থলে
নামওয়ালি সেরপেল (জাম্বিয়া)
অনুবাদঃ- কামারুজ্জামান
এখানে একটা থলে পড়ে।
থলে?
হ্যাঁ, একটা থলে। হুম।
একটা থলে।
বড়াে?
হ্যাঁ। ছাই রঙের ।
পুরাণাে কোয়াচা মুদ্রার মতাে রঙ। গায়ে কেমন যেন দাগ।
না, ওগুলাে ছায়া নয়। তাতেই বুঝছি ওটা নড়ছে। ভিতরে কিছু নড়াচড়া করছে কি?
পুরাে থলেটাই নড়ছে।
একটা নােংরা রাস্তা পাশেই একটা নালা। সেখানে ঘাস আর হলুদ ফুল ফুটে আছে। উপরের দিকে আরও অনেক গাছ।
অন্ধকার না?
হ্যাঁ, কিন্তু আলাে আসছে। এখন সকাল। কয়েকটা পাখি কথা বলছে। ফুরুৎ ফুরুৎ করছে। থলেটা মাটির উপর দিয়ে গড়িয়েই চলেছে। একটা লােক তার পিছনে সেটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
লােকটা কে?
তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। লম্বাটে ধরণের। তার জামার পিঠের দিকে দাগ লাগা। পায়ে মােজা নেই। তার পায়ের জুতাে দেখে মনে হয় ব্যবসা করে খায়। হাত দু’টো ভেজা।
সে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে?
বুঝতে পারছি না। আমি ক্লান্ত। পর্দাটা ফেলে দাও। আচ্ছা, বাওনা (প্রভু)।
জে. শােওয়ার ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে এল। কাঠের দরজাটা খােলা, কিন্তু লােহার নিরাপত্তা ফটকটা বন্ধ। আকাশটা কেমন ছেঁড়া-ছেঁড়া। এক্ষুণি পােকামাকড় ঢুকে পড়বে। ইতিমধ্যেই তারা বাগানে বিদ্যুতের মতাে কিচখিচ শুরু করেছে।
সে শােওয়ার ঘরের লােকটার কথা ভাবল। সে তাকে এমন মৃদু আবেশে ঘৃণা করতে লাগল যা সে বহুবছর ধরে করে এসেছিল।
জে. দুপুরের খাওয়ার থালাগুলাে ধুয়ে নিল। ঝাঁট দিল। বাইরে একটা মুরগী গলা বাড়িয়ে ডাক ছাড়ল। জে, তার দাঁতগুলাে চুক চুক করে চুষল এবং ব্যাপারটা কী তা দেখতে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। নিরাপত্তা ফটকের বাইরে ইসাবি ছেলেটা দাঁড়িয়ে। তার দুহাত দিয়ে বালতির হাতল ধরা। কনুই দুটোর ভিতরটা কড়া পড়ে চ্যাপ্টা। পা দুটোয় সাদা ও ছাই রঙের ছাপ।
তুই যদি এখানে থেকেও এমন চুপচাপ হয়ে থাকিস, তাহলে তুই কী করে আর আমাকে জানতে পারার আশা করবি? জে, ফটক খুলে তাকে শুধােল।
ছেলেটা ঘাড় ঝাঁকিয়ে উঠল, তার হাসিটা উপরের দিকে তিড়িং করে নেচে উঠল, তারপর তার উদাসীন মুখে সেই হাসি শুকিয়ে এল। জে. ছেলেটাকে তার পাটাপার্টাস-টা খুলতে বলল এবং বালতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। জে, তার ভারে কুঁতিয়ে উঠে অদ্ভুত ধরণের জিনিসটা বেসিনের মধ্যে ঝরিয়ে দিল। সে ব্রিম মাছটার আকার কিছু বুঝতে পারল না, বালতির ভিতরটার জল বইয়ে দিল, তার পাখনাটা তখনাে বাইরে বেরিয়ে । জে-র মনে হ’ল মাছটা অস্বস্তিতে ঘুরে উঠতেই জল বইতে শুরু করেছে।
আজকেরটা বেশ বড়ো, না?
জে. তার দিকে ঘুরে হাসল। ছেলেটা তখনাে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো সামনে মুঠো করে ধরা। তার পা দুটো নকশা করা পাটাতনের মেঝেতে ঝিলিক দিয়ে উঠছিল, তাতে মনে হল যেন সে বেশ লম্বাটে।
-কিছু খাবি?
ছেলেটা তির্যক ভঙ্গীতে ঘাড় নেড়ে তার ইচ্ছা প্রকাশ করল।
ছেলেটা দেহটার দু’প্রান্তে তার হাত দুটো রাখল। জে. জোড়টার নিচে ছুরি চালিয়ে কানকোগুলাে খুলে ফেলল। তাদের হাতে রক্ত ছিটকে পড়ল। মাছটা একবার, দু’বার ছটফট করল। তারপর ঝিমিয়ে পড়ল।তুই আমার সঙ্গে একটু হাত লাগা,
জে হাসল। সে মাছটার কাঁটাকুটো ছাড়াল, পােটা বের করল। ছেলেটা কাটাকুটি করার কাঠের পাটাটা মুছল, তাতে লাল আর হলুদ রঙের নাড়িভুড়ির সরু প্যাঁচগুলাে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সে কেমন যেন সম্মােহিত হয়ে পড়ল। জে. তেল, লবণ, টমেটো ও পিয়াজ দিয়ে সেটাকে বেশ কড়া করে ভাজল। থালাটা মেঝেতে রাখল। ছেলেটাকে এক টুকরাে দিল । মাছের কিছুটা নিজের জন্যে রেখে থালার বাকিটা সে শােওয়ার ঘরে পড়ে থাকা লােকটাকে দিয়ে এল। ঘরের দেওয়ালে রাস্তার আলাের একটা কমলাভ পোচ ছাড়া ঘরটা ছিল ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
কে ওখানে?
ইসাবি ছেলেটা।
জে. পাশের টেবিলে থালাটা রাখল এবং অলােটা জ্বালিয়ে দিল। লােকটা কাশতে শুরু করল । হাঁসফাস ও খকখক করতে করতে তার কাশির শ্লেষ্মা তার বুকে ছিটকে পড়তে লাগল । জে, ধরে তাকে বসিয়ে দিল এবং কাশির দমক শেষ হয়ে আসা পর্যন্ত সে তার পিঠটা মালিশ করতে লাগল। কাশি বন্ধ হয়ে আসার পর সে খুব কাহিল বােধ করছিল।
-মাছওলা ছেলেটা এখনও এখানে কেন? তুমি কি তাকে পয়সা দাওনি? আমি তাকে রাতের খাবার খেতে দিয়েছি।
কাউকে দিয়ে়ও আমার জন্যে যেন খাবার পড়ে থাকে, লােকটা ঘোৎ করে উঠল। সে থালাটা তার কোলের উপর টেনে নিয়ে এল, এবং খেতে লাগল। প্রথম স্বপ্নে থলেটা ভর্তি ছিল, সেটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। দ্বিতীয় স্বপ্নে আমি সেটার,পেটে।
এবার তৃতীয় স্বপ্নে কী প্রকাশ পাবে?
-তুমি বলাে।
স্বপ্ন এগিয়ে চলে,
পিছু হটে না। তুমি বলাে আমি কি কল্পনায় দেখছি। কিন্তু সেই জন্যেই তাে তুমি আমাকে বেছে নিয়েছো, নাইলা। কিংবা বলতে গেলে আমি তখন অন্ততঃ সেই রকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি এখন আর ঠিক নিশ্চিত নই। কখনাে কখনাে আমি ভাবি, তুমি শুধু আমার হাত দু’টো দেখেই আমাকে ভালােবাসতে । অন্য সময়ে আমার মনে হয়েছে এটা ঠিক করার জন্যে তুমি ঢিল ছুঁড়তে।
রান্নাঘরের মেঝেয় থালাটা খালি পড়ে আছে। ছেলেটা বিদায় নিয়েছে। একটা জিভ থালাটা পরিস্কার করে ফেলেছে, জে, দরজার দিকে যেতে-যেতে ভাবল। নিরাপত্তা ফটকটায় পােকার গাঁদি লেগেছে, সেটাকে আঁশ-আঁশ মতাে লাগছে, কিছু পােকার দেহটা এমনই ভারী যে ফাপা ধাতব দণ্ডে তাদের গা লেগে চটাং চটাং ধুন উঠছে। জে, ফটকটা খুলল এবং হাল্কা পা ফেলে রাস্তায় এসে নামল। মুরগী ঘরের চাল দেওয়া দরজাটা খােলার জন্য সে উবু হয়ে বসল। সে পাখিদের কিচকিচ ফরফর আওয়াজ শুনতে পেল। বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলাে অন্ধকারকে ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করে দিচ্ছিল। জে, একটু একটু করে এগিয়ে চলল, একটা মুরগী থেকে আর একটা মুরগীর দিকে যেতে গিয়ে তার জঙ্ঘার হাড়গুলাে মটমট করে উঠল। মুরগীগুলাে তাদের মাথা খাড়া করল এবং পালক ফুসিয়ে তুলল। শেষ মুরগীটা তার খােপে টানটান হয়ে বসে রইল, একটুও নড়ল না। জে, একটা দুলুনির আওয়াজ শুনতে পেল এবং দেওয়ালে চোখ মেলে দেখল। ছেলেটা। আলাের ছােপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
জে, মুরগীটার দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল এবং সেটার নাগাল পাওয়ার জন্য একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে চলল। মুরগীটার পালকগুলাে তার নরম হাড়ে টানটান হয়ে ছিল। মুরগীটা তার হাতের মধ্যে অসাড় হয়ে পড়ল। তখন সে তাদের দেখতে পেল, ঝাক। ঝাক, মুরগীটার দেহ থেকে ঝরে পড়ছে, ঘাড়ের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার ঠোট থেকে বেরিয়ে এসে পিল পিল করছে। জে, পিছিয়ে। এল। মুরগীটা দমে এল যখন ঝাঁক ঝাঁক পিপড়ে তার গায়ে এসে উপচে পড়ল। জে, উঠে দাঁড়াল, দাঁড়াতে গিয়ে তার মাথাটা চাল দেওয়া ছাদে ঠোকা খেল। মুরগীগুলাে ককর ক ককর কক করছিল, পাখা ঝাপ্টাচ্ছিল, পাখাগুলাে মাটি থেকে ঝাপ্টিয়ে উঠছিল। পিঁপড়েগুলাে তার গায়ে কামড় দিল। যখন সে মুরগীঘর থেকে নিচু হয়ে বেরিয়ে এল, একটা মুরগী মাথাটা একটা পিস্টনের মতাে করে তার পাঁজর বেয়ে ফুরুৎ করে সটকে পড়ে লাফিয়ে এসে পড়ল উঠোনে। জে. যথারীতি তার শরীরটা সরিয়ে নিল। তারপর ফিরে এসে সে ছায়ায় কাঁপতে থাকা বাচ্চাটাকে টেনে তুলল।আমার বুকের ভিতরটা ভাঙা কাচে ভর্তি। কাশলে আমার অমনই মনে হয়। কিন্তু কাচগুলাে কখনও ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় না, এমন কি কষ্টটা থেকে পুরােপুরি রেহাই পেলেও। আমি অসুস্থ, নাইলা । আমার জন্য খেটে-খেটে সে আরও শক্তপােক্ত হয়ে উঠেছে। সে কেনই। শুধু ভেবে মরে? প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম এটা বুঝি টাকার ব্যাপার। এখন বুঝছি সে তক্কে তক্কে আছে। আমাদের ভাবনার ওঠানামা নিয়ে আমি অবাক হয়ে ভাবি। আমরা দূর গণ্ডি ছাড়িয়ে, মানুষের সমাজ শুরু করেছিলাম, আমরা বললাম।যে করেই হােক সেটাকে আমরা সংক্ষিপ্ত করে আনি, শেষপর্যন্ত আমরা তিনজন হয়ে পড়ি। জ্যাকব, জোসেফ আর নাইলা। তুমি যে-শিশুটাকে দৌড় করালে, তার জায়গায় তুমি নিজেকে এনে ফেললে। তাই এখনও সেই তিনজন।তারপর তােমার পরিবার আমাদের ছেলেটাকে নিয়ে নিল। এখন শুধু দু’জন। প্রতিদিন এই অসুখটা আমার শরীরে কামড় দেয়, অচিরেই শুধু একজন আর থাকবে। যে-স্বপ্নটা আমাকে সবে জাগিয়ে তুলল, সেই স্বপ্নে আমি মেঝেতে পড়ে। এখন রাত। লােকটা আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার মুখটা গলে গিয়েছে, কিন্তু তার চুলের রেখাটা সাদা চুলের ফ্যানায় পিছন দিকে ধূয়ে এসেছে এবং এখনও তার তেমনই দু’টো শক্তসবল বাহু। তার হাত দুটো ভেজা। সে থলের মুখটা আমার জঙ্ঘা দুটোর উপর দিয়ে টেনে ঘষটে নিয়ে চলেছে। এটা নিশ্চয় সেই ব্যাপার। যখন সে আমার শরীরটা তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। আমরা এখন বাগানে। ধুঁয়ার গন্ধে আমি জেগে উঠলাম।
