গল্পঃ লেড়ি কুকুর ও বি পি এল কার্ড।

পরিচিতিঃ
প্রকাশিত মোট গ্রন্থ সংখ্যা:- মোট সাতটি
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা: চারটে কাব্যগ্রন্থ
লেখালেখি শুরু:আটের দশকে।
প্রথম লেখা প্রকাশের সন: স্কুল ম্যাগাজিন।১৯৭৬ সালে।
জন্ম:- ৯ অক্টোবর ১৯৬৪ সাল।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
আকাশবাণী কলকাতার নাট্যশিল্পী।
প্রকাশিত কবিতার বই :-
১) নি:শব্দের শব্দ রা
২)মুঠোয় ভরেছি খেয়ালপোকা
৩)দাহ
বিপ্লব চক্রবর্তীর প্রকাশিত গল্পের বই
৪) রং বদলের রং।। সুতরাং প্রকাশনা
৫)স্যান্ডউইচ,ও সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক।। রূপকথা প্রকাশনা
বিপ্লব চক্রবর্তী র উপন্যাস
“পাঁচী ঠাকরুণের থান”- মর্ডান কলাম।কলকাতা।
★রামমোহন লাইব্রেরি থেকে তিনবার পত্রিকাগত ভাবে পুরস্কার পেয়েছেন।
★ব্যক্তিগত পুরস্কার পাই ভাষামুখ স্মারক সম্মান 2016সালে।
★সম্মাননা বাংলা কবিতা উৎসব ২০১৩।
(বাঙালি সংস্কৃতি কেন্দ্র)
জাতীয় কবিতা পরিষদ, মৌলভীবাজার সিলেট
★২০২০ সালে আরাত্রিক সম্মান প্রাপ্তি।
জন্মস্থান :৭৩৩/৩ কাঁকপুলঅশোকনগর কল্যাণগড়
জেলা:- উত্তর ২৪ পরগনা
সূচক:-৭৪৩২৭২

লেড়ি কুকুর ও বি পি এল কার্ড

বি প্ল ব চ ক্র ব র্তী

গগন ভান্ডারি অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো ।সামনে এখনো প্রায় কুরি বাইশ জন।তারমধ্যএ কযেকজন সুন্দরী মহিলাও আছেন।গগন লক্ষ্য করছে চেয়ারে বসা সরকারি লোকটি মহিলা দেখে দেখে সময়টা বেশী দিচ্ছেন ।কাজের বাইরেও অতিরিক্ত কৌতূহল প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করছেন,” বাড়িতে কে কে আছেন আপনার? আপনি আসেন কেন?অন্যকাউকে পাঠাতে পারতেন!” স্রেফ খেঁজুরি করা।অন্যদের মতো গগনও লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারি বাবুটির কথা আলাপ ব্যবহার লক্ষ্য করে যাচ্ছেন।মাথাগরম করা যাবেনা।এই সরকারি অফিসারটির কলমের উপরেই লাইনে দাঁডাবার সার্থকতা আসবে।

          গগন উল্টো সমস্যায় পড়েছে ।একটা লেদ কারখানার হেডমিস্ত্রি ও।মালিকের থেকে একঘন্টা সময় চেয়ে নিয়ে এসেছে।নতুন লেবারটাকে দুটো গ্রীলের সেট কেটে ফর্মা করে দিয়ে এসেছে।বলে এসেছে ,”ড্রয়িং দেখে  সেটিং করে এ দুটো ঝালাই করতে থাক,তার মধ্যেই আমি পৌরসভা থেকে চলে আসব”! এর মধ্যেই মালিকের তিনবার ফোন চলে এসেছে।প্রথম দুবারে বলেছে,”হ্যাঁ দাদা,লাইনটা বড় পড়েছে ।একটু সময় বেশী লাগবে।” তৃতীয়বার মালিকের ফোন ধরতেই কাচা খিস্তি শুনলো।”তোর লাইনের গাঢ় মারি বোকাচোদা,আমার মাল ডেলিবারি দিতে হবে বিকেলের মধ্যে ।খদ্দের এসে বসে আছে।তুই আজকের ডেট দিযেছিস কেন?তোর জন্য কেন আমি আলবাল কথা শুনব”! গগন ফোনে আমতা আমতা করতে লাগল।লাইনের সামনের আর পেছনের দু’তিন জন বয়স্ক ভদ্রলোক ফোনে ভেসে আসা কাচা খিস্তি গুলো শুনল।ওরাই গগনের হয়ে অনুরোধ করলেন সবাইকে।একেবারে লাইনের সামনে এগিয়ে দিলেন।কযেকজন গাইগুঁই করলেও  বাকি কযেকজনের প্রবল বিরোধিতায় গগন লাইন বাদ দিয়ে টেবিলের সামনে গেলেন।

        ফুড ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টর লোকটি গগনের হাত থেকে বারকোড মারা কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে বললেন,” আপনিতো ডিজিটাল রেশনকার্ড পেয়েছেন ।আবার ছযনম্বর ফর্ম পূরণ করেছেন কেন?”গগন বলল, “স্যর আমি পি পি এইচ কার্ড পেয়েছিলাম, রেশনে এই কার্ডের জন্য বরাদ্ধ প্রায কিছুই থাকেনা।এর আগে আমার বি পি এল কার্ড ছিল।আমার কাউন্সিলর কে জানালে বলেছিলেন,আপনি আবার ফর্ম পূরণ করে জমা দিন,বি পি এল হয়ে যাবে।জমা দিযেছি প্রায় ছমাস আগে। পৌরসভা বলল, আগে খোঁজ নিন আপনার নতুন কার্ড তৈরি হযেছে কিনা।বলার পর বারকোড মিলিয়ে নেটে দেখেছি আমার কার্ড তৈরি হয়ে গেছে।আপনি অনুমতি দিলেই বি পি এল কার্ড টা  হাতে পাব”! 

আপনার পি পি এইচ কার্ডগুলো কি হবে?

নিয়ে এসেছি স্যর,বাতিল করে দেবেন!

ইন্সপেক্টর লোকটি ক্ষেপে উঠল, ” মামাবাড়ি পেযেছেন?যান যান ।যে কার্ড পেয়েছেন সেটাই থাকবে। সরে যান।”

গগন খুবই অনুনয় করে বলল,” স্যর আমি একটা লেদ কারখানার সামান্য মিস্ত্রি ।ঘরে মা বাবা নিয়ে ছয়টা পেট।বি পি এলটা আমার দরকার স্যর।“

আপনার বি পি এল হবেনা।

গগন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না। শরীরের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে চিৎকার করে উঠল,”  স্যর, আমার মালিকের ছটা লেদ কারখানা,তিনটে কোম্পানির ডিষ্ট্রিবিউটারশীপ,  খাওযার লোক চারজন।তার বি পি এল কার্ড হতে পারে আমার হবেনা?”

আপনি লাইন ছেড়ে বেরোবেন? ধমকে উঠল ইন্সপেক্টর । ভযঙকর রাগটা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে এল গগনের।ধরা গলায় বলল,” মালিকের বউ বাড়ির ঠিকে ঝি এর কাছে বি পি এলের চাল তুলে বিক্রি করে!আমি সামান্য লেদ মিস্ত্রি হযে ইন্সপেক্টর বাবুর খেযালপনাতে বি পি এল পাবনা”!

         গগন ভান্ডারির কথা শোনার কেউ নেই।লাইন থেকে বেরিয়ে গেল।বাইরে খাঁ খাঁ রোদ্দুর ।গগনের সারা শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে । একটাই প্রশ্ন নিজেকে নিজের,কেন সে বি পি এল পাবেনা, এর জবাব গগনকে পেতেই হবে।জিদ চেপে বসল মাথায় ।লোহারপাতি বাঁকানো হাতের চেটোতে আঙুল দিয়ে চেপে ধরল কাগজ গুলো।সোজা চেযারম্যনের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁডালো ।পিওন বলল,”একজন ভেতরে আছে। বেরলে যাবেন।”

গগনের মাথা গরম হওয়া সত্বেও অপেক্ষা করল ।ভেতরের জন বেরিয়ে আসতেই ঘরে ঢুকে গেল। বলল,” দাদা,আগে আমার বি পি এল কার্ড ছিল । সেইমত ছয নম্বর ফর্ম জমা করে দিযেছিলাম। আমার কার্ড হয়ে আছে,ইন্সপেক্টর বলছে আমাকে বি পি এল দেবে না।আপনি একটু দেখুন।”

— দেখার কিছুই নেই।বি পি এল লিস্ট আগের সরকারের সময়ে করা।আমাদের কিছু করার নেই।ইন্সপেক্টর যা বলেছে ওটাই ঠিক।

—গরিবের কথা শোনার কেউ থাকবে না।মনে করে দেখুন দাদা,আপনি আমাকে বলেছিলেন রেশনকার্ডটা আমার বি পি এল করে দেবেন।করে দিন দাদা।ছয় ছয়টা মানুষের সংসার চালাতে হিমসিম খেযে় যাচ্ছি ।

— সম্ভব নয় গগন, অন্য কথা থাকলে বল।নিযমের বাইরে আমরা যেতে পারব না।

কতক্ষণ মেজাজ ধরে রাখা যায়। বলতে বাধ্য হল গগন,”ভোটের সময় বাড়িতে গিযে বলে এসেছিলেন পেনশন দেবেন,বি পি এল দেবেন,দালান বাড়ি দেবেন। একগাছ সুতোওতো দিলেন না। দালান করে দিলেন কানু বিশ্বাসকে,যার একছেলে স্কুলমাষ্টার অন্যজনের বাজারে ফার্নিচারের বড় দোকান।এম এল এ ওখানে  বসে আড্ডা মারে।

টেবিলে রাখা বেলটায় চাপ দিলেন চেয়ারম্যান ।শব্দ হতেই দরজার বাইরে দাড়ানো পিওন ভেতরে এল।চেযারম্যন ধমকে উঠলেন,”যাকে তাকে ভেতরে ঢোকাস কেন?কাল থেকে তোকে অন্য জায়গায় সরাবো।” 

পিওন বুঝে গেল ।গগনের হাতটা ধরে বাইরে টেনে নিয়ে আসল।গগন হকচকিযে গেল।বাইরে বের করার পরও বুঝতে পারল না এরপর কি করবে।

         বাইরে গরম বাতাস ।ভরা শ্রাবনেও বৃষ্টির দেখা নেই। রাস্তার কংক্রিট চাটুর মত তেতে আছে।কারখানায যাবার কথা ভুলে গেল গগন।শরীরের ভেতর থেকে ভয়ঙ্কর একটা হিংস্রতা বেরিয়ে আসতে চাইছে।কার উপরে সেটা দেখাবে, সেটাই বুঝতে পারছে না।  দুপুরে রাস্তায় অটো রিক্সাও কম।দাঁডিযে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।আবার ফোনটা বেজে উঠল।ইচ্ছে করেই ধরল না।মালিকের ফোন।মনে পড়ল কারখানার কথা। ফোন ধরলেই তাগাদা করবে,খিস্তি করবে।কারখানায় যেতে দেরি হচ্ছে কেন কৈফিরৎ তলব করবে।গগন হাঁটা শুরু করল।একটা লেডি কুকুর খাবার চাইতেই হোক বা যে কারনেই হোক গগনের গাযে এসে শুঁকতে লাগল।সব রাগটা গিয়ে পড়ল লেডিটার ওপর। পেছনে কষিযে একটা লাথি ঝাড়তেই  কুকুরটা কেঁউ কেঁউ করে চিৎকার করে উঠল। 

        একট অটো সামনে  দাডাতেই গগন চেপে বসল।চেপে বসলে কি হবে,লেডি কুকুরের যন্ত্রণার চিৎকারটা গগনের মাথার ভেতর ঢুকে গেল।অটোয় বসে বসে লেডির চিৎকারটা  অবিকল গগনের মাথা থেকে ছিঁটকে মুখ থেকে বেরিয়ে এল।কেঁউ কেঁউ কোঁ  ও যোঁ যোঁ ……  । আর্তনাদ টা বেড়ে যেতেই অটোটা থেমে গেল।ড্রাইভার ধমকে উঠল,“ পাগল নাকি,নামুন অটো থেকে।দেখেতো ভেবেছিলাম সুস্থ লোক,এখন দেখছি বদ্ধপাগল।নামুন, অন্য প্যসেঞ্জারের অসুবিধা হচ্ছে”! 

গগন বুঝতে পারছে না কেন তাকে অটো থেকে নামিযে দিতে চায় ।লেডি কুকুরটাকে কিছুতেই সে তার শরীর থেকে আলাদা করতে পারছে না।শরীরের  ভেতর থেকে ক্রমাগত সে যন্ত্রণায় ছটফট করে চলেছে।শরীরটা বেঁকে বেঁকে উঠছে।কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হচ্ছে।গগনের সেই কুক্কুরিয ভাষার অর্থ কেউই বুঝতে পারছে না।প্যসেঞ্জারেরা গগনকে অটো থেকে নেমে যেতে বাধ্য করল।ড্রাইভার নামাতে নামাতে বলল,”ভাড়া দিতে হবে না,নামুন।” গগন যতই অনুনয় বিনয় করে নিজের অসহায়তার  কথা বোঝাতে চাইছে অটোচালক আর প্যসেঞ্জারকে,ততই একটা লেডি কুকুরের অভিব্যক্তি গগনের শরীর থেকে ফুটে বের হচ্ছে।অসহায় কান্না ছাড়া অন্যকারো চোখে আর কিছু ধরা পডছে না।অটোর লুকিং গ্লাসে নিজেকে ভাল করে দেখে নিল গগন।না, তার চেহারায় কোনো বিকৃতি ঘটেনি।একই রকম মোটা গোঁফ,মুখে কযেকদিনের না কামানো দাড়ি ।শুধুমাত্র কন্ঠস্বরটা লেডি কুকুরটা দখল করে নিয়েছে । সেটাতো আযনায় দেখা যায় না। গগনকে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিল অটোচালক ।

      রাস্তায় নামিয়ে দিতেই গগন লক্ষ্য করল , সে আর দুইপাযে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।শরীরটা ঝুঁকে পড়ছে সামনের দিকে।বাধ্য হয়ে গগনহাত দুটোকে রাস্তার সঙ্গে চেপে ধরল।এবার গগন চার হাতপাযে নিজেকে অনেকটাই সুস্থ মনে করল।মনে মনে বুঝতে পারল গগন, সে আর দুই পাযে হাঁটতে পারবে না।এখন তাকে চার হাতপাযে হাঁটতে হবে।এখন আর গগন হাত দিয়ে তুলে খেতে পারবে না।রাস্তায মুখ লাগিয়ে তাকে খেতে হবে। গগন নিজের অসহায়ত্বের কথা বলার জন্য চিৎকার করতে  যেতেই ,মুখ থেকে বেরিয়ে এল একইরকম স্বর ….কেঁউ…কেঁউ…কোঁ…য়ওঁ…যোওঁ…..। যত জোরেই গগন কথা বলতে চাইছে গলা থেকে লেডি কুকুরটাই বারবার বেরিয়ে আসছে।চার হাতপাযে দাঁড়ানো গগনের কান্নায় রাস্তার কযেকটি ঘেঁযো কুকুর ঘেঁউ ঘেঁউ করে আক্রমণ করতে ছুটে আসল।অসহায গগন এবার ভয় পেয়ে ছুটতে লাগল।আগে আগে গগন চারহাতপাযে ছুটছে,পেছনে পেছনে ঘেঁও কুকুরের দলও ছুটছে।গগন জানেনা এই তাড়া খাওয়া তার কবে শেষ হবে…


Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *