পরবর্তী অংশ
বাংলার পটের গল্প
লিখছেন- বর্ণালী রায়
লেখিকার পায়ের তলায় সর্ষে।আজ পুরুলিয়ার এই মেলাতে তো কাল ইতিহাসের হাত ধরে পৌঁছে যায় মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজারাজড়ার কোনও অলিন্দে।”গরীবের ঘোরা রোগ” বারবার তাঁর তথ্য তত্ত্ব ও ভিন্ন দর্শনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর সম্প্রতি এই ছোট ছোট ভ্রমণের চোরাকুঠরির সমন্বয়ে বর্ণিক প্রকাশন থেকে সম্প্রতি “ভ্রমণ-যাপন১”
শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।পাঠকরা সংগ্রহে রাখতে পারেন।চেনা পৃথিবীর অচেনা দর্শন।
পটচিত্র প্রাচীন ভারতের অন্যতম চিত্রশিল্প।
তৎসংলগ্ন পটুয়াদের গান সুপ্রাচীন।সেই সময় থেকে পটের গান আজও প্রচলিত।পটুয়া সঙ্গীত বাংলার এক প্রাচীন লোকসঙ্গীতের ধারা। পটচিত্রকর তথা পটুয়ারা লৌকিক ও পৌরানিক কাহিনি অবলম্বন করে বিভিন্ন ধরনের পটচিত্র অঙ্কন করেন এবং পটের কাহিনিকে ঘিরে সঙ্গীত রচনা করেন। এই সকল গান তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সঙ্গে পবিবেশন করেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য পল্লী অঞ্চলগুলিতে পটুয়া সঙ্গীতের প্রচলন দেখা যায়।পটুয়া সঙ্গীতের প্রচলন পূর্বে সম্পূর্ণ রাঢ় অঞ্চলে থাকলেও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের পিঙ্গলা ব্লকের নয়াগ্রাম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ জেলায় এই গীত শোনা যায়। পিঙ্গলা ব্লকের নয়াগ্রাম এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে এখনও দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। এখানকার প্রায় পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নটি পরিবার পটশিল্প ও পটুয়া সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত আছে।
পটুয়ারা একাধারে যেমন চিত্রশিল্পী,তেমনি অন্যদিকে সঙ্গীত রচয়িতা ও সেইসঙ্গে গায়ক।সুতরাং পট যেমন লৌকিক তেমনি পটের গানও লোকগীতিকাস্বরূপ।বহুক্ষেত্রে রামায়ণ-মহাভারত থেকে আহৃত পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দযুক্ত বিষয়গুলি নিজেদের মনোমত পরিবর্তন করে নতুনভাবে পটের গান রচনা করতেন।গান অনুযায়ী পট আঁকা হয়,কিন্তু পটুয়াসমাজে এ গানের কোন লিখিত রূপ নেই,পটুয়ারা প্রকৃতপক্ষে পিতা-পিতামহদের কাছ থেকে শুনে গান শিখে নেন্।পটশিল্পীকে যে গাইয়ে হতে হবে এমন কথা নেই।অনেক পটুয়া চমৎকার গান করেন কিন্তু পট আঁকতে জানেন না।পটশিল্পীরা চিত্র্কর সম্প্রদায়ভুক্ত্।এই গানের সুর পূর্ব প্রচলিত,যদিও রচয়িতার নাম গানে উল্লেখ করা হয়না,কন্ঠভেদে গানের সুর কিছু বদলায়।বাঁকু পটুয়া যে সুরে গান করেন তাঁর শান্তনু পুরোপুরি সেই সুর অনুসরণ করেননি,কিছুটা বদলালেও মূল সুরটি সহজেই বোঝা যায়,পটের গানের কথাও হুবহু অনুসৃত হয়না।
গুরুসদয় দত্ত পটের গান কে গীতিকা বলেছেন্।গীতিকা ইংরাজি “ব্যালাড” এর তুল্য,গীতিকার সঙ্গে পটের গানের মিল দেখা যায়,উভয় গানেই সুরের থেকেও কাহিনীর গুরুত্ব বেশী।পটের গানে দু ধরনের চিত্র আছে-গানের নির্মিত চিত্র ও পটুয়ার অঙ্কিত চিত্র।পটের গান মৌখিক ঐতিহ্যাশ্রিত যেখানে কাহিনীকে সুর ও কথা যোগে উপস্থাপিত করা হয়।পটের গানে মূলত সীমিত সময়ের মধ্যে অঙ্কিত চিত্রগুলি নির্ভর করে সঙ্গীত পরিবেশিত হতে দেখা যায়।পটের গান একান্তভাবে উদ্দেশ্যমূলক রচনা,নীতি ও মূল্যবোধের প্রচার এর মূল লক্ষ্য।
গুরুসদয় দত্ত মহাশয় “পটুয়াসঙ্গীত” গ্রন্থে পটের গানের সংগ্রহ প্রকাশ করেছেন।গানগুলি মুখে মুখে ফেরে বলেই মূলরূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন।বীরভূমের লোকসংগীতে আক্ষরিক ভাবে হুবহু পটের গানের পংক্তি এসেছে আবার পটের গানেও ঢুকে পড়েছে লোকসঙ্গীতের কথা ও সুর।সম্প্রতি পটের গানে হিন্দী ছবির গানের সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।পটুয়ারা পট দেখানোর জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নেন যেখানে দশটা বাড়ির লোক একজায়গায় এসে গান শুনতে পারেন।এখন পটের গানকে আকর্ষনীয় করে তোলবার জন্য পটুয়ারা ঢোল,ডুগডুগি,ডুবকি,করতাল ইত্যাদি ব্যাবহার করেন।কেউ কেউ পটের গান গাওয়ার আগে ফিল্মের গান ও শোনান্।বরুণ পটুয়ার মতে এই বিষয় গুল না কর্লে কেউ এখন আর পট দেখতে চায়না।প্রকৃতপক্ষে পটের গানে এখন বিশুদ্ধ বাণীরূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
খালি গলা এবং কিছু লোকবাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে পটচিত্র দেখাতে দেখাতে এই গান গাওয়া হয়। পটুয়া সঙ্গীত বা পটগীতিকে সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলি হল লীলা কাহিনি, পঞ্চ বা পাঁচ কল্যাণী এবং গোপালন বিষয়ক গীতিকা।
লীলা কাহিনি
কৃষ্ণলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, রামলীলা, শিবপার্বতীলীলা ইত্যাদি এই লীলা কাহিনি মূলক সঙ্গীত।
কৃষ্ণলীলা পটের গীতি নমুনা:
“ হরি বিনে বৃন্দাবনে আর কি ব্রজে শোভা পায়।
জলে কৃষ্ণ স্থলে কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহিমন্ডলে।। ”
পঞ্চ বা পাঁচ কল্যাণী
এই পর্যায়ের সঙ্গীতগুলি কোনো বিশেষ লীলা কাহিনি বা আখ্যায়িকা অবলম্বনে রচিত হয় না। এখানে নানা দেব-দেবীর সম্ভন্ধে ছড়ার পাঁচমিশালি সমাবেশ ঘটে।
পঞ্চকল্যাণী গীতির নমুনা:
“নম মহেশ্বর দিগম্বর ঈশান শঙ্কর।
শিব শম্ভু শূলপাণি হর দিগম্বর।।”
গোপালন বিষয়ক গীতিকা
গো-পালন গীতিগুলিতে কপিলার মর্তে অবতীর্ণ হতে প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ ও পরবর্তিতে মনুষ্যজাতির সেবার জন্য দেবগণের সনির্বন্ধ মিনতি এখানে গীত হয়।
কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, শিবের শঙ্খ পরানো প্রভৃতি সঙ্গীতে বাংলার স্ত্রী-পুরুষ ও জীবনের এক নিখুঁত প্রতিকৃতি রচিত হয়েছে। ধর্ম, দর্শন ও পুরানের মূল তত্ত্বগুলি যে বাঙালি হিন্দুসমাজে খুব সহজভাবেই সঞ্চারিত হয়েছে তা পটুয়া সঙ্গীত থেকে সহজেই বোঝা যায়। রামের বিবাহে ছাদনাতলা অথবা পার্বতীর কাছে সব অলঙ্কারের চেয়ে যে শাঁখার মর্যাদা বেশি তা পটুয়া সঙ্গীতে ফুটে ওঠে।
ছাপাখানার আবির্ভাব ও বর্তমানে বিনোদনের বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম প্রচলিত হওয়ায় পটচিত্র মাধ্যমটি বিলুপ্ত প্রায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় আশুতোষ জাদুঘর ও গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালায় এবং বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে লোকশিল্প জাদুঘর ও বাংলা একাডেমিতে কিছু পটচিত্র সংরক্ষিত আছে। পটচিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণে যাঁরা অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে গুরুসদয় দত্ত ও দীনেশচন্দ্র সেনের ভূমিকা ও অবদান স্মরণযোগ্য। তাঁরা কেবল পটচিত্র সংগ্রাহকই ছিলেন না, ছিলেন এর একনিষ্ঠ প্রচারকও। যে শিল্পীরা পটচিত্রের শৈলীকে শিল্পমর্যাদা দিতে সচেষ্ট ছিলেন তাঁদের মধ্যে যামিনী রায় ও কামরুল হাসান অগ্রগণ্য। আমরা জানি যে কামরুল হাসান নিজেকে ‘পটুয়া’ বলে পরিচয় দিতেই স্বাছন্দ্য বোধ করতেন।সম্প্রতি যিনি বাংলাদেশে পটচিত্র নিয়ে কাজ করে দেশে-বিদেশে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি শম্ভু আচার্য। মুন্সিগঞ্জের রিকাবীবাজারের কালিন্দি পাড়ার নিজ বাড়িতে শম্ভু আচার্য তাঁর পটচিত্রের শিল্পচর্চা করে যাচ্ছেন। তাঁর কাছ থেকে জানা যায় প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তাঁরা পটচিত্রের কাজ করছেন। তিনি পটচিত্র শিল্পধারার নবম পুরুষ।গ্রামবাংলার এই নিষ্ঠাবান শিল্পীরা তাঁদের শিল্পশৈলী নিয়ে নগরজীবনেও প্রবেশ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পট, সাহেব-পট, বাবুদের ব্যঙ্গ-পট, পরিবার পরিকল্পনা পটও তাঁরা নির্মাণ করেছেন। পশ্চিমাধারায় শিক্ষিতজনেরা পটশিল্পীদের মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে কালক্রমে গ্রামবাংলার এই বলিষ্ঠ শিল্পধারাটি আজ বিলুপ্তপ্রায়।আজকাল পটচিত্রের লোকজ ঐতিহ্য দ্রুত নগরায়নের ফলে ক্ষীণ হয়ে আসছে। লোকালয়ের বেশিরভাগ মানুষ এখন আরও লাভজনক পেশার কাজ বেছে নিচ্ছে।এই ধরনের লোক শিল্পের অবক্ষয়ের ধারা বাংলার কৃষ্টিকে বিপন্ন করে তুলছে।পটশিল্পের ঠাঁই হয়েছে মেলায় আর আর পোশাকে।কিন্তু সেটা এই শিল্পকে ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে কি?