সহজ মানুষ-সহজপাঠ (বাইশতম পর্ব)

ধারাবাহিক গদ্য পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

 

অগ্নিপরীক্ষা (বাইশতম পর্ব)

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

ভগবান ও তাঁর ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য দুূদিনের। ভগবানই
একমাত্র সত্য। বাজিকর আর তার বাজি। বাজি
দেখে সব অবাক। কিন্তু সব মিথ্যা। বাজিকরই
সত্যি। বাবু আর তাঁর বাগান। বাগান দেখে বাগানের মালিক বাবুকে( অর্থাৎ ঈশ্বরকে) সন্ধান
করতে হয়।

শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।। দ্বিতীয় খন্ড।। পৃ: ৬৪৮ ।।

এক মেছুনী মাছ নিয়ে যাচ্ছিল মাথায় ঝাঁকা নিয়ে। ওপরে উড়ছিল একটা চিল। তক্কে তক্কে ছিল। যেই একটু বেতাল বুঝেছে অমনি, ছোঁ মেরে একটা মাছ নিয়ে পালাল, ঝুড়ি থেকে। মেছুনী যখন টের পেল, তখন চিল দূর আকাশে, পগার পার। মেছুনী রেগেমেগে বলল, “মর মুখপোড়া পাখি, চুরি করে নিলি তো,ও মাছ তোর ভাগ্যে সইবে না।” চিল মাছ মুখে উড়ছে, আর একটা নিশ্চিত বসার জায়গা খুঁজছে। খুঁজছে একটা গাছের মগডাল। যেখানে বসে আয়েশ করে মাছটা খেতে পারে। কিন্তু আমরা ভাবি এক, হয় আর এক। চিলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। একদল কাক জুটে গেল। চিলের পিছু নিল তারা। মাছটা চিলের কাছ থেকে তারা কেড়ে নেবে। এ কী রে ভাই! মগের মুল্লুক না কি? চিল ও ছাড়ার পাত্র নয়। কাক গুলোও না- ছোড়বান্দা।চিল আকাশে অনেক কায়দায় ওপর নিচ করে নিজেকে কাটাতে লাগল। কিন্তু কাকের দল পিছু ছাড়ার বান্দাই নয়। কা কা করে চেঁচাচ্ছে আর সমানতালে ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে চিলকে। ওদের চেঁচামেচিতে ক’ টা অন্য ছোট পাখিও এসে জুটে গেল। ফিঙে, শালিক এমনকি দু একটা চড়াই ও। তারাও পিছু পিছু তাড়া করে বেড়াতে লাগল। বেশ ভোগান্তি! ছোট পাখিগুলোর জন্যে কাকগুলো যেন আরও উৎসাহ পেয়ে গেল। দ্বিগুণ তোড়জোর। তেড়েফুঁড়ে লেগে পড়ল চিলের পিছনে। একী অধর্ম? আমি আমার আহার সংগ্রহ করেছি। তাতে তোদের চোখ টাটাচ্ছে কেন? ভারি মুস্কিলে পড়া গেল? এ তো চোরের ওপর বাটপারি! চিল হায়রান হয়ে গেল। শাঁখের করাত। ঠোঁট দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে গেলে মাছটাই খোয়া যাবে। আবার সামান্য কটা কাকের কাছে এমন অন্যায় অপদস্থ! একেই বোধহয় বলে “অগ্নিপরীক্ষা”।বা “হাতিকে ব্যাঙের লাথি।” চিল মাছটা মুখ থেকে ফেলে দিল। দিয়ে বসল গিয়ে একটা বড় গাছের মগডালে। — এমন মজার দৃশ্য গ্রামে, এবং অনেক সময় শহরেও দেখা যেত। তবে এখন চোখে পড়ে না। কেননা, এখন মাছ বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য ভাবে। ট্রাকে, ভ্যানে, অথবা অন্য যানবাহনে দ্বিতীয়ত “চিল “,এই প্রজাতি র পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। চিলের গল্প একটি প্রতীকী আখ্যান। চিল হলো আমাদের মত গৃহবাসী সংসারী জীব। যাদের ঘাড়ে সংসারের বিপুল চাপ। সংসারের আপন আত্মজন, বাবা- মা, ছেলে মেয়ে, ঘর গৃহস্থালি, সমাজ, নিকট বন্ধু, সকলকে নিয়ে স্নেহময় চলা এই সংসার – পথে। চাপ দিচ্ছে কারা? ঐ কাকের দল। অভাব, অনটন,হিংসা, খেয়োখেয়ি, সামাজিক দূর্নীতি, নিয়ম, আইন- কানুন, এরা। পোঁ- ধরা স্তাবকের দল হলো – ফিঙে, শালিক, চড়াই – এরা। এরা একটা ঝামেলা বাধিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। সুস্থ পরিবেশ পরিস্থিতি কে অসহ্য করে তোলে। আর মগডাল – একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়। যেখানে কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। লেগ – পুলিং করবে না। যেখান থেকে তুমি মন: সংযোগ করতে পার। ঈশ্বর- চিন্তা, স্মরণ- মনন করতে পার অনায়াসে, অনিবার্য ভাবে।

তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ ” উপাধি, দম্ভ, অহংকার, জটিলতা, হিংসা, অন্যায়, অধর্ম সব ‘ত্যাগ’ কর। যা ঈশ্বর প্রসঙ্গে বাধা – তা ত্যাগ করো। ফেলে দাও। যা তোমার নিজের হিসেবের নয়, তা অবশ্যই বর্জন করো। চিল দেখল যে মাছটা ফেলার সাথে সাথে কাকের দল তাকে ছেড়ে মাছটাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করেছে। আর ছোট পাখিগুলো সব উধাও। চিল মজা দেখতে লাগল বসে বসে। নে, দিয়েছি ফেলে। বুঝল মাছটা ছিল একটা মস্তবড় “মায়া”। এই মায়াই মায়াধীশকে দেখতে দেয় না। বুঝল কাকের দল ছিল – এক একটা লোভ, সংকীর্ণতা, বন্ধণ, পাপ, ঈর্ষা, ঔদ্ধত্য, ছলনা, কলঙ্ক – এরা। চিল মাছটা ফেলে দিয়ে ফিরে পেল উদারতা, নির্মলতা, পুন্য, ধর্ম, প্রীতি, বিনয়, ইত্যাদি ও ইত্যাদি।
চিল আমাদের অনেক কিছু শেখালো। এই নিত্য দিনের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা অনেক কিছু শিখছি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও এই সব দৃশ্যের কত সুন্দর উপমায় ব্যান্জনায় আমাদের বুঝিয়েছেন নিজের মত করে। প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি দৃশ্যে লুকিয়ে আছে জীবনদর্শনের প্রতীকী পরিচয়, নীতি, আদর্শ, আর অর্থ। সেই অর্থটিকে সহজ সরল সোজা করে আধ্যাত্মবাদের মোড়কে এক অনন্য অনুভবে পরিবেসন করেছেন তিনি। মেছুনীর অভিশাপ – কুসংস্কার। তা ফেলে দাও। চৌর্যবৃত্তি অনাদরনীয়। তা ফেলে দাও। যা তোমার নিজের উপার্জনে নয়, তা ফেলে দাও। যারা অনাকাঙ্ক্ষিত – সেই কাকের দল – তাদের আপদের মত বিদায় দাও। ত্যাগ করতে শেখো।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ ত্যাগ ই হলো ধর্ম।
সবচেয়ে বড় ধর্ম। রাজত্ব, সিংহাসন, রাজসুখ,
আপন জনের সান্নিধ্য ছেড়ে, রাজবেশ ছেড়ে,
বনবাসীর বেশে বনবাসী হয়ে গেলেন শ্রীরামচন্দ্র।
পিতার মুখের কথার দাম দিতে।এক দু দিন নয়। পুরো চোদ্দ বছর। একেই বলে ধার্মিক। রাজ সুখ ছেড়ে বনবাসী হয়ে গাছ তলায় তৃনের বিছানায় শয়্যা। গাছের ফলমূল খাদ্য। কী অপরিসীম কষ্ট আর কৃচ্ছসাধন। কী অসামান্য ত্যাগ। শ্রীরামচন্দ্র বলেছেন, “সেদিন যদি আমি অযোধ্যা ত্যাগ না করতাম, একটা গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝেও যদি জেদ করে সব অমান্য করতাম, অযোধ্যায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। কেউ কাউকে মানত না। হানাহানি শুরু হ’য়ে যেত। সেটা হত “অধর্ম”। সেজন্যই আমার কর্তব্য আমি স্থির করেছিলাম। “ভোগ নয়, ত্যাগ”।
আবার ওদিকে জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা শ্রীরামচন্দ্র বনবাসী
হতে যাচ্ছেন, তাঁকে এবার রাজ্যভার সামলাতে
হবে, তার সংগে ভোগ করার সুযোগ থাকছে
অপরিসীম। রাজসুখ বলে কথা! ফিরেও সেদিকে
তাকালেন না ভরত। প্রিয় দাদাকে অনেক বোঝা
লেন। এই সিদ্ধান্ত বদলাও। তুমিই এই সূর্যবংশের
গৌরব। পিতার জেষ্ঠ্য সন্তান। এ তোমার একার
অধিকার। কে শোনে কার কথা!
শ্রীরামচন্দ্র ভাইকে নির্দেশ দিলেন আমি চোদ্দো
বৎসর পর এসে সিংহাসনে বসব। ততদিন তুমি
রাজ্য শাসন করো আর রাজসুখ উপভোগ করো।
কিন্তু পিতৃসম দাদার উপদেশ, অনিচ্ছা সত্বেও
মেনে নিলেন ভরত। ঘোষণা করলেন “এ সিংহাসন তোমার। শ্রীরামচন্দ্রের। আমিও তোমার মতই বনবাসীর সাজে সজ্জিত হয়েই রাজ্য শাসন করবো। সিংহাসনে বসবো না। সেখানে বিরাজিত হবে আমার প্রিয় জেষ্ঠ্য ভ্রাতার পাদুকা।” আমি আজ থেকে ত্যাগ করলাম ‘রাজসুখ’ রাজভোগ আর ‘রাজঐশ্বর্য’।

শুরুতেই ঠাকুরের কথামৃতে বলা হয়েছে ঈশ্বরই
সত্য। আর যাবতীয় ” ঐশ্বর্য ” সব দুদিনের। তোমার রূপ, যৌবন, প্রাসাদ, অট্টালিকা, ধনদৌলত – সব ক্ষনিকের। ঈশ্বরই চিরন্তন। তাই তাঁর শরনাগত হও। আর ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, যাতে অনুকূল হাওয়া বয় —- যাতে শুভ যোগ ঘটে। ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই।
শুনবেন।

।। ওঁ নম: ভগবতে বাসুদেবায়।।

চলবে…

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *