ধারাবাহিক গদ্যঃ
লাউ কুমড়ো(তিন)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
শুভ মহাসপ্তমী
” সে বড় কঠিন ঠাঁই গুরু শিষ্যে দেখা নাই “। যখন
পূর্ণজ্ঞান হয় তখন কে বা গুরু আর কে বা শিষ্য।
তখন নিজেই গুরু আবার নিজেই শিষ্য। কিংবা
বলা যেতে পারে তখন গুরুও নেই শিষ্যও নেই।
তুমি আগে মায়া তারপর দয়া। আমি মায়ার পারে
এসে তোমার দয়ার জন্য বসে আছি। ” কথাগুলো
হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? একটু জটিলতা রয়েছে? না তো! ভেবে দেখলেই সোজা, সরল, সহজ।
শোনা যাক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কী বলছেন — ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়ির উঠানে খেলছে। কুমির- ডাঙা খেলছে কোনো দল। কোনো দল খেলছে চোর-পুলিশ। সব দলেই কিন্তু একটা করে ” বুড়ি” আছে। সে নিজেকে খেলায় জড়ায় না, কিন্তু সম্পূর্ন অন্যরকম দৃষ্টিতে পুরো খেলাটাই উপভোগ করে, আনন্দ নেয়। বুড়ি ছুঁয়ে দিলে খেলুড়েকে আর বেগার খাটতে হয় না। তাই খেলুড়ে বুড়ির নাগালের মধ্যেই থাকে। যাতে চট করে তার স্পর্শ পাওয়া যায়। আর তাকে ছুঁয়ে দিলে সে বেগার খাটা থেকে মুক্ত। এই বুড়িই হলো “মায়া”। মানুষ মায়ায় বদ্ধ। আর মায়া মানুষকে নিরন্তর তার বন্ধনে, তার আকর্ষণে,তার মুষ্টিতে বেঁধে রাখতে চায়। তার কথাই খেলাতে “শেষকথা”। লগ্ন হয়ে আছি মায়ার সংগে। মগ্ন হয়ে আছি ‘ অহং’ কে সঙ্গে নিয়ে। শুধু “আমি “আর “আমার”। আমার প্রভাব, আমার প্রতিপত্তি, আমার নাম, আমার যশ, আমার সম্পত্তি, আমার রয়েল এনফিল্ড, আমার হোন্ডা সিডি।এসব আমি করেছি। আমি এর মালিক। আমি বিদ্বান, আমি বুদ্ধিমান। তাই আমার এত বড় ব্যাবসা আজ। এই খেলা চললেই ”বুড়ি”-র আহ্লাদ। বুড়ির মজা। ছেলে মেয়ে পরিবার আপনারজন সুখ দুঃখ ভোগ ভোগান্তি সব মায়ার অধীন। তুমি ইচ্ছে করলেও এর থেকে বেরতে পারবে না। তাহলে উপায়? উপায় হলো – শরণাগতি। তাঁর চরণে শরন। ঈশ্বরের ওপর সব ছেড়ে দাও। দ্যাখো কত ভার কমে যাচ্ছে। নির্ভার মনে হবে। এই গোটা সংসার মা বাবা ভাই ভাতিজা সন্তান সন্ততি সব গোবিন্দের। আমার নয়। আমি দেখাশোনা করছি
মাত্র। এমন ভাবতে পারলে দেখ আর কোনো
গোল নেই। কোনো চাপ নেই মনে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা দিয়েছেন – যেমন ধর
বেড়ালছানা। কী অন্তর্দৃষ্টিতে দেখেছেন এই জগত
ও তার চারপাশ। আর তারপর আমাদের বুঝিয়ে
ছেন, উপমা সহ। বেড়াল মা, মুখে করে সদ্যজন্মানো
সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটু
নিরাপত্তার খোঁজে, কখনো রাখছে তাকে গেরস্তের
রান্নাঘরের উনুনের ছাইগাদার মধ্যে। সে মিউমিউ
করে যাচ্ছে। সে জানে আমি মায়ের হেপাজতে
আছি। আমার চিন্তা কী? আমার চিন্তা মা নিজে
নিয়েছে। তার কোনো পছন্দ অপছন্দ ও নাই।কখনো মা তাকে নিয়ে গিয়ে রাখছে বাবুদের
তিন তলার খাটে, গদি বিছানার মধ্যে। কখনো
বা উনোনের বাসি ছাইয়ের মধ্যে। সে নির্লিপ্ত।
ঠাকুর বলছেন – একেই বলে “শ র না গ তি”…
সব তাঁর। সব ঈশ্বরের। সব গোবিন্দের। এটাই
শরনাগতি।
★ গুরু- শিষ্য সংবাদঃ-
শিষ্য গুরুর শিক্ষায়, গুরুর উপদেশে তাঁর
নির্দেশিত পথে সাধনায় সিদ্ধ হলো। এ
ব্রহ্মাণ্ড তখন সাধকের কাছে প্রপঞ্চময়। কে মা
কে বাবা কে ছোট কে বড় কে শিষ্য আর কেই
বা গুরু এ সংশয় তার আর নাই। সকলেই
তার স্বজন। আপন আত্মার আত্মীয়। সেই দিব্য
অনুভবে -সেই সাধকের কাছে গুরুও নেই, শিষ্যও
নেই। সব একাকার। এমন শিষ্য পাওয়া ও সব
গুরুর ভাগ্যে ঘটে না।এমন শিষ্য, গুরুর অহংকার।
ঠাকুর সব প্রাঞ্জল করে দিলেন। সব সহজ।সব সোজা। কোথাও আর কোনো বাঁক নেই।সমস্ত জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর তিনি। সমস্ত প্রশ্নের সঠিক
সমাধান ও তিনিই। সমস্ত জটিলতার সঠিক মীমাংসা সেই তিনি। সমস্ত যাত্রার নির্বীঘ্ন উত্তরন। তাঁরই শ্রীচরণে। তিনিই আমাদের সহজিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
আজকের এই ধারাবাহিক শেষ করার আগে “বাইফোকালিজম্” এর সকল সুধী পাঠকবৃন্দ,
সম্পাদক মন্ডলীর সংগে যুক্ত সকল সদস্য/ সদস্যাদের এবং সমস্ত শুভানুধ্যায়ীদের ‘ শারদ শুভেচ্ছা ‘ ও আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। দেবী দুর্গা এই মর্ত্যধামে আসছেন মহিষাসুরমর্দিনী রূপে সিংহবাহিনী হয়ে। এবারের শারদ উৎসব “করোনা মহামারীর” কারনে অনেকটাই উচ্ছ্বসিত নয়, অনেকাংশে। তবু আমরা মা দশভুজার আরাধনায় সকলেই এগিয়ে এসেছি। সর্বত্র। হিমালয় কন্যা উমা আসছেন অসুর দলনে। তিনিই উমা,তিনিই পার্বতী, তিনিই দেবী দুর্গা। এই উৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা আমরা সকলেই যেন এই মহামারী-পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাই। “মহিষাসুরের” সাথে তিনি যেন “করোনাসুরকেও” নিধন করেন।
সমাপ্ত
( আগামী সোমবার বিজয়াদশমী। মা দশভুজা
কৈলাশের পথে… সেদিন আমরা নতুন কিছু পরিবেশন করব।)