একগুচ্ছ অণুগল্পে – দেবাশিস ভট্টাচার্য

দেবাশিস ভট্টাচার্য’র জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে সীতাকুণ্ড উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে। পিতা মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী ও সঙ্গীতজ্ঞ। দেবাশিস ভট্টাচার্য বর্তমানে উপ-ডাককর্তা হিসেবে কর্মরত । কবিতা, ছড়া, নাটক সহ সাহিত্যের সব মাধ্যমে সমানভাবে লিখলেও তিনি গল্পকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। আশি দশকের উল্লেখযোগ্য গল্পকার হিসাবে বাংলা একাডেমী ঢাকা, কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নাসরিন জাহান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের গল্প আশির দশক’ গ্রন্থে তাঁর ‘পোকা জাতের মানুষ’ গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়। তাছাড়া দুই বাঙলার শ্রেষ্ট গল্পে তাঁর লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখনও তিনি নিরন্তর লিখে চলেছেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ
আনন্দ মৃত্যুর কাছে
পোকা জাতের মানুষ ও অন্যান্য গল্প
আলোকিত কফিন
বিনয় বাঁশি এক বায়েনের গল্প
জাদুর ঢোল
সুকান্ত দুঃখের বেহালা
দেবেন শিকদার : এক কমরেডের গল্প
পাখিঘর
মেঘপ্লাবন
জল জলেশ্বর

দে বা শি স ভ ট্টা চা র্য-র একগুচ্ছ অণুগল্প

বোমা

গণতন্ত্র কে পিছমোড়া করে বাঁধা হলো একটা ইলেকট্রিকের খাম্বার সাথে, ছেঁড়া প্যান্ট, ময়লা গেঞ্জি গায়ে। চারপাশে মামুরা ঘিরে  আছে,

এই ছ্যামড়া, এইডা তুই কই পাইলি?

এক মামু দিছে।

কোন মামু?

দেখলে চিনমু ..

পলেটিক্যাল আর্মস ক্যাডার, আরেক মামু বলল ..

ক্যান দিছে?

বাস, ট্রাক দেইখ্যা মারার লাইগা ..

হুম..

কত দিছে?

একহাজার দিছে, অপারেশন হইলে আরো দিব ..

হ, নাম কিডা?

হে কয়নায়..

ওইডার ভেতর কি আছে জানস?

পেট্রোল ..

ছুইড়া দিলে দাউদাউ জ্বইলা ওডে ..

মানুষ জ্বইলা যায় ..

ক্যান নিছস?

কয়ডা ট্যাহা পামু ভাইবা ..

মামুরা কওয়া কওয়ি করে ক্রস ফায়ার দিমু নাহি?

বোমাবাজের লাইগ্যা কিসের গণতন্ত্র? 

না, টোকাই মনে হয় ..কথা পাওয়া যাইবো, 

 হেরে গাড়িতে তোল …!

ভোরের গল্প ..মহুয়া

খুব ভোরে আমার ওঠার অভ্যাস।

 ভোরের বাতাস আমাকে নতুন করে আহ্লাদে ভরিয়ে তোলে, জাগায়..!

মেয়েটি প্রতিদিন ফুল নিতে আসে, দেখি কথা হয়না ..

আজ হঠাৎ পথ আগলে দাঁড়ায় সে…

কেগো তুমি দাদাবাবু?

আমি কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম, তার সুরেলা কন্ঠে ফিরে আসি নিজের ভেতর ..

কিছু বলবে..?

ও আচ্ছা.  আমি মানুষ…মেয়ে।

 কেন গো?

এতো লম্বা লম্বা চুল দাঁড়ি..সাধু নিশ্চয় …

আমি হাসি …হা হা ..

তুমি মহুয়া বুঝি?

আপনি আমার নাম জানেন?

হ্যাঁ, প্রতিদিন ফুল নিয়ে যাও, দেখি তো।

আমি আপন মনে বিড়বিড় করি, মেয়েটি তা শুনতে পায়…

মেয়েটি হাসে …!

স্বপ্নময়দা তুমি এসব কি বললে?

মানে?

পৃথিবীর সর্বশেষ একটি কবিতা 

….ঈশ্বর নেই।

ছিঃ তুমি কমিউনিস্ট ….!

বাসন্তী

মাঝখানে একটি নদী ভাগ করে দিয়েছে গ্রাম ও শহর। কপালে ভাঁজ পড়ছে, চুল পাকছে ..আজ আয়নায় মুখ দেখে বাসন্তী। ওপারে ঘরদোর ছিল, ছিল একফালি উঠোন। সেখানে কেত্তন হোত। চাঁদ উঠতো আকাশে ..হঠাৎ এক মড়ক এলো গ্রামে। সে বিমারে প্রায় মানুষ আক্রান্ত হলো, সেবার প্রাণে বেঁচে গেল বাসন্তী। উজাড় হয়ে যাচ্ছে গ্রাম। তারপর প্রাণনাথ নিয়ে এলো জোর করে তাকে শহরে —
এখানে এক চিলতে ঘর। বাতাস খেলেনা।
স্বামী বলেন, এইডা শহর ..এখানে জায়গা কম, মানুষ বেশি …বয়স বাড়ছে বাসন্তীর—-স্বামীকে কাছে পেয়ে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিন —

হঠাৎ শহরে ও বিমার শুরু হলো। একা হয়ে যাচ্ছে সব। এসব আলামত তো ভালো নয় জেনে ভয় পায় সে।

    এভাবেই বুড়ি হয়ে যাবে বাসন্তী। নতুন করে মা হয়ে আসবে অন্য  কেও, চুলও পাকিবে, দন্ত পড়িবে, আস্তে আস্তে খাসিয়া পড়িবে, রঙ দালানের মাটি। 

হয়তো একরাশ বিষন্নতা সাপের মত ঘিরে রাখবে চারপাশ-এক সময় ধীরে ধীরে মৃত্যুকে ডেকে আনবে …

   আজকাল শহর ও নিরাপদ নয়, এখানে ও বিমার, কেউ কাউকে স্পর্শ করছেনা, শূন্য হয়ে যাচ্ছে রাস্তা ঘাট, দোকান পাট সব বন্ধ। টহল দিচ্ছে আর্মি - বাসন্তী ভাবে এবার কোথায় পালাবে..

ছদ্মবেশ

কেমন লাগে দেখি আজ ছেলেকে 

গোঁফ, চুল বাড়িয়ে মুখটি অচেনা

করেছে হয়তো । আসলেই শহরে গেলে সব ছেলে পুলেরাই বদলাইয়া যায়। প্রথমে  চিনতে কষ্ট হয়। সন্ধ্যায় ঘরে বাতি জ্বালিয়েছে হুরমতি। ছাওয়ালডা আইজ আইবো কইলো ঢাকা থিকা।হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দ। একবার, দু ‘বার, তিনবার।

কেডা?

আমি আম্মাজান।

 ছেলে আসছে এতদিনে। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে ছেলে। মা, ছেলেকে দেখে অবাক হয়, মুখে মাক্স, হাতে গ্লাবস।মাথায় টুপি।

এইসব কিগো বাপজান?

বিমার আইছে, বড়ই খারাপ। ঘরত্তুন বাইর অইবানা।

কি কস বাপ?

হ, আম্মা, সাবধানে থাইকতে অইবো। আমাগো গার্মেন্টস বন্ধ কইরা দিছে।

হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। 

হঠাৎ রাতে জ্বর আসে মায়ের, সাথে পুরোনো হাঁপানির সমস্যা। ভয় করতে থাকে আলমের। 

ঘরে আলো কমে যাচ্ছে…

আনাচে কানাচে জমাট বাঁধছে অন্ধকার। বাইরে কুকুর ডাকে। 

এখন শুধু মায়ের চোখ দুটো চেনা যায় —-

অন্ধকারে তীব্রতায় ও চোখের নিজস্ব আলো থাকে যা মৃত্যু ও আটকে রাখতে পারেনা। 

★প্রাণনাথ 

প্রাণনাথের মৃত্যুর সে ভয়ঙ্কর স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনা মোহিনী ..!

তিনদিন পর যখন লাশ ভেসে এলো খবর পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো  তার । পাড়ায় কান্নার রোল। তীরবিদ্ধ হরিণের  মত দৌঁড়ে ঘাটে যায় সে। 

হরিকাকা কোলে মাথাটা নিয়ে বসে আছে। লবন সমুদ্রে একটুও পচেনি তার দেহ, মাছেও বিকৃত করেনি কোন অঙ্গ ..ঝাঁপিয়ে পড়ে মোহিনী উন্মাদিনীর মতো তার প্রাণনাথের ওপর…!সে কি কান্না তার ..!

অনেকক্ষণ আকুল হয়ে কাঁদে সে ..

তারপর পাড়ার বয়স্করা সবাই এসে প্রাণনাথকে শেষ স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে  শশ্মানের জায়গাটায় আনা হয় ..সবার সাথে মোহিনীকেও দুজনে ধরে নিয়ে আসে। তারপর চিতা সাজানো হয় আম কাঠ দিয়ে…….শেষ স্নান করিয়ে তার 

প্রাণনাথকে তুলে দেয়া হয় …চিতায় …..

হা হা হা…চারদিকে  শুধু  ক্রন্দন ধ্বনি ….

.বাতাসে মাংস পোড়া গন্ধ ..

চোখের সামনে এক এক করে পুড়ে যায়

প্রাণনাথের রক্ত মাংস হাড়গোড় ফুসফুস…..

পাড়ার মেয়েগুলো জোর করে মুছে দেয় মোহিনীর কপালের সিঁদুর ….

..হাতের শাঁখা ভেঙে রাগে দুঃখে তা ছুঁড়ে মারে সে , 

মা গঙ্গার বুকে ..

তারপর বিধবার কাপড় পড়িয়ে তাকে নিয়ে আসা হয় ঘরে।

সেদিন শ্মশান ঘাটের, প্রাণনাথের শেষ চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে তার বুকের ভেতর …!

সে আগুন কিছুতেই নেভাতে পারেনা মোহিনী…!!

★মিনাক্ষীর বাড়ি

বাড়িটিতে আজ আর কেউ নেই। সামনের বাগান ঘিরে ঘাস আর জঙ্গলের বিস্তার ..ক্লান্ত ঘুঘুর আর্তরব। এ বাড়ির মেঘ বৃষ্টি, রোদছায়া, ধূলোবালি তোমাদের কথায় বলে মিনাক্ষী….

খালপাড় দেখে এলাম, সব ঠিক আছে, কেবল তুমি নেই। এখনো চন্দ্রিমা হয়, রথের মেলা বসে, তোমার অপেক্ষা করি –মাধবী ফুল এনেছি তোমাকে দেব বলে —

কবে ফিরবে তোমরা? নির্জন বাড়িটা ঘুমে ডুবে গেলে একপাল বিশ্রী নির্জনতা নিয়ে কুকুরটা সামনের বারান্দায় বসে কেঁদে ওঠে …!!

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *