুরু হয়েছিল এই জায়গা থেকেই।
গ্রাম বাংলার ধর্ম্ম ঠাকুর ও শিবের গাজন কে
আমরা বিশেষ ভাবে পালন করি কারণ এটি লোক উৎসব বা জনসাধারণের উৎসব। ধর্মঠাকুরের
আরাধনায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব অনস্বীকার্য। “ধর্মঠাকুরের সঙ্গে বৌদ্ধমূর্তি পূজা ও স্তুপ প্রতীকপূজা রাঢ়ের একাধিক স্থানে দেখেছি। কূর্ম-
প্রতীক ও কোন নিষাদ-জাতির কূর্ম -টোটেম এর চিহ্ন বলে মনে হয়। বিষ্ণুর পৌরাণিক অবতার বলে
‘কূর্মের’ ব্যাখ্যা করার আগে ভাবা উচিত, এই
অবতার-কল্পনার ই(মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি) বা
উৎস কোথায়? “– বিনয় ঘোষ
সেইসময় অন্যান্য প্রদেশের সনাতনী হিন্দুগণ
বৌদ্ধাচারপ্লাবিত বঙ্গদেশকে অবজ্ঞার চক্ষে
দেখিতেন।
★অতীতে বাংলায় হিন্দু রাজত্বে শাস্ত্রের প্রভাব।
(Influence of religion in Bengal during the reign of Hindu kings)
তিনঃ
বাংলায় আর্যদের পূর্বে বিভিন্ন জাতি অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, মোঙ্গল এখানকার অধিবাসী ছিল।
এদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয়নুষ্ঠান ছিল।
সম্ভবতঃ খ্রীস্ট পূর্ব ৩০০ অব্দে মৌর্য্য বিজয়ের পর
থেকে বাংলার এই সব অঞ্চলে আর্যীকরণ শুরু হয় এবং ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এই সময়কালে অধিবাসীদের মধ্যে ভাষা ও আচারের
মধ্যে পরিবর্তন হয়েছিল। উত্তর ভারতের মাগধী প্রাকৃতের ভাষার প্রভাব অধিবাসীদের মধ্যে পড়েছিল কার্যত সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এই সব অঞ্চলে আর্যীকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ, জৈন ও
বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার করা। আবার জৈন ‘আয়ারঙ্গ
-সুত্তে’ উল্লেখ আছে, ধর্মীয় প্রচারকালে জৈন
প্রচারকদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। জৈন
সাধু সন্তান মগধের মধ্য দিয়ে রাঁচী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর পশ্চিমে বর্তমান পুরুলিয়াতে
প্রবেশ করেন। আদি বাসিন্দাদের অহিংস করার
জন্য চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে বাধার সম্মুখীন হলেও কালক্রমে ধীরে ধীরে জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য
বাদের মতবাদের উপর আকৃষ্ট হয়ে আচার আচরণ ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনে। কিন্তু লক্ষণীয় আচার আচরণ ও ধর্মীয় পরিবর্তনের সাথে নিজদের লৌকিক দেব দেবীর পূজা আরাধনার পদ্ধতি রয়ে গেছে। “জীবন যাপন ও ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে’উত্তর ভারতীয় মিশ্র আর্য’দের সঙ্গে অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের মিশ্রনে একজাতির উদ্ভব হোল তাদেরই বংশধর বর্তমান বাঙালি। এই সংমিশ্রণে তাদের মধ্যে দেখা গেল উন্নততর পর্যায়ের মানসিক পরিবর্তন”-অধ্যাপক ডঃ প্রণব রায়। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেনঃ
“এইরূপে অষ্ট্রিক, দ্রাবিড় ও উত্তর ভারতের মিশ্র
আর্য– এই তিন জাতির মিলনে বাঙ্গালী জাতির
সৃষ্টি হইল। উত্তর ভারতের গাঙ্গ সভ্যতাই যেন
নবসৃষ্ট আর্যভাষী বাঙ্গালী জাতির জন্মনীড় হইল।
রক্তে ও ভাষায় আদিম বাঙ্গালী মুখ্যত অনার্যদের ছিল। যেটুকু আর্য্যরক্ত বাঙ্গালী জাতি গঠনে আসিয়ছিল সেটুকু আবার উত্তর-ভারতেই অনার্য
মিশ্র হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আর্য্যভাষার সঙ্গে সঙ্গে
সৃজ্যমান বাঙ্গালী জাতি একটা নূতন মানসিক নীতি বা বিনয় পরিপাটি, যাহাকে ইংরেজিতে discipline বলে, তাহা পাইল; বাঙ্গালীর অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রকৃতির উপরে আর্য্য মনের ছাপ পড়িল।
ইহা তাহার পক্ষে মঙ্গলের কারণই হইল। আর্য্যমনের -ব্রাহ্মণ্যের এই ছাপটুকু, আদিম
অপরিস্ফুট বাঙালীকে একটা চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য দিল। “(‘বাঙ্গালীর সংস্কৃতি’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
আকাদেমি সংস্কৃতি’, (পৃ. ৭-৮, ১৯৯০)
এই সব ঘটনার অনেক পরে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর
প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম্মই সমগ্র বাংলাতে ধর্মীয় উন্মাদনা এনেছিল। যে সব অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হয়েছিল, বৈষ্ণবধর্ম্মের প্রতি মানুষের ভক্তি বৃদ্ধি হতে লাগলো, আর বৌদ্ধ ধর্ম্ম কুক্ষীগত হোল।এই সব ঘটনার অনেক আগে যে সব সাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থ সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে ‘গীত গোবিন্দ’-জয়দেব রচিত এক ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ। “There is in anthology a self -laudatory verse of Dhoyi which extols, not undeservedly, Lakshmanasena as Vikramaditya of Bengal. A traditional verse Speaks of five, if not nine, gems in his court, and they are enumerated as Govardhana, Sarana, Jayadeva, Umapati and Kaviraja……Jayadeva describes him also as srutidhara, an epithet over the interpretation of which as an intended compliment there has been diversity of opinion…. But the greatest among these poets is undoubtedly Jayadeva himself. The fame if his ‘Gita-govinda’ has never been confined within the limits if Bengal. It has claimed more than forty commentators from different provinces and more than a dozen Imitations. It is a great religious work of Mediaeval Vaishnavism.
জয়দেব ও গীত গোবিন্দ
(Jayadeva and Gita-govinda)
চারঃ
অতীতে আমরা যতজন কবিদের জানি তাঁদের মধ্যে কবি জয়দেবের স্থান ছিল সবার উপরে। তিনি ছিলেন মহাকবি।তাঁর সৃষ্ট সংস্কৃতগীতগোবিন্দ কেবল বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় নি।
এটা বলা যেতেই পারে বাংলার বাইরে বিভিন্ন প্রদেশে প্রায় ৪০ জন ভাষ্যকার এই জয়দেবের মহান সৃষ্টি “গীত-গোবিন্দ” কে নিয়ে নিজেদের ভাষায় সংকলন করেছিলেন, এবং প্রায় ১২ জনের
অধিক ,এই কাব্যকে অনুকরণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন রামসীতা এবং হরগৌরী, এই বিষয়ে কাজ করেছেন। কাব্য শুধুমাত্র উন্নত মানের অতুলনীয় গীত সংগীত নয় তার সাথে এটি মহান ধর্মীয় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব বাদ।
আবার অন্যান্য ভাষার মত মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাতেও হয়েছিল। আবার এই কাব্য গীতিকে আধার করে যেমনটি নবদাস রচিত হিন্দীতে ভক্তমাল সেইরকমই চন্দ্র দত্ত রচিত ভক্তমাল
লেখা হয়েছিল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় জয়দেবের পিতার নাম ভোজদেব আর মাতার নাম রামাদেবী(মতান্তরে বামা/রমা দেবী)। পত্নীর নাম পদ্মাবতী। বসবাস করতেন বীরভূম জেলার অজয় নদীর তীরে কেন্দুলিতে। আবার এটাও বলা হয়েছে” The implied personal reference to ‘Padmavati” is disputed expressly by Kumbha, who would interpret the word Padmavati as the goddess Lakshmi. “Padmavatiramana-jayadeva–kavi”, but there ia variant reading; ‘jayati jayadeva – kavi which omit this word But Chaittanyadasa, Sankara-misra; and other commentators take these passage as implying reference to the proper name of Jayadeva’s wife.The legend that Padmavati was a dancing girl, and Jadeva supplied the musical accompaniment to her dancing is said to be implied by means of punning in Jayadeva’s self description as ‘padmavati- charana -charana-chakravartin’,
গীত-গোবিন্দ মহান কাব্য ও তার প্রেম মূলক সংবেদনশীল কাহিনী কে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের
ভক্তরা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা আখ্যা দিয়েছেন।
অতীতে বাংলায় হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধার , নবজাগরণ ও বৌদ্ধধর্মের আধিপত্য হ্রাসঃ
পাঁচঃ
বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম্মের আধিপত্য বিস্তার করেছিল প্রায় ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত। কিন্তু ভারতের অন্য কোন প্রদেশে বৌদ্ধ ধর্মের সেই ভাবে বিস্তার লাভ করেনি। অষ্টম শতাব্দীর মধ্য ভাগ হ’তে নবম শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম্মের নব জাগরণ হয়েছিল। বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব কমতে শুরু হয়েছিল।কারণ ছিল শঙ্করাচার্য্যের ,কুমারিলের হিন্দু ধর্মের প্রচার। অতীতের রাজাদের মধ্যে অনেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেখা যায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজারা হিন্দু দেবতা দেবীদের মন্দির,বৌদ্ধ বা জৈন মন্দির স্থাপনে কোন বাধা সৃষ্টি করেন নি। আজও পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া অঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রান্তে বৌদ্ধ মন্দির বা জৈন মন্দির দেখতে পাই। ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মে অনুরক্ত শৈবভক্ত শশাঙ্কের সময় গৌড়বঙ্গ আর্য্য ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাণিজ্য নগরী তাম্রলিপ্তে বহু হিন্দুমন্দির ও বৌদ্ধ মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ছিল। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে (৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ) বরেন্দ্র ভূমিতে পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্বেও উদারহৃদয় পাল সম্রাটরা অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা করেন নি।এক নবযুগের সূচনা করেছিলেন। মাগধীপ্রাকৃত ও বাংলায় প্রথম অপভ্রংশ মিশ্রণে এক নতুন ভাষা চর্যাপদের সৃষ্টি হয়েছিল দশম শতকের মাঝামাঝি তে। চর্যাপদ বা সন্ধাভাষা আরও উন্নত হয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল উচ্চ শ্রেনীর সাহিত্য। এই সময় স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ হয়েছিল। টেরাকোটা- শিল্পেরও এক নতুন ধারা গড়ে উঠে। সেন যুগে মন্দির স্থাপত্যে আরও বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তী কালে দ্বাদশ শতকে লক্ষ্মণ সেনের রাজ সভায় জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতি ধর প্রভৃতি কবি ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আবির্ভাব হয়। তাঁরা সকলে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। সেই সব কাব্য ও সাহিত্য আজও সমাদৃত। শ্রী চৈতন্য প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম্ম এই সব অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম্মকে কুক্ষীগত করেন। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বৈষ্ণব ধর্ম্ম প্রচারিত হয। শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ শ্রীমদ রঘুনাথ দাস গোস্বামী, সপ্তগ্রামের শাসন কর্ত্তার একমাত্র পুত্র সংসার ধর্ম্ম ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। হুগলি জেলার প্রত্যেক গ্রামে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার হয় এবং বৌদ্ধধর্ম্ম শিথিল হয়। শ্রী রূপ, শ্রী সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ, গোপাল ভট্ট, দাস রঘুনাথ এই ছয় জন পার্ষদ বঙ্গদেশে দ্বাদশ পাটে শ্যামসুন্দর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবাসীর হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তি উদ্দীপিত করেন।
বাংলায় হিন্দু ধর্মের পুনরুদ্ধার,
নবজাগরণ, বৈষ্ণব ধর্ম্ম উন্মাদনা ও প্রচারঃ
ছয়ঃ
প্রভাকরের মতে শালিকনথী পূ্ঁথি এই
অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের পাঠ্য ছিল এবং তাঁরা এই মতে দৈবকার্য্যের অনুষ্ঠানাদি করতেন। খানাকুল-
কৃষ্ণনগরের পণ্ডিত ঠাকুরনারায়ণ বন্দোপাধ্যায়
রঘুনন্দনের ‘দায়ভাগের’ মত খণ্ডন করে নিজ মত
সংস্থাপন করেন। তাঁর সঙ্কলিত স্মৃতির নাম
“স্মৃতি- সর্বস্বত্ব”। শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ প্রভুর ছয় জন পার্ষদ যে দ্বাদশ পাট বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মধ্যে চারটি পাট -ই হুগলী জেলায় অবস্থিত। সেগুলি হলঃ
সাধকশ্রেষ্ঠ অভিরাম স্বামী খানাকুলে, কমলাকর
পিপলাই মাহেশে, উদ্ধারণ দত্ত কৃষ্ণপুরে এবং
পরমেশ্বর ঠাকুর বিষখালী (তড়া- আঁটপূর) গ্রামে
বৈষ্ণবধর্ম্ম প্রচার করে হুগলী জেলাকে ধন্য ও পবিত্র করেন।
“অভিরাম পূর্ব্বে সুদাস খানাকুলে স্থিতি।
খানাকুল কৃষ্ণনগর গ্রাম নাম খ্যাতি।।
আকনা মাহেশে জন্ম জাগেশ্বরে স্থিতি।
কমলাকর পিপলাই এই যে নিশ্চিতি।।
কমলাকর মহাবল পূর্ব্ব নাম হয়।
উদ্ধারণ দত্তের বাস কৃষ্ণপুর কয়।।
হুগলীর নিকট হয় কৃষ্ণপুর গ্রাম।
উদ্ধারণ সুবাহু জানিবার পূর্ব্ব নাম।।
পরমেশ্বর দাস পূর্ব্বে স্তোক কৃষ্ণ ছিল।
বোদখানাতে নাগরিক পুরুষোত্তম জন্মিল।।
সাচড়াতে পরমেশ্বর দাসের বসতি।
পরমেশ্বর অর্জুন সখা পূর্ব্বে এই খ্যাতি।। “”
দ্বাদশ- পাট ব্যতীত শ্রীচৈতন্য ভক্তগণ বঙ্গদেশে
আরো সতেরোটি শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন;
উক্ত সতেরটী শ্রীপাটের নিম্নোক্ত পাটবাড়ি হুগলী
জেলার মধ্যে অবস্থিত।
“পঞ্চধাম দ্বাদশ পাট সপ্তদশ হয়।
ভক্তগণের সপ্তদশ সহ চৌত্রিশ পাট কয়।।
চারটা বল্লভপুরে সেবা অনুপাম।
ভক্তগণ যে যে ছিল কহি তার নাম।।
কাশীশ্বর শঙ্করারণ্য শ্রীনাথ আর।
শ্রী রুদ্র পণ্ডিত ৎ আদি বাস সবার।।
বেলে অনন্তপুরী মহিমা প্রচুর।
বগনপাড়াবাসী শ্রী রামাঞ্চী ঠাকুর।।
গোপতিপাড়াতে সত্যানন্দ সরস্বতী।
বৃন্দাবন চন্দ্র সেবান করিয়া পিরীতি।।
জিরাটে মাধবাচার্য্য আর গঙ্গাদেবী।
যশড়াতে জগদীশ নিত্য বেনোদী।।
খানাকুল কৃষ্ণদাস ঠাকুরের বাস।
কৈয়ড় গ্রামেতে বেদগর্ভ পরকাশ।।
ভঙ্গমোড়াতে বাস সুন্দরানন্দ নাম।
পরম বিদ্বান বিপ্র পণ্ডিত আখ্যান।।
দ্বীপগ্রামে স্থিতি কৃষ্ণানন্দ অবধূত।
সোনাতলা রঙ্গাদেশে রঙ্গনকৃষ্ণ দাস নিশ্চিত।।
রাধানগরেতে বাস যদু হালদার।
হীরামাধব দাস স্থিতি অনন্তনগর।।
মহেশ গ্রামেতে বাস গোপাল দাস নাম।
কোটরাতে বাস অচ্যুত পণ্ডিত আখ্যান।। “
** অভিরাম দাস লিখিত ‘পাট পর্যটন’
১৩১৮ সাল। এই ভাবে শ্রী চৈতন্য , নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পার্ষদগণ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম্ম প্রচার করেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বংশধরেরা, অন্যান্য পার্ষদগণের বংশধরেরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে
বৈষ্ণব ধর্ম্ম প্রচার করেন। হিন্দুধর্ম্মের পাশাপাশি জৈন ধর্ম্ম এখনও ভারতের নানা প্রান্তে টিকে থাকার কারণ হ’ল হিন্দু ও জৈনদের মধ্যে কোন বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়নি। হিন্দু কয়েকটি দেব-দেবীর আরাধনা জৈনগন কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছিল। ইহাও একটি কারণ। আর অতীতে বৌদ্ধ ধর্ম্ম বিস্তার হবার কারন ছিল ইহা ‘রাজানুগ্রহলাভে’র উপর নির্ভর ছিল।রাজাদের শাসন অবলুপ্তির পর বৌদ্ধধর্ম্মের প্রসার কমল। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী কালে বৌদ্ধধর্ম্মে তান্ত্রিকতা প্রবেশ করিলে এবং বৌদ্ধগণ হিন্দুধর্ম্মের উপাসনা পদ্ধতি অনুসরণে বুদ্ধের মূর্ত্তিপূজা শুরু করল। হিন্দুধর্ম্মের পক্ষে বৌদ্ধধর্ম্মের লোকেদের হিন্দুধর্ম্মেরগণ্ডিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। জৈনধর্ম কোন দিন প্রাধান্য বিস্তার করেনি।
ক্রমশঃ……
তথ্যসূত্র:
★The History of Bengal
( Prof) Dr. Ramesh Chandra Majumdar
★Banglar Mandir Sthapatya o Bhaskarya
(Prof.) Dr. Pranab Roy
★হুগলি জেলার ইতিহাস
শ্রী সুধীরকুমার মিত্র বিদ্যাবিনোদ
★পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি
শ্রী বিনয় ঘোষ
★ভারতের ইতিহাস কথা
ডঃ কিরণচন্দ্র চৌধুরী
★বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
( অধ্যাপক) ড: প্রণব রায়।