তরুণকুমার সরখেল-এর ছড়াগুচ্ছ

তরুণকুমার সরখেলের জন্ম পুরুলিয়ার এক গ্রামে। সেখানে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবন, উদোম প্রকৃতি তার শিল্পী হৃদয়ে ভাব সঞ্চার করে। ফলে স্কুল জীবনেই শুরু হয়ে যায় তার লেখালিখি। কিশোরভারতী, শুকতারা, গণশক্তির মতো কাগজে তখনই মুদ্রিত হয় তাঁর ছড়া। ১৯৯৫ সালে শুরু করেন ‘সঞ্চিতা’ নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা যা আজও নিয়মিত প্রকাশিত হযে চলেছে। পাশাপাশি আরো একটি ছোটোদের পত্রিকা -‘টুকলু’র তিনি সম্পাদক। তিনি লিখেছেন আনন্দবাজার, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, চিরসবুজ লেখা প্রভৃতি পত্রিকায়।
ছোটদের জন্য শুধু ছড়া নয়, গল্পও লেখেন তিনি। রাজ্যের প্রায় সমস্ত শিশু ও কিশোর পত্রিকা সহ বাংলাদেশেও তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
ছোটদের জন্য লেখা এই কবির বইগুলি পড়লেই তাঁর চরিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। তিনি অনাবিল আনন্দের দিশারী। শিশুমনের স্বপ্নলোকে অনায়াসে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি পেয়েছেন অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কার। সংবর্ধনাও পেয়েছেন বহু জায়গায়। অন্যতম পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (২০০২) ও সাহিত্য মন্দির পুরস্কার (২০১৯)

সাত রাজ্যের ঘুম

মাঠের গোরু ফিরলো ঘরে, সন্ধ্যা নামে ধীরে
ঝুপঝুপিয়ে আঁধার নামে সজনেতলা ঘিরে।
চাঁদা চক্কর খেলা –
ভাই বোনেতে খেলছি আজ সারা দুপুরবেলা।
পড়তে বসে ঘুম –
চোখের পাতা এক হয়ে যায়, রাত বাড়ে নিঃঝুম।

শীতলপাটি দাওয়ায় মেলে বাবা জিরোন বসে,
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনছি, দিদি অঙ্ক কষে।
কুপির আলো জ্বেলে –
একলাটি মা খড়-বিচালি গোয়ালে দেয় ঢেলে।

উনুনতলে বসে বসে রাতের খাবার করে
ভিজে হাতে মা আমাদের খেতে ডাকেন ঘরে
ডাকল রাতের পাখি –
ঝুপসি আঁধার পেয়ারাতলা দেখছে আকাশটাকে ?

বিছ্না পাতা হলে –
শুয়ে শুয়ে দেখছি কেমন জোনাক পোকা জ্বলে !

রেডিওটা বন্ধ করে, হাত পাখাটা রেখে –
বাবা হাঁকেন : ‘রাত হয়েছে জেগে আছিস কে কে ?’

রাত বাড়ে নিঃঝুম্ –
আতায় পাতায় নেমে আসে রাতরাজ্যের ঘুম !

জামনিতলার বনে

জল ছপ্ ছপ্ মাঠ মন সব
শ্রাবণ মাসের ধারা,
সন্ধ্যা ঘনায় ফুরিয়ে আলো
ফুটলো সাঁঝের তারা।

বকনা বাছুর ডেকেই মরে
বিচালি দাও তাকে,
গোয়াল ঘরে দেখছিনে আজ
কালো দুধেলটাকে ?

সেটা তো আজ পালিয়েছিল
জামনিতলার বনে
এতক্ষনেও ফেরার কথা
পড়লনা তার মনে।

চাঁদ উঠল দিঘির পাড়ে
আঁধার হল ফিকে
জমনিতলায় কেউ দেখেছিস
কালো দুধেলটিকে ?

বাছুরটাতো ডেকেই সারা
একলা গোয়ালঘরে
কালো দুধেল ফিরবে কি সেই
চারপ্রহরের পরে ?

হলুদ ফুলের হাসি

সর্যে খেতে হলুদ ফুলের ঢেউ
মাঠ জুড়ে তার হলুদ পরাগ উড়ে,
সবুজ পাতায় হলুদ-মাখা হাসি
রয়েছে তার সারা হৃদয় জুড়ে।

একটি দুটি প্রজাপতি এসে
ছেয়ে ফেলে সর্যে খেতের মাঠ,
পরাগ মাখে পরাগ নিয়ে খেলে
সন্ধ্যে সকাল বসায় খুশির হাট।

বাতাস এসে সোনা রোদের সাথে
লুকোচুরি খেলাতে দেয় মন,
অবাক হয়ে দেখছে হলুদ ফুল
খেলা তাদের চলছে সারাক্ষণ !

বন্ধু হয়ে থেকো

একটি পাখি বলল গানের সুরে
ও খোকা তুই আমার কাছে আয়,
বাতাস মাখি সারাটা দিন আজ
খুশির ডানা ছড়িয়ে খোলা বায়।

আকাশ বলে বাঁধবে আমায় কে ?
নিরুদ্দেশে ভাসতে জানি বেশ,
খোকনরে তুই সঙ্গী হবি আয়
পাড়ি দেব অজানা এক দেশ।

মাঠ বলল, ছোট্ট খোকন সোনা
রোদ মেখে নাও আমার কাছে এসে
দেখবে কেমন পাড়ি দিতে জানি
তোমায় নিয়ে রূপকথার এক দেশে।

খোকন বলে, আকাশ-মাঠ ও পাখি
তোমরা আমার বন্ধু হয়ে থেকো,
এমনি করে ভালোবাসা ঢেলে
খুশির গাঙে ভাসতে আমায় ডেকো !

একটি জোনাক

একটি জোনাক সবুজ পাতার ফাঁকে
একটুখানি ছড়ালো যেই আলো,
তাতেই গাছের জুড়িয়ে গেল প্রাণ
উধাও হল মনের যত কালো।

একটি পাখি উঠলো ডেকে যেই
সবুজ বনে উঠলো যেন ঢেউ
খুশির হাওয়া ছড়িয়ে সকলখানে
জাগিয়ে দিল আলোকলতাকেও।

আঁধার কেটে ফুটলো আলো যেই
রোদের কুচি ঝরল ফুলের বনে,
ছড়িয়ে পরাগ আলোর গায়ে গায়ে
ফুল কুঁড়িটি ফুটল আপনমনে।

এমনি করেই দিন পেরিয়ে রাত
আঁধার নামে সজনেতলা ঘিরে
স্নিগ্ধ বাতাস ফুলের সুবাস মেখে
কোন অজানায় হারায় ধীরে ধীরে।

জোছনা পরি

সাদা-সফেন জোছনা ভরা মাঠ
মনে যে আমার ছুলো খুশির হাট,
রিনিক ঝিনি – রিনিক ঝিনি ঝিন্
সজনে পাতায় বাজলো খুশির বীণ।

মেঘ-কুয়াশা ধুম্র-পাহাড় চূড়ে
নিরুদ্দেশে যাচ্ছে আকাশ ফুঁড়ে
জোছনা মেখে শালুক ডাটার বন
পিট পিটিয়ে দেখছে সারাক্ষণ –

কেমন করে জোছনা পরি রাতে
ডানা মেলে মেঘ কুয়াশার সাথে
দিচ্ছে পাড়ি চাঁদ বুড়িটার দেশে
রিনিক ঝিনি হাল্কা হাওয়ায় ভেসে।

হলুদপাখি মেললো ডানা

মাঠ ছাড়িয়ে যে বন আছে
-আলোকলতার,
সেথায় গিয়ে একটি পাখি
-পালকে তার –

হলুদ রঙে ফরিয়ে ডানা
-তেপান্তরে
উধাও হবে এটা কি কেউ
-জানতোরে ?

সেই পাখি আজ ফিরলো ঘরে
-ভোরের বেলা,
আকাশ জুড়ে চলছে তখন
-আলোর খেলা।

সেই আলোতে হলুদ পাখি
-মেললো ডানা,
ফুড়ুৎ করে উড়লো পাখি
-তাইরে না-না।

শীত কড়চা

মিহিনসুতোর মস্ত বড় জাল মৌরিগ্রামের মাঠ দিয়েছে ঘিরে,
ফসল-কাটা খেত বরাবর রাতে হিমেল হিমেল কুয়াশা ঝির-ঝিরে।

শীত কুয়াশায় জুবুথুবু গাছ, একটুখানি রোদের আবেশ মেখে
কাক চেয়ে রয় মিষ্টি খেজুর রসে ঠোঁট ডুবিয়ে কখন নেবে চেখে।

খেত ভরা ওই সর্যেফুলের হাট কে দিয়েছে হলুদ আবির ঢেলে,
ঢেবচু শালিক ডিগবাজি দেয় ঘাসে প্রজাপতি পরাগ নিয়ে খেলে।

হলুদ গাঁদার ঘুম ভাঙেনা ভোরে, শীতের চাদর জড়ানো তার গায়ে,
শিরশিরানি কাঁসাই নদীর জল পা ভেজালে সুড়সুড়ি দেয় পায়ে।

মেঠো ইঁদুর জমিয়ে রাখে ধান আল বরাবর গোপন ভাঁড়ার ঘরে,
শীতের ফসল লুকিয়ে রাখে খানিক মাটির নীচে সাজিয়ে থরে থরে।

বরফকুচি মেখেছে আজ রোদ শীতের ভয়ে গাছ-গাছালি কাঁপে,
সাবান মেখে স্নান করতে গিয়ে অবনী ঘোষ শুধুই পারদ মাপে।

পাঠশালার ছবি

লালপাতা আর নাককাটা গাছ দিয়ে
পাঠশালাটার তিন দিক হল ঘেরা,
বর্ষার জলে স্যাত-স্যাতে হওয়া মাটি
খুঁড়ে ফেলি সব ছোট ছোট বালকেরা।

আনকোরা হাতে হরগৌরির গাছ
মাটিতে বসাই বেড়াটার কাছে কাছে,
নামতার ফাঁকে চোখ আছে সকলেরই
গোরু-টোরু এসে খেয়ে যায় গাছ পাছে।

আলো হাওয়া মেখে হরগৌরির গাছ
ঢাকা পড়ে গেল রং মাখা ফুলে ফুলে,
তারই লোভে কত প্রজাপতি দলে বেঁধে
ভিড় করে এলো আমাদেরই স্কুলে।

মনে হয় যেন এই সেদিনের কথা
এখনো ফুলের গন্ধটা পাই নাকে,
ফেলে আসা সেই পাঠশালাটার ছবি
খুঁজে পাই আমি হাজারো কাজের ফাঁকে।

সোনা-কুচি রোদ ঝরে

টালি দেওয়া ঘরে
পাঠশালা বসে
স্যাত-স্যাতে মেঝে-ঘর,

গুটি কয় ছেলে
সুর করে পড়ে
দুষ্টুমি দিন-ভর।

সামনের মাঠে
পুকুরের পাড়
কাঁচা বাঁশ দিয়ে ঘেরা,

হুটোপুটি করে
জলে ঝাঁপ দেয়
ছোট ছোট বালকেরা।

ঘাসে ঘাসে ফুল
প্রজাপতি ওড়ে
রেণু মাখা ডানা ভরে,

সারাদিন ধরে
পাঠশালা ঘরে
সোনা-কুচি রোদ ঝরে !

এলেবেলে ছেলে

একা একা ঘুড়ি নিয়ে মাঠে
খেলা করে এলেবেলে ছেলে,
পড়া নেই শোনা নেই তার
মাঠে যায় বই-খাতা ফেলে।

শিমুলের তুলো ওড়ে ঝড়ে
মাঠময় সাদা তুলো ভাসে,
এলেবেলে ছেলে খুশি মনে –
দেখে আর খিলি খিলি হাসে।

আসলে সে এলেবেলে ছেলে
কেউ তাকে ডেকে ভালোবেসে
কোনদিন বলেনাতো খোকা –
আয় শোন, বোস কাছে এসে।

আসলে সে ছেলে এলেবেলে
টো-টো করে সারাদিন হাঁটে,
মাঠ-বন-মেঠোফুল ছুঁয়ে
দিন তার এভাবেই কাটে।

একটি নদী

কংসাবতীর বিস্তীর্ণ চরে টইটম্বুর নদীর দেখা নেই,
মাছরাঙা আর শালিক-শঙ্খচিল দেখছিনে আজ তেমন কাউকেই।

কংসাবতী কোথায় গেল তবে ? যার সাথে ভাব আশৈশব জুড়ে,
নদীর বুকে ধূ-ধূ মরুর বালি, জলের আশায় কেউ বা বালি খুঁড়ে।

অন্ধকারে একলা নদীর বুকে টুকরো চাঁদের হীরকদ্যুতি খেলা
শুকিয়ে যাওয়া মরা নদীর সাথে গল্প বলেই কাটায় আঁধার বেলা।

আর দেরি নেই জাগবে এবার নদী মাখবে গায়ে বিপুল জলরাশি,
কংসাবতীর প্রতিবেশি গ্রামে যখন-তখন ভীষণই বানভাসি।

এই নদী যে সুখ-দুঃখের সাথি, এই নদীটাই বাঁচায় সবুজ ভূমি,
বন্ধু ভেবে কংসাবতীর তীরে একদিন ঠিক ঘুরতে এসো তুমি।

ধোঁয়া-ধুলোর শহর ছেড়ে

ধোঁয়া-ধুলোর শহর ছেড়ে, যাচ্ছি পুজোয় কাঁসাই পাড়ে ;
মন ছুটে যায় কাশের বনে, নীল পাহাড়ে –।
মেঘে সেজেছে আকাশ নীলে হাজার রকম আঁকিবুকি ;
তারই ফাঁকে সূর্যিমামা দিচ্ছে উঁকি –।
বকের পাখায় রোদ ঝলকায় উজ্জ্বলতায় আকাশ নীল ;
সাদা-রঙিন শাপলা ভরা পুকুর ঝিল—
আপন বেগে ছুটছে নদী সঙ্গে ছোটে ঢেউয়ের রাশি ;
কাঁসাই পাড়ে রাখাল ছেলে বাজায় বাঁশি—
যাচ্ছি পুজোয় পায়ে হেঁটে সবুজ ধানের বন্ধু হতে ;
বাঁশের সাঁকোয় একলা পেরোই কোনমতে –।
আটপহুরে হলুদ শাড়ি মাহাতদের ঘরের মেয়ে ;
ব্যস্ত কাজে উঠোন মাঝে অবাক চেয়ে –।
ডুংরি ঘেরা টোলা জুড়ে চলছে পরব সকাল থেক ;
হৃদয় জুড়োয় কাঁসাই পাড়ে এসব দেখে –।

কাশ-ফুল খুশি

ভরা-ভাদরের বাতাস বইছে
অমলিন ফুরফুরে
পুজোর-গন্ধ উড়ছে হাওয়াতে
ভালোবাসা রোদ্দুরে।
ইচ্ছে কুঁড়িরা রঙিন ঝালরে
গান গায় একসুরে।
ছুটির খুশিতে মাতোয়ারা মন
একসাথে যত বন্ধু-স্বজন
কাশ-ফুল খুশি বিলিয়ে দিয়েছে
লক্ষ্মীকান্তপুরে।

আদর মাখানো পুজোর চিঠিকে
চুমু ভরে দিয়ে হাতে
শাপলা কুঁড়িরা পাঠিয়ে দিয়েছে
নিঃঝুম কালো রাতে।
ভোরবেলা মাঠে ছোট বালকেরা
খেলছিল একসাথে
পুজোর চিঠিটা এল যেই কাছে
কচিকাঁচা সব পড়া ফেলে নাচে।
শিউলিতলায় ছোটাছুটি করে
যারা ছিল নিরালাতে।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *