পরবর্তী অংশ
সময় ও কর্ম(শেষ ভাগ)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
” সময় ও কর্ম ” বোঝাতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সুন্দর একটি গল্প উপহার দিয়েছেন।
ঠাকুরই বলে গেছেন এটি ভাগবত থেকে নেওয়া।
আমরা ভেতরের ‘ ভাব’ টা রেখে সম্প্রসারণ করেছি মাত্র। আর নিবেদন করছি তাঁরই শ্রীচরনে।
“এক গভীর গহন অরন্য। চারিদিকে বড় বড় সব
গাছেদের সারি। বট, অশ্বত্থ, নিম, তেঁতুল, শাল
পিয়ালের জংগল। মাথার ওপরে নীল সাদা মেঘে
দের বাড়ি। কত রকমের সব পাখিদের সেথা নিত্য
আনাগোণা। তাদের কল কন্ঠের কলতানে সারা
দিন মুখর। মধ্যে একটা ছোট্ট নদী, যেন লজ্জায়
ঘোমটা টেনে হেলে দুলে বয়ে চলেছে।
কত রকমের সব প্রাণী, সেথা পিপাসায় জল
খেতে আসে। হরিণ, শিয়াল, খরগোশ, শজারু
আর কত নাম না জানা পাখি।
ওই ” জিয়াঝোড়া” নদীর পাশেই অতি সুন্দর এক
মাটির কুঠীর। কুঠীরের সামনে মনোগ্রাহী এক
ফুলের বাগান। কত রকমারী সব ফুল ফুটে আছে। প্রাঙ্গনের মধ্যে দুটি বড় বড় গাছের নিচে
দু জন সৌম্য দর্শন সাধক তপস্যায় রত। সাধনার
উপোযোগী স্থল – এইআশ্রম। আশ্রমে কিছু সন্ন্যাসী
নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ গাছে জল সিন্চন করছে
কেউ আশ্রম পরিপাটি করে পরিষ্কারে মত্ত। সাধক
দুজনের মধ্যে কোনো চঞ্চলতা নেই, ঈশ্বর সাধনায় তাঁরা গভীর ভাবে নিমগ্ন। সমাধিমগ্ন।
ঢেঁকিতে চেপে বীনা বাজাতে বাজাতে দেবর্ষি নারদ বৈকুণ্ঠধামে যাচ্ছিলেন ওই পথে। নিচের
দিকে চোখ পড়তেই তিনি সাধনা মগ্ন দুই সাধককে
দেখে যেন আকর্ষিত হলেন। নাবলেন ঢেঁকি থেকে
সেই আশ্রম – প্রাঙ্গণে। তাঁকে নাবতে দেখে ছুটে এল সন্ন্যাসী দুজন স্বাগত জানাতে। আর তাঁর
আগমনে গোটা বনানী যেন হেসে খেলে করতালি
দিয়ে উঠলো। প্রকৃতি যেন গেয়ে উঠল আাগমনী
গান। সাধক দুজনের তন্ময়তায় যেন দোলা লাগল। দুজনের হৃদয়েই এক দৈব অনুভব ঘটল-
কিছু একটা আশ্রম প্রাঙ্গনে ঘটেছে!
সাধক দুজনেই নিজ নিজ আসন ছেড়ে আনন্দে
উঠে দাঁড়ালেন দেবর্ষিকে সাক্ষাৎ তাঁদের সামনে
উপস্থিত দেখে। করজোড়ে বললেন হে প্রভু,
“আমাদের আভূমি প্রনাম গ্রহণ করুন। আর অনুগ্রহ করে জানান কেন আপনার পদধূলি হঠাৎ
এখানে পড়লো? কী কারনে আপনার মত একজন দেব- ঋষির এই অরন্য আশ্রমে আগমন”?
নারদ বললেন,” বৎসে, অস্থির হয়ো না। এমনিই
এলাম। এই পথেই যাচ্ছিলাম, এিলোক ভ্রমণ সেরে।এবার যাব বৈকুণ্ঠধামে। এই মনোরম পরিবেশে, শান্ত অরন্যে, তোমাদের উভয়কে
তপস্যামগ্ন দেখে মন ভরে গেল। তাই নারায়নকে
স্মরণ করে নাবলাম। নারায়ন নারায়ণ “।
প্রথম সাধক বললেন, — খুবই প্রীত হলাম প্রভু।
আমাদের এখানে বিশ্রাম করুন আর আমাদের
সেবা করার সুযোগ দিন,নাথ। আর আমার
অন্তরের একটি কথা জানার বড় ইচ্চা হচ্ছে প্রভু,
আমার ” মোক্ষলাভের ” আর কত বিলম্ব? আপনি
অন্তর্যামী ঈশ্বর। একমাত্র আপনার কাছেই আছে
আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর।
দ্বিতীয় সাধকের ও ওই একই প্রশ্ন। সেও বলল —
হ্যাঁ, ঋষিবর সেই পরম প্রার্থিতকে পেয়ে কবে ধন্য
হবো? কবে হবে মোর পরম পুরুষকে জেনে
মুক্তির- পুন্যলাভ? কৃপা করে আামাদের প্রশ্নের
উত্তর দিন।
নারদ উত্তরে বললেন ” সঠিক ধারায় কর্ম করে
যাও। সময়কে মেনে ধৈর্য্য ধরো। অধৈর্য্য হলে
কিচ্ছু হবে না। ঈশ্বর লাভের জন্য পাঁচটি শর্ত আছে। তারা হল — শম, দম, ত্যাগ, তিতিক্ষা আর ধৈর্য্য। এগুলো মেনে এগিয়ে চলো – ঠিক
একদিন লক্ষে পৌঁছে যাবে। “
প্রথম সাধক তাও পীড়াপীড়ি করতে লাগল। বল্লে, — প্রভু, আপনি আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাবেন না দয়া করে। আপনিই যোগ্য পুরুষ দেব, কৃপা করে
কিছু একটা বলুন। দেবর্ষি নারদ তখন বললেন, ” সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম,বাসুদেব সর্বমিতি ” — অর্থাৎ সর্বত্রই ব্রহ্মের নিকেতন। নারায়ন সর্বত্র বিরাজমান। তাঁকে অনুভবে আনো। ভাবনায় আনো। চেতনায় আনো। আর অধৈর্য্য হয়ো না “। তবুও প্রথম সাধক অনুনয় বিনয় করতে থাকলো। নারদীয় ইংগিতটাই ধরতে পারলো না। তখন নারদ একটু ক্ষুন্ন হয়েই বললেন, ” আর ঠিক এক বৎসর, বৎস “। শুনে প্রথম সাধক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। আরও এক বছর? আরও বারোটা মাস? বাহান্নটা সপ্তাহ আরও তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন? মানে আট হাজার সাতশো ষাট ঘন্টা? এমনকি করে… নারদ উত্তরে বললেন, ” হ্যাঁ, বৎস, ঠিক তাই। আবারও বলছি, ধৈর্য্য হারিও না। ” এসব শুনে —
দ্বিতীয় সাধকের মনে আনন্দের সঞ্চার হল। প্রথম
জন যখন জানতে পেরেছে, তখন আমারও জানতে ক্ষতি কী? সে শুধাল, ” দেবর্ষি, ওর তো এক বছর। আর আমার? আমি কবে পাব সেই হৃদয়নিহিতকে? কবে হবে আমার আত্ম-উন্মোচন? ভগবন দর্শনে আর কত বিলম্ব?” নারদ বললেন, ” তোমার অনেক দেরি বাছা,তবে চিন্তা কোরো না। ফল তুমিও অবশ্যই পাবে।” দ্বিতীয় সাধক শুনে মহা খুশি। সে বলল, –” চিন্তা আমার নেই ব্রহ্মর্ষি। আপনার শ্রীমুখের উচ্চারণই হবে আমার আত্মার শান্তি। হৃদয়ের আনন্দ। তবু যদি বলেন – কত দিন, কত মাস, কতবছর……
নারদ বললেন, ” ওই যে তেঁতুলগাছ টা দেখছ, ওই
গাছে যত পাতা আছে তত বছর লাগবে তোমার”।
আনন্দে নৃত্য শুরু করলো সে। নারদের পদযুগলে
সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করলে। তারপর উঠে বলল ” ও ঠিক
দেখতে দেখতে কেটে যাবে আনন্দে। আমার
অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস আছে প্রভু, ঈশ্বর নির্ভর করে
তপস্যায় বসে থাকব সেই দেবদর্শনের জন্যে। আমার কোনো ভাবনাও নেই, চিন্তাও নেই।”
মূহুর্তে শান্ত সেই অরন্যে পাখিদের কোলাহল
শুরু হলো। বনানীর প্রতিটি বৃক্ষদেবী যেন প্র-
ফুল্ল হয়ে উঠলেন। কোথা থেকে ভেসে এলো
মলয় পর্বতের মিষ্টি হাওয়া আর সেই বাতাসে
প্রতিটি বৃক্ষ যেন চামর করতে লাগল প্রকৃতিদেবী
কে। সূর্যদেব জ্বালিয়ে দিলেন নানা বর্ণের আলোর
প্রদীপ। সমস্ত বনাঞ্চল জুড়ে দেখা দিল সাতরঙা
এক রামধনু। শন্ শন্ হাওয়া জগতময় বাজিয়ে
তুলল মংগলময় শঙ্খধ্বনি…..
“জিয়াঝোড়া” নদির জল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে
উঠে এসে ধুইয়ে দিলো দেবর্ষি নারদের পা দুখানি।
ধূপ- ধূনার পবিত্র গন্ধে মাতোয়ারা হলো সেখানে
উপস্থিত সবার হৃদয়।
হঠাৎই আকাশ জুড়ে আলোর মালার সৃষ্টি হলো।
শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি। বাতাসে ভেসে এলো দেব- লোকের সুগন্ধি আতরের সুবাস। কে যেন আকাশ
থেকে দৈববানী শোনাল, ” দ্বিতীয় সাধক, তুমি
এসো এই বৈকুণ্ঠে, দেবর্ষি নারদের সাথে। তুমিই
আদর্শ আত্মজ্ঞানী। তুমিই ব্রহ্মজ্ঞানী। তুমি” সময়”
কে জয় করেছ। তেঁতুলপাতার সংখ্যা তোমাকে
ছুঁতে পারেনি। অগনিত বছরকে তোমার আত্মা
“একপল “ভেবে নিতে পেরেছে তপস্যায়। এমন
সাধকই সাধুবাদ পাবার যোগ্য। এমন অপূর্ব সাধনাই পারে সাধককে স্বর্গ সুখ এনে দিতে। আত্মা অনাত্মার পার্থক্য তুমি যথার্থভাবে করে
ফেলেছ। তাই তোমার মোক্ষলাভ। “
—-” তুমি এসো, ধর্মের পথে। এসো ঈশ্বরের পথে। এসো বৈকুণ্ঠের পথে। ”
তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ ” ধপ করে,
বা লাফিয়ে ছাতে ওঠা যায় না। একটা একটা
করে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। তারপর ছাত।আর
বলেছেন, ধৈর্যের কথা। সময়ের কথা। বলেছেন
ঈশ্বর চাইলে সব হয়। তিনিই ” সময়” এগিয়ে
নিয়ে আসেন। —-ঠাকুরের এই গল্পে ঈশ্বরের অপার করুনায় তিনি নিজেই সাধকের জন্য সেই
কাঙ্ক্ষিত সময় কীভাবে এগিয়ে নিয়ে আসেন — আমরা সেই গল্পই এতক্ষণ শুনলাম।
সকল সাধকের একটাই পথ – ভগবানের দিকে।
আর ভগবান সবার।
সমাপ্ত