জে, মুরগীঘরটা জ্বালিয়ে দিল। চারটে মুরগী ভেগে পড়ল, ঠাসাঠাসি হয়ে তাদের ঠাঁই জুটল যেনতেন প্রকারে বানানাে একটা বেড়ার খুপচিতে রাতেই একটা উধাও হয়ে গিয়েছিল, তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল একটা ভাগ্যবান কুকুর। আগুনটার গন্ধ ভালােই; মনে হ’ল মরা মুরগীদের সদ্য পাককরা পুরুষ্ট মাংস। রান্নাঘরের দরজা থেকে জে, লক্ষ্য করল ধু্ঁয়ার শেষ কুণ্ডলীটা উপরে মেঘের সঙ্গে গিয়ে মিশছে। সূৰ্যটা নিজের সময় নিয়ে জেগে উঠল । তার মুখের লালা কেমন যেন তিতকুটি, যখন সে বেসিনে থুতু ফেলল, সে দেখল সেটার রঙ ধূসর। রান্নাঘরের মেঝেয় ছেলেটা কম্বলের উপর শুয়ে ছিল। জে. টেবিলন্টার উপর ঝুঁকে পড়ল, ছেলেটার বুক ওঠানামা করা দেখতে লাগল। তার টিঙটিঙে পা দুটো এখন পরিস্কার, ভেসলিন মেখে চটচটে । জে, পিপড়েদের তার কাছ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিল এবং কামড়ের ফুস্কুরিতে মলম মাখিয়ে দিয়েছিল। জে, এককাপ চা বানাল – ফাইভ রােজেস চা দুধ চিনি ছাড়া – এবং কাপটাকে ট্রের উপর রেখে না চলকিয়ে ফেলে দিয়ে এল। শােওয়ার ঘরটা শুকনাে রক্তের ধাতব গন্ধে ভারী হয়ে ছিল। একটা তামাটে প্রভাত জানালাটাকে আলােকিত: কোয়াচা! গুয়ি মুদ্রার মতাে…।
জে, ঘরে ঢুকতেই লােকটা মুখ তুলে তাকাল। ওই ওটা কিসের আগুন? আমি মুরগীঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। কেন? জে. ট্রেটা পাশের টেবিলে রাখল, এবং ঘর ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হল। আমার কাছ থেকে সরে যেয়াে না। লোকটা থুতু ফেলল। জে, তার জামার আস্তিন দিয়ে মেঝের থুতুটা মুছল। সাদা পিপড়ে, সে বলল । যত সব বাজে কুসংস্কার। লােকটা তার দাঁত চুক চুক করে চুষল। সেই মেছুড়ে ছেলেটা কি এখনাে আছে? এখানে কেউ আসুক। আমি তা চাই না। ওরা বুঝতে পেরে যায় আমি কে আর টাকার জন্যে আব্দার করে। ও জানে না তুমি কে। ওর খুব অল্প বয়েস। ছেলেটার কেউ নাই, জে. বলল। ও আমাদের কাজে লাগতে পারে। লােকটা তার কাপটা তুলল, তার হাত কাঁপতে লাগল। সে গরম চায়ে চুমুক দিল এবং আমােদ পেয়ে মুখ কুঁচকিয়ে তুলল। ছেলেটা চলে যায় । আমি ওইরকম কিছু সহ্য করতে পারি না।
আলাে তামাটে থেকে সাদাটে সােনালি হয়ে উঠেছিল, দিনটা তার আপসেই কেটে চলেছিল। জে, বাইরে সিঁড়ির উপর এসে বসল, বসে কুমড়ো পাতা দিয়ে একটা রান্না করার জন্য বাদামের খােসা ছাড়াতে লাগল । ফ্যাকাসে নীল রঙের ইউনিফর্ম পরে স্কুলের ছেলেরা।
-এদিকে আয়,
লােকটা রুক্ষ স্বরে বলল ।