লেখালেখির সূচনা ছোটবেলা থেকেই মূলত মায়ের উৎসাহে। কবিতা লিখেই প্রথমে শোনাতাম মাকে। মা আমার ছন্দ ঠিক করে দিতেন। কোন শব্দ বদলের দরকার হলে তাও বলে দিতেন। এভাবেই শুরু। বাড়িতে আসত অনেক পত্রপত্রিকা। জেলার এবং জেলার বাইরের। পড়তাম। কিন্তু পত্রিকায় লেখা পাঠাতে ইচ্ছে করত না। একদিন দুম করে সংগঠন পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ফেললাম। মানভূমকেশরী বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( পরে স্বামী অসীমানন্দ সরস্বতী নামে সর্বাধিক পরিচিত হন ) তিনি ছিলেন নেতাজীর স্নেহধন্য । সংগঠন পত্রিকার সম্পাদক। লেখা ছাপা হয়ে গেল পত্রিকায় । সদ্য স্বাধীন হয়েছে ভারত।সেই প্রেক্ষিতেই লেখা একটি কবিতা
চাই না মোরা এমন স্বাধীনতা
চাই না ওরে চাই না মোরা এমন স্বাধীনতা থাকতে যেথা পারি না তাই উচ্চে তুলে মাথা উচিত কথা বলবে যবে জেলের মাঝে পুরবে তবে স্বীকার তখন করতে হবে ওদেরই বশ্যতা- চাই না ওরে চাই না মোরা এমন স্বাধীনতা । খুব সম্ভবত এরকমই ছিল প্রথম প্রকাশিত কবিতার ভাবনা। এরপর ধীরে ধীরে কবিতার জগতে পা রাখা।
আপনার ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে কিছু বলুন।
এ তো এক কথায় বলা মুশকিল। আমার ব্যক্তিজীবন অত্যন্ত সংগ্রামমুখর। তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে কেটেছে কৈশোর আর যৌবনের দিনগুলি। বাবা ছিলেন আদর্শবাদী শিক্ষক। মানভূমের মানুষের উপর যখন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল হিন্দি। তখন বাংলার বদলে হিন্দি পড়াতে অস্বীকার করায় চার বছর বেতন বন্ধ হয়ে যায় বাবার। দিনের পর দিন শাসকের দমন পীড়ন নীতি। এই পরিস্থিতি আমাকে আকৃষ্ট করে কবিতার দিকে। মানভুমের ভাষা আন্দোলনই আমার ভেতর কবিতার বীজ বুনে দেয়। একদিকে বিদ্রোহ অন্যদিকে নিজস্ব ভাষার প্রতি ভূখন্ডের প্রতি ভালোবাসা। কবিতা লেখার জন্য বারবার নেমে এসেছে আক্রমণ । যেহেতু সামন্ততান্ত্রিক বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে আমার কবিতা তাই বারবার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির শিকার হতে হয়েছে আমাকে। হাত ভেঙেছে পা ভেঙেছে বারবার। মৃত্যুর মুখ থেলে ফিরে এসেছি তিনবার। আজ অসুস্থতা আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে এখনও লড়াই করেই বেঁচে আছি জীবন জীবন নয়কো জীবন ভাগ্যের ক্রীতদাস আমি লিখে যাই নবজীবনের নির্মম ইতিহাস। আমিই লিখেছিলাম কবিতায় একসময়। এই কবিতার মধ্যেই ধরা আছে আমার জীবন।
কোনও বিশেষ স্মৃতি যা আপনাকে আন্দোলিত করে আজও..
স্মৃতি এখম আর ততখানি সক্রিয় নেই তবু যতদূর মনে পড়ছে ১৯৬৪ -৬৫ সালে রামচন্দ্রপুরে নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র সহ এক ঝাঁক উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তখন সামান্যই লেখালেখি করি। কোন বইও হয়মি। আমার কবিতা নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রশংসা করেছিলেন। তারাশঙ্করবাবু আশীর্বাদ করেছিলেন। তরে তাঁরা কয়েকটি চিঠিও লিখেছিলেন। বিয়েতে শুভেছাপত্র পাঠিয়েছিলেন। এঁদের আশীর্বাদ আমাকে আজও আন্দোলিত করে।
কিছু কিছু খারাপ লাগা যা আমাদের বহন করতে হয় আজীবন।এমন কিছু খারাপ লাগার কথা বলুন যা আপনি বহন করছেন..
খারাপ লাগার স্মৃতি সে তো প্রচুর। অনেক জ্বালা আছে। যা ভোলা যায় না। খুব কম বয়স থেকে কবিতা লিখতাম। যেহেতু অজ পাড়া গাঁয়ে থেকে সেই সময় লিখতাম। তাই অনেকে একে বাঁকা চোখে দেখত। এমনকি অনেক শিক্ষক মশাইও তাচ্ছিল্য করতেন বিদ্রুপ করতেন। ফলে স্কুলে যাওয়া আমার কাছে একসময় হয়ে উঠেছিল বিভীষিকা । এই দিনগুলো আজও বহন করি রক্তাক্ত হই।
একজন সফল ছড়াকার (বর্তমানে সরকারি পাঠ্য পুস্তকে আপনার ছড়া পড়ানো হয়)হিসেবে আপনার অনুভূতি..
ছড়া দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ অবধি কবিতাই হয়ে ওঠে আমার আশ্রয়। আজ মনে হয় শুধু ছড়া লিখলেই ভালো হত। ছোটদের জন্য হাজার খানেক ছড়া আমি লিখেছি শিশুসাথী, রামধনু, মৌচাক, সন্দেশ, কিশোরভারতী, শুকতারা, ডানপিটেদের আসর, হোমশিখা, সহ অজস্র ছোটদের কাগজে তা গ্রন্থভূক্ত হল না বলে আফসোস আছে। শিশুমনের রঙ ও অনুভূতি আজও আমাকে আকৃষ্ট করে।
অদ্যবধি আপনি যা পেয়েছেন তার একটা তালিকা করা হলে (কম বেশির নিরীখে) কি ভাবে সাজাবেন??
পাওয়া বলতে সরকারি বেসরকারি বেশ কিছু পুরস্কার জুটেছে প্রায় আড়াইশোর মতো সেসব আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক গুণিজনের সান্নিধ্য পেয়েছি। সারা বাংলার যেখানেই গেছি প্রচুর মানুষ আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে বুকে। আজও যখন কোন তরুণ কবি মুগ্ধ হয়ে জানায় আমার কাব্যপাঠের অনুভূতি তখন মনে হয় এই টুকরো টুকরো ছবিগুলোই মানুষের প্রাপ্তি।
আপনার না পাওয়া কি কিছু আছে?? থাকলে সেটা কি??
প্রত্যেকেরই অপ্রাপ্তির তালিকা দীর্ঘ। আমারও। যা লিখতে চেয়েছিলাম সেই মনের মতো লেখাটি যেন অধরাই থেকে গেল। যে সমাজের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হলাম যৌবনের দিনগুলি ক্ষতবিক্ষত হল সেই স্বপ্ন তো স্বার্থক হল না। রূপ পেল না। তার মানে এই নয় যে জীবন অসফল। যারা আর্থিক স্বচ্ছলতার বদলে রোদ্দুরের স্বপ্ন দেখে অমলকান্তি হতে চায় তাদের স্বপ্ন এক প্রজন্মে সফল হওয়ার নয়।
সরকারের পক্ষ থেকে আপনার পাশে কি দাঁড়িয়েছে?? দাঁড়িয়ে থাকলে কি ভাবে? আর না থাকলেই বা কেমন ভাবে বা কি ভাবে চান?
তার দরকারই তো হয়নি। ফলে দাঁড়ালো কী দাঁড়ালো না এ নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না।
আপনার পাঠক কারা?
আমার পাঠক সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ। একদিকে কবি অধ্যাপক শিক্ষিত বিশিষ্ট জনেরা যেমন আছেন আবার আছে প্রান্তিক শ্রমিক কৃষকেরা। যেহেতু আমি মানচিত্রগত ভাবে প্রান্তিক পরিসরের তাই মাটির কাছাকাছি মানুষের কথাই লিখতে চেয়েছি যা মানুষকে স্পর্শ করেছে।
ছড়াকেই কেন মূল মাধ্যম হিসেবে আপনি বেছে নিলেন?
ছড়া আমার শিল্পচর্চার মূল মাধ্যম নয়। আমি কবিতাই লিখেছি। যদিও ছড়াও আমার কাছে শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এক ধারা।
আপনার নজরে প্রিয় ছড়াকার, কবি,সাহিত্যিক।
প্রিয় ছড়াকার সুকুমার রায় প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রিয় সাহিত্যিক মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়
কার বা কার কার লেখা আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে?
রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে জীবনানন্দ বিনয় মজুমদার তারাপদ রায় রাণা চট্টোপাধ্যায় তো আছেনই। নতুনদের মধ্যে প্রচুর ভালো কবিতা পাচ্ছি। এরা কম বেশি সকলেই আমাকে পড়তে বাধ্য করে।
ব্যক্তিগত জীবনে আপনি কতটা প্রভাব অনুধাবন করেন একজন ছড়াকার হিসেবে?
ছড়া লিখলেও যেহেতু ছড়ার কোন বই প্রকাশিত হয়নি বরং ২৫টি কবিতার বই হয়েছে। প্রবন্ধের বই ছড়ার বই আর হয়ে উঠল না। প্রভাব ঠিক নয়। প্রচুর ছড়া যেমন পড়েছি। লিখেওছি সেভাবে। নিজস্ব স্টাইলে প্রকরণে।
আপনার পাঠকদেরকে কি কিছু বলার আছে?তবে বলতে পারেন।
পাঠকদের বার্তা দেওয়ার কিছু নেই। তাঁদের মেধা ও নির্বাচনের উপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে আমার।
আপনার জীবন নিয়ে একটা সম্যক ধারনা দিন আপনার পাঠকদের সম্পর্কে
আমার জীবন নিয়ে পাঠক কী করবেন ? তাঁরা কবিতা যদি কিছু লিখে থাকি সেখানেই খুঁজুক আমাকে।
ননসেন্স রাইম একটা নতুন ধারা বাংলা ছড়ায়। তার আগেও অনেক সমৃদ্ধ ছড়া আমরা পড়েছি রবীন্দ্রনাথের যোগীন্দ্রনাথ সরকারের। তা উজ্জ্বল অম্লান। তবু ননসেন্স রাইম একটা বাঁক একটা নতুন ঢেউ। হাসি মজার পাশাপাশি একটা ধাক্কা যা আমাদের সচকিত করে।
বর্তমান সময়ে কোন কবি ছড়াকার সাহিত্যিক আপনাকে আলোড়িত করেন?
এখন ভবানী ভালো লিখছে। ভবানী তো ছড়ার জগতে একটা মাইলস্টোন । শ্যামলকান্তির ছড়া শিশুদের স্বপ্ন জগতের কথা তুলে আনে। দীপ ভালো লিখছে। অপূর্ব দত্ত ভালো লিখত। হাননান আহসান আনসার উল হক এরকম আরও অনেক নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না। এরা সবাই আমাকে আলোড়িত করে।
নতুন যাঁরা লিখতে আসবেন বা এসেছেন তাঁদের জন্য আপনার কিছু পরামর্শ?? (বিশেষত ছড়াকারদের প্রতি)
মন দিয়ে লিখুন। সৎ ভাবে লিখুন। কোথাও আপস করবেন না। নির্ভিক ভাবে লিখে চলুন হৃদয়ের শব্দ।
লেখার কথা তেমন ভাবে ভাবলেন না কেন?? (শিশু কিশোরদের ওপর)
ভেবেছি তো। হাজার খানেকের উপর ছড়া লিখেছি। তার কিছু হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে।কিছু আছে। কিছু ছড়া সংকলন ভুক্ত হয়েছে। অনেকে পড়ে আবৃত্তি করে। আমার ভাবনা আমি ভেবেছি বাকি দায়িত্ব প্রকাশকের।
আমার সব লেখাই আমার প্রিয়। তবু মানভূমের লোকভাষায় লেখাগুলি আমার অধিক স্নেহের। এখানে আমি ব্যক্তিমানুষের চেয়েও হয়ে উঠেছি সামষ্টিক মানুষের প্রতিনিধি। এক আমির ভেতর অনন্ত আমির ছায়া। আত্মবৃত্ত থেকে বাইরে বেরিয়ে বিশ্বলোকের সাড়া অনুভব করেছি এইসব কবিতায়। ভালো থেকো গৌতম। তুমি প্রশ্ন করেছিলে কবিতা লিখে পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে। কবিতা লিখে একক মানুষের হৃদয় হয়তো এভাবে সমষ্টির বাসভূমি হয়ে উঠে। এক আমি হয়ে যায় অনন্ত আমি।