মৌমিতা জানা মণ্ডল-এর কবিতাগুচ্ছ

মৌমিতা জানা মণ্ডলের জন্ম ৬ই জানুয়ারী ১৯৮৫। ইংরেজী সাহিত্যে এম. এ.। পেশা শিক্ষকতা।ছোটবেলা থেকেই সৃষ্টিশীল পরিমণ্ডলের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠার জন্যই কবিতার আঙিনায় পা রাখা।লিখেছেন বাংলা ও বহির্বাংলার নানান লিটল ম্যাগাজিনে। কাব্যগ্রন্থ-গতজন্মের আলো। সম্পাদিত কবিতা বিষয়ক পত্রিকা -অন্তর্লীন। 

মৌ মি তা জা না ম ণ্ড ল-এর কবিতাগুচ্ছ

চিত্রিত সত্তা

পরদিন সকাল হতেই, পাহাড়ের সারি বাঁ দিকে রেখে রাস্তাটা চলল আরো গভীরে
সদ্য শেষ হওয়া বৃষ্টি তখন দোল খাচ্ছে
উঁচু ঝোপে…..
ঢালু পথে বিছিয়ে ছোটো ছোটো পাহাড়ী ফুল

রাস্তা পেরোতেই ক্রমে উঁচু হতে লাগলো পথটা
কিছুটা দূরেই নির্জন খসে পড়া স্মৃতি….
প্রহরীর মতো জেগে রঙচটা জমিদারি—

পাশেই একদল গৈরিক নব্যযুবক
হাঁটছে, ফিরছে, নীরব মন্ত্রের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মনাস্ট্রির প্রান্তে প্রান্তে  
উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাদের জোড়া জোড়া দৃষ্টি
পাহাড়ের কোলে যেন ঈশ্বর দল বেঁধে নেমে এসেছেন…..
                    চোখ ঘন হয় ঘুমে

তখন সন্ধ্যা নামছে….কুঁড়ি জেগে উঠছে ধীরে ধীরে, তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে দেখছি….
                        মুন্ডিত মস্তকে এক যুবা

লাঠি হাতে পার হচ্ছে অগম্য সে পথ, এগিয়ে চলেছে একটানা…
ভগ্নাংশের মতো ভেঙে চিত্রিত হচ্ছে পার্থিব সত্তা…কখোনো যশোধরা, কখোনো সুজাতা…

সত্যের খোঁজে

লকেটের মতো ঝুলে পূর্ণিমা
নুয়ে পড়া আলো, ছায়া হয়ে জমা হয়
ছেঁড়া চালে
জীবন চর্যা তখন ভোরে ফোটা
কাঞ্চন ফুলের অপেক্ষায়
আধফোটা কুঁড়ি দল বেঁধে…বেঁধে
ঘন হয় দূরের কোনো শ্রমণ কক্ষে…

গ্রাম্যপ্রান্তে তখন আধবোজা তাপস
এগিয়েই চলেছে ক্রমশ,
অনন্ত এক সত্যের খোঁজে…..

পরমান্নের ঘ্রাণ

হরিনামে সরব দুটি আধাপুরুষ, 
বসনে বৈরাগ্য, কপালে তিলক…

দুপুরটি ভাঙা। মেয়েটি রাঁধছে পরমান্ন…
ছোটো ছোটো রোদ ছায়া উঠোন জুড়ে
আলো খেলা শেষ হলে কবুতর দল বেঁধে
জমা হয় মেয়েটির নীড়ে…

বৈরাগ্য দেখানো পুরুষ, ঠিক তখনই হেরে যায়
পরমান্নের ঘ্রাণে…..

খোঁজ

বোবা বাউলিনীর চোখে রাত নামলে
গান্ধর্বে নতজানু হয় গার্হস্থ
আত্মমোহে প্রবেশ করে রিপু

একতারা হাতে বাউলিনী সুর খোঁজে—-
তর্জনীতে বেজে ওঠে ভৈরবী ঠাট
গুহা মুখে তখন ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী
অসীম ত্যাগে ক্ষয়িষ্ণু  প্রায়…..

আলগোছে উড়ে যায় অগোছালো কেশদাম
অনন্ত এক খোঁজে দুজনেই….

জাতক ঘ্রাণ

জাতক ঘ্রাণে ভ্রম নামে
প্রজ্ঞাপারমিতার অজানুলম্বিত কেশরাশিতে
চঞ্চল হয় পল্লবদল

প্রিয় নারী, ইশারা কুড়িয়ে
ডুব দিচ্ছে একান্তে
দৈবতাপে চবচবে আপাদমস্তক
দ্বিতীয় প্রহরে অমাবস্যা নামলে
নির্জন তারারা খসখস করে সরে যায়
পুব থেকে পশ্চিমে….

শান বাঁধানো ঘাটে তখন, ত্রিনয়নী বেলপাতা
আঁকছে নারীর তৃতীয় চক্ষু

মঙ্গল দাগ

সাঁঝবাতি জ্বলে উঠলেই
দৈবআলোর কাঁপা কাঁপা ছায়া
অবনত লাজে নেমে আসে গোবর নিকানো বারান্দায়
পথ হারিয়েছে সন্ধ্যামনি
ক্রমে নিবিড় হয় চারপাশ
তোমার গভীর নাভি জল ধরে আছে একযুগ
একতারায় সুর তুললেই আলগা হয় গ্রন্থি
কানের লতি ছুঁয়ে আজন্মেরর মঙ্গল দাগ

মানস মৈথুন

মুঠো মুঠো আলো। বাঁশ ডগা নুয়ে পড়ে
সামনের রাস্তায়–
চাঁদ তখন মাথার ওপর চুপচাপ
চন্দনে চর্চিত এক অস্টাদশ চলেছে টান মারতে
মন্দিরের শল্ক….
পলকে জেগে ওঠে বহুযুগের গোত্রমন্ত্র
জাগ্রত সনাতনীর চোখে চোখ রাখলে
ভেসে ওঠে লোহিত, পিঙ্গল বর্ণের মনিরত্ন

অনুচ্চারিত শব্দে যখন কেঁপে ওঠে মন্দিরের জীর্ণ শরীর—-রজনীর শেষ প্রহরে নড়ে ওঠে মানস মৈথুন
নৈশ আলোয় ক্রমে স্পষ্ট হয় 
এক প্রণয় ষোড়শী…..

মাতৃ তর্পন

যুবতী ত্বক, সন্ন্যাসীর গায়ে
চোখে আশাবরী রাগ, ঠোঁটে অতৃপ্তি…
মাথার ওপর বয়ে যায় শীর্ণ বায়ুদল

আলুথালু মেয়েটি আঁচলে ছাঁকছে নির্জন প্রহর
 খোলা পিঠে চাঁদ জেগে
জোড়া হাতে মেয়েটি অপেক্ষায়…
ক্রমে উজ্জ্বল হয় ভোর

সন্ন্যাসীর চোখে চোখ রেখে নীরবে শেষ হয় মেয়েটির মাতৃতর্পণ…

ঝুলন

বৈধব্য নামা পূর্ণিমায় ঝুলন লাগলেও
আমার ঠাকুমা, আজীবন তা আগলে রেখেছিল
তার সাদা থানে
রাত বাড়লে শ্রীখোল নিয়ে বসে পঞ্চমী
পদসঞ্চালনায় মায়াবী রাত উঠে আসে…..
নিসঙ্গ হয় মানবী
শুদ্ধ নারীত্ব হারিয়ে দেয় রাগ রাগিনীদের

উদাত্ত গলায় বেজে ওঠে শ্রান্ত বাজনা
পলে পলে জ্যোৎস্না ছুঁলেও
রাত কেড়ে নেয় বৈধব্য…

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *