ধারাবাহিক গদ্যের পরবর্তী অংশ
পদ্ম পাতায় জল
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
এক
দেবতারা যখন এই মাটির পৃথিবীতে আবির্ভূত হন,
তখন আগে থেকে কেউ তাঁদের চিনতে পারেন না।
না তাঁদের পিতা মাতা৷ না তাঁদের ভাই ভগ্নি না তাঁদের আত্মীয় পরিজন। এমনকি বন্ধু বান্ধব
খেলার সাথী যাদের সঙ্গে দিনরাত কাটিয়েছেন
তাঁরাও না। ঈশ্বরের মর্তলীলার সময় তাঁকে ঠিক
ঠিক চিনতে কিছুটা সময় লাগে। এ ঘটনা সকল
দেবদেবীর ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি।
★★
শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধিকা, শ্রীচৈতন্য, গৌতম বুদ্ধ এমন কি আমাদের ঘরের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, এবং
জগজ্জননী মা সারদা সবার জীবন চর্চায় একই
কাহিনী লক্ষ্য করা যায়।
আজ এই পরিসরে আমরা মা সারদার কথাই
একটু অনুধ্যান করবো। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাব-
আন্দোলনে মা সারদা সবসময় ” মাতৃরূপে ” ই
পূজিতা হয়ে এসেছেন। ঠাকুরের ভক্তমন্ডলী এবং
তাঁর পার্ষদগন, যাঁরা ছিলেন এক এক জন ঈশ্বর-
কোটি সাধক, তাঁরা ” ঠাকুর ” বলতে যেমন
ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ দেব কেই বুঝতেন, তেমনই
” মা” বলতে বুঝতেন মা সারদাকে। মা কালী, বা মা ভবতারিণীকে নয়।
★★
মা সারদাও বিভিন্ন সময়ে, নানারকম পরিস্থিতিতে, নিজের পরিচয়টিকে যথাযথ ভাবে
আমাদের হৃদয়ে পাকাপোক্ত করে বসিয়ে দিয়ে
গেছেন এই বলে, ” আমি মা, সত্যিকারের মা,
কোনো পাতানো মা নয়, গুরুপত্নী নয়,কথার কথা
মা নয়, সত্য জননী। “
কখনো বলেছেন, ” আমি সতের ও মা, অসতের ও মা “। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণর সামনে জোর গলায়
বলেছেন, ” কেউ মা বলে এসে দাঁড়ালে আমি তো তাকে ফেরাতে পারবো না “। আবার কখনো ঘোষণা করেছেন, ” মনে ভাববে, আর কেউ না
থাক, আমার একজন মা আছেন। ” — এমন
আপন করে আর কোনো দেবী তাঁর ভক্তদের নিয়েছেন কি না এই আধ্যাত্মিক জগতে,
আমাদের জানা নেই। ধর্ম জীবনে এ এক মহা
বিস্ময়ের বস্তু!
★★
মা সারদার অল্প বয়সের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেই শৈশব থেকেই
তিনি ঘোর সংসারী। তাঁর পিতা রামচন্দ্র, ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ। তাঁর আয়ের উৎস ছিল একমাত্র চাষবাস। শাস্ত্র জানা, মহান হৃদয়,মানবিক এবং খোলামেলা মনের মানুষ। সেই গরীব চাষী পরিবারে জন্মানোর সুবাদে এবং জেষ্ঠ্য সন্তান হওয়ার জন্য মা সারদাকে সংসারের সব ক্ষেত্রেই, অল্প বয়সেই প্রচুর পরিশ্রম করতে হত। পরবর্তী কালে মা বলেছেন,” আমার বেশ মনে পড়ে,ছেলেবেলায় গলা- সমান জলে নেমে গরুর
জন্য দলঘাস কেটেছি। ক্ষেতে মুনিষদের জন্য
মুড়ি নিয়ে যেতুম। একবছর পঙ্গপালে সব ধান
কেটেছিল ; ক্ষেতে ক্ষেতে সেই সব ধান কুড়িয়েছি।” অর্থাৎ ছোট থেকেই বড় দের মত দায়িত্ব নিয়ে সব দিক সামলেছেন। মায়ের মেজ ভাই কালীকুমারের কাছ থেকে আমরা আরও জানতে পারি- তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ” দিদি আমাদের সাক্ষাৎ মা লক্ষী। আমাদের ভাইদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন, এছাড়া ধান ভানা, পৈতা কাটা, গরুর জাবনা দেওয়া, রান্না বান্না– বলতে গেলে সংসারের বেশির ভাগ কাজই দিদি করেছেন। “সংসারের যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন, তিনি সর্বত্র উপস্থিত। সর্বদা তাঁর কোমল অপটু হাত তিনি বাড়িয়েই রেখেছিলেন সংসারের জন্যে। তাঁর কাছে কাজটাই বড় ছিল, বয়স তাঁর যতটুকুই হোক না কেন?
এই অদম্য মনের জোর, আর কিছু একটা করে
পরিবারের সবার পাশে থাকার, সাহায্য করার-
মানসিক ইচ্ছা তাঁকে পরবর্তী কালে জগজ্জননী
হতে পথ দেখিয়েছে। প্রথমে আপন পরিবার, তারপর গ্রামগঞ্জ, সে সব ছাড়িয়ে দেশ,এখন বিশ্বময় এই মাতৃত্বের শক্তি বিভিন্ন ধারায় বয়ে
চলেছে। এবং যত দিন যাচ্ছে তত এই মাতৃত্বের
প্রবাহ যেন কোনো এক দৈব বিধানে আলোকিত
হয়ে জগতকে প্লাবিত করে চলেছে।
★
শৈশবে মায়ের খেলার সাথী ছিলেন অঘোরমনি
দেবী। পরবর্তী কালে তিনি বলে গেছেন মা সারদা
ছিলেন মূর্তিমতী ” সরলতা “। সমবয়সীদের সঙ্গে
খেলার সময় তাঁর সঙ্গে কারোর কখনোও ঝগড়া
হয়নি। বরং অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হলে
মা এসে তা মিটিয়ে দিতেন।ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল বলেই তিনি শৈশব থেকেই সবার অভিভাবকের মত হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দের মত শিক্ষিত পুন্যাত্মা সন্ন্যাসীও মা সারদার ব্যক্তিত্বের কাছে চুপ করে থাকতেন। যদি স্বামীজী মা’ র কাছে কোনো কাজে যেতেন, তো বারবার মা গংগার জলে মুখ ধুয়ে নিতেন নিজেকে শুদ্ধ করার জন্যে।
★
অঘোরমনি দেবী আর একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ
দৈবী ঘটনার কথা আমাদের বলে গেছেন :
ঘটনাটি এই রকম– জয়রামবাটি গ্রামে শ্রী শ্রী
জগদ্ধাত্রী পূজা হচ্ছে। মা সারদা সব দেবদেবীর
পূজা অর্চনায় আগে সেখানে পৌঁছে যান। ওইটুকু
মেয়ে, সে বালিকা তখন, কিন্তু মায়ের মূর্তির সামনে ধ্যানে বসেছে। পাশের গ্রামের বিশিষ্ট ও
সম্পন্ন রাম রঞ্জন ঘোষাল মহাশয়ও এসেছেন
সেখানে পূজা দর্শনে।তিনি দেবীর সামনে ধ্যানরতা
মা সারদাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর মনে
হল ওই ছোট্ট ধ্যানরতা মেয়েটি যেন মা জগদ্ধাত্রীর মূর্তির সাথে একীভূত হয়ে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। একি চোখের ভুল? মনের বিভ্রম? তিনি কোনটি মাতৃমূর্তি আর কোনটি ধ্যানরতা বালিকার মূর্তি আলাদা করতে পারলেন না।শেষে কী করবেন বুঝতে না পেরে বিমূঢ় হয়ে মন্দির প্রাঙ্গন ত্যাগ করলেন।
মা সারদাকে তাঁর জগদ্ধাত্রী রূপে দর্শন একটি
অলৌকিক ঘটনা নয়। বরং এই জাতীয় আরও
ঘটনা মায়ের শৈশব জীবনেই ঘটেছিল। মা সারদা
এত যে কর্মপটু ছিলেন এবং বয়সের তুলনায় তা
যথেষ্ট পরিনত, এ বিষয়ে পরে কথাচ্ছলে বলেছেন, ” সে সময় আমার মনে হত আমারই বয়সী আরও কেউ কেউ যেন আমার সঙ্গে আমাকে আমার কাজে সাহায্য করছে। দু ঘন্টার কাজ এক ঘন্টায় হয়ে যেত। বুঝতে পারতাম, কিন্তু তাদের দেখতে পেতাম না। ” — সত্যিসত্যিই এ এক আশ্চর্য দৈবী ঘটনা। মা যে “শক্তির আধার ” ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো না কোনো অনুৎসারিত শক্তি তাঁকে সর্বদা জড়িয়ে থাকতো। ঘিরে থাকতো।
বিবাহের পরে তিনি যখন শ্বশুরবাড়ি কামারপুকুরে
এলেন, তখন তিনি পাঁচ বছরের বালিকা। তখন
যখন স্নানে যেতেন হালদার- পুকুরে কলসি নিয়ে
তখন ওঁর বয়সী আটজন “অষ্টসখী” তাঁকে ঘিরে
থাকতো। এ এক অত্যাশ্চর্ষ ঘটনা। এবং সেই
ঘটনা একদিন হঠাৎ করে হয়নি, এমন অপূর্ব ঘটনা রোজ রোজ ঘটেছে। মা সারদা ভাবতেন
এই অষ্টসখীর দলটি বুঝি বা এই পাড়ার পড়শী।
তিনি একা একা স্নানে যেতে যদি বা ভয় পান তাই
ওরা এসে সঙ্গ দেয়। এবং তারা রীতিমত মা সারদার সঙ্গে জলে নেবে জল ছিটিয়ে সাঁতারও
কাটত। এ গল্পের কোন শেষ নেই। কোনো ব্যাখাও
নেই। সবটুকু মায়ের অনন্ত আত্মশক্তির তীব্র রশ্মির
দিব্য আলোর প্রকাশ।
মায়ের কথা একবার শুরু করলে আর শেষ হতে
চায় না। প্রিয় পাঠক, আমিও শেষ করতে চাই না।
এ আখ্যানের এ টুকু শুরু মাত্র। শুরুর শেষ কত
গুলো পর্বে হবে তা জগজ্জননীই জানেন।তিনি
লীলাময়ী। তিনিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন –
এই তথ্যে এতটুকু মিথ্যে নেই। আমি অনুভব করি
সেই বিশ্বমাতা যেন আমায় প্রেরণা দেন, উৎসাহ
যোগান। না হলে আমার কী বা যোগ্যতা আছে তাঁকে অনুধ্যানে আনার? তিনি পদ্ম পাতায় জল।
সবুজ পত্রে মুক্তোর মত উজ্জ্বল এক মাতৃমূর্তী।
দূর থেকে তাঁকে অনুভবে আনতে হয়। পদ্মপত্রেই
থাকুন আর অন্তরের রাজ সিংহাসনেই বিরাজ
করুন শ্রীশ্রী মা তাঁর মাতৃত্বের শক্তিতে, ভালবাসার
শক্তিতে প্রেমস্বরূপিনী হয়ে আমাদেরকে রক্ষা
করছেন, পালন করছেন, এবং পুষ্টিবিধান করে
চলেছেন। আজও……..তাঁর শ্রীচরণে শত শত
কোটি প্রনাম জানাই।
চলবে…