পদ্ম পাতায় জল(৫)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
মা সারদার পাদপদ্ম স্মরণ করে, তাঁকে নিয়ে লেখা চলছে , আজ নিয়ে , পরপর
পাঁচ অধ্যায়। আরও কত, শত, সহস্র কিংবা লক্ষ , এমন অধ্যায়, তাঁর জীবনী নিয়ে, লেখা যেতে পারে, আমাদের
আগামী পাঁচ পুরুষ ও তার হিসেব কষতে পারবে না।
★
আমরা এমনই এক দেবীর জীবন চর্চা শুরু করেছি – যিনি এক অপরিসীম আত্মশক্তির
অধিকারী ছিলেন, তাঁর ব্যাক্তিজীবনে, গার্হস্থ্য –
জীবনে, এবং সংসারজীবনে। তাঁর প্রতিটি
মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ ছিল ঈশ্বরময়, শ্রীরামকৃষ্ণময়। তিনি ছিলেন ” রামকৃষ্ণ গতপ্রানা”। ঠাকুর বৈ তিনি আর কিছু জানতেন না। মা সারদা বলতেন, — ” ঠাকুর একমাত্র
রক্ষাকর্তা। — এটি সর্বদা মনে রাখবে। এটি ভুল
হলে, সব ভুল। যে ঠাকুরের শরণাগত হয়, তার
ব্রহ্মশাপেও কিছু হয় না”।
★
তিনি দেবী। স্বয়ং মা জগদ্ধাত্রী। কিন্তু সংসারে এবং গৃহস্থালিতে অত্যন্ত সাদামাটা এক সাধারণ
গৃহস্থ ঘরের গৃহিনী। গৃহই তাঁর আশ্রম। প্রতিটি
প্রাণীই তাঁর সন্তান। আপন আত্মজ। দেখিয়ে গেছেন ” সংসার করা ” কাকে বলে! কখনও
বুঝতে দেননি কাউকে, তিনি কী অপরিসীম
আত্মশক্তির বিপুল আাধার। স্বয়ং সেই রূপ গোপনে রেখে সংসারে বিরাজ করেছেন।
এখানে একটু, একটা ঘটনার কথা বলি:
মা সারদা, তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী দেবীকে নিয়ে,
দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন। সঙ্গে আছেন লক্ষীদিদি-
ঠাকুরের ভাইঝি এবং আরও কয়েকজন নিকট
আত্মীয়। শ্বাশুড়ি এসেছেন জামাই বাড়িতে।
বাড়িতে না বলে, বলা যায় জামাইয়ের কর্মস্থলে।
★
খাতির যত্ন তো হলোই না, উল্টে জামাই, অর্থাৎ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এর সামনে তাঁর ভাগনে, হৃদয়
রাম, যা নয় তাই বলে আপমান করলে।
নৌকো থেকে নাবতেই হৃদয় জ্বলে উঠল সকলকে
দেখে। — বল্লে ” এখানে কী? বলা নেই কওয়া নেই , কেন এসেছ এখানে? যত্তসব ঝামেলা এই
খানে এসে জুটে গেছে। ভাগো সব। ”
আর এই গোটা ঘটনাটাই ঘটে গেল ঠাকুরের সামনে। ঠাকুর কোনো প্রতিবাদই করলেন না।
★
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সব শুনলেন এবং মরমে
মরে গেলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না, তাঁর ভাগনে, হৃদয় রাম মুখুজ্জেকে। হৃদয়
সব সময় ডংকা মেরে বেড়ায়। ভদ্রতা জানে না।
বড়দের সম্মান দেয় না। নিজেকে কতৃত্বের
অভিমানে, মনে করে সে যা বলবে তাই হবে।
সে ছাড়া দক্ষিণেশ্বর অচল। ঠাকুর তাকে বেশি
ঘাঁটাতেন না। এই ভয়ে, যে, সে এদের সকলের
সামনেই ঠাকুর কেও অপমান করবে। ব্যঙ্গ করবে।ঠাকুরের শাশুড়ী ঠাকরুন বাধ্য হয়ে তখন বললেন, ” চল, সারু, তাহলে ফিরে যাই জয়রামবাটি। এখানে কার কাছে মেয়ে রেখে
যাবো? ” অর্থাৎ বলতে চাইলেন, জামাই বাবাজীবনই যখন চুপ করে সব সয়ে গেলেন,
তখন কোন ভরসায় আর কার হেপাজতে মা
সারদাকে, এই দক্ষিণেশ্বরে রেখে যাবেন?
মাননীয় পাঠক, মা সারদার তখনকার কথাগুলি
শুনুন। স্বামীর সামনে যদি তার ভাগনে এমন
কুৎসিত জঘন্য ব্যাবহার করে আর সেই অসভ্যতা
স্বচক্ষে দেখেও স্বামী কোনো শব্দ ব্যয় না করেন,
তখন স্ত্রীর পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব নয়। এটাই
বাস্তব।শ্রীশ্রী মা ও মনে মনে প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হলেও
মুখে বললেন , ” হাঁ, এখান থেকে চলে যাওয়াই
শ্রেয়। ” তারপর মা ভবতারিণীকে প্রনাম করে
প্রার্থনা জানালেন, ” মা, এখন যাচ্ছি, যদি ভবিষ্যতে কোনোদিন আনাও তো তখন আবার আসবো। “
মা সারদার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। কোনো
অভিযোগ নেই। কোনো অভিমান নেই। কোনো
রাগ নেই। — এ এক সম্পূর্ণ অন্য মোড়কে
নিজেকে আবৃত করে রাখলেন জগজ্জননী।
★
অতি সামান্য একটি ঘটনা মনে হতে পারে।
কিন্তু কী বিশাল এর ব্যাপ্তি।এর গভীরতা।
যদি একটু তলিয়ে দেখা যায় তো দেখবো, কী
অপূর্ব শিক্ষা দিলেন তিনি জগতবাসীকে।কত
বড় আত্মসংযম! কী অসামান্য চিত্তসংযম! এর
প্রতিটি পরতে পরতে মা সারদার আপন আত্ম-
শক্তির নিবিড় নিবিষ্ট বিচ্ছুরণই চোখে পড়ে । স্বামী কে এই পরিস্থিতিতে কিছু বলা মানেই তাঁকে
বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা। এই ঘটনার প্রতিকার-
প্রতিবিধান চাইতে গেলেও ঘরের বৌকেই গঞ্জনা
সহ্য করতে হবে। তিনি এসবের অনেক ঊর্ধ্বে।
তাই ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর সব সিদ্ধান্ত অর্পন করে
বললেন ” মা ভবতারিণী, ভবিষ্যতে যদি আবার
আনাও তো তখন আসবো। “
এই দক্ষিনেশ্বরেই, আর একটি ঘটনার কথা, আমরা, এখানে , এই পরিসরে তুলে ধরবো।
যাতে বোঝা যায় কী প্রচন্ড ত্যাগী জীবন যাপনে
অভ্যস্ত ছিলেন আমাদের জন্ম জন্মান্তরের মা
সারদা। মা তখন দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন ঠাকুরের ডাকে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ খবর দিয়েছেন, “পাল্কী করে হোক, ডুলি করে হোক, বিশটাকা লাগে পঞ্চাশ টাকা লাগে লাগুক — এখানে আমার অসুবিধে
হচ্ছে, দেখার কেউ নেই, তুমি চলে এসো।”
একরাত্রে, ঠাকুরের ঘরে, শয়নের সময়,শ্রীরামকৃষ্ণ মা’ কে পরীক্ষার ছলে, জিজ্ঞেস
করলেন, ” কী গো! তুমি কি আমাকে সংসার-
পথে টেনে নিতে এসেছ? ” বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে শ্রীমা সারদা উত্তর দিলেন,” না, না, তা কেন?
আমি তোমার ইষ্ট পথেই সাহায্য করতে এসেছি।”
★
মা সারদা এক গন্ড গ্রামের মেয়ে। সেখানে শিক্ষার
কোনো আলোই প্রবেশ করেনি। সব মেয়ের মনেই
একটা স্বপ্ন থাকে স্বামী – সন্তান নিয়ে সুখে ঘর-
কন্না করার। তিনিও সন্তানের মুখের ” মা” ডাক
শোনার জন্য, হয়তো লালায়িত ছিলেন, কিন্তু
ঠাকুরের এই কঠিন প্রশ্নের মধ্যে ই ছিলো, তাঁর
মনের ভাবখানি লুকানো।
যতই পাড়াগাঁয়ের মেয়ে হন, যতই পড়াশুনা না
শিখুন,যতই নারী মনের ইচ্ছে হৃদয়কে আচ্ছন্ন
করে থাকুক, সঠিক সময়ে কিন্তু আমাদের ‘ মা’
সঠিক উত্তরই দিয়েছিলেন। যা শুনে ঠাকুর ও
নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। প্রিয়পাঠক,সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের পরিস্থিতি যদি বিবেচনা করেন, তাহলে বোঝা যাবে, মা সারদা সেদিন তাঁর ইচ্ছের মূল্যের চেয়ে, ঠাকুরের ইচ্ছে কে সম্মান জানালেন বেশি। তাঁর সেই অপূর্ব ত্যাগ- কাহিনী আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠল। তিনি জগতকে এই শিক্ষা দিলেন যে, পরিবেশ – পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থের চেয়ে স্বামী বা নিকট-জনের, প্রিয়জনের স্বার্থ ,বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। আর মা সারদা সর্বদা ভক্তদের বলে গেছেন,”আমি কেউ না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ই সব। তোমরা তাঁকে ধরে থাকো, তাঁর শরনাগত হও। তাহলে শেষ সময়ে তিনি ই হাত ধরে পার করে দেবেন এই ভব- নদী।”
★
শ্রীমার ক্ষেত্রে এটি ঘটেছিল- কেন না শ্রীরামকৃষ্ণ
ছিলেন তাঁর প্রানের চেয়েও অধিক। তিনি ছিলেন
” রামকৃষ্ণ গত প্রানা”। শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া তিনি অচল।শুধু আত্মশক্তি বা আত্মসংয়ম নয়, “যেখানে যেমন সেখানে তেমন, ” — ভাব নিয়ে চলতে তিনি পরবর্তীকালে আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন — তার পূর্বাভাস নিজে, নিজের জীবনে উদাহরন হিসেবে রেখে গেছেন, এই ঘটনায়। তাঁর আগামী জীবনের মাইল ফলক ছিলো শ্রীরামকৃষ্ণ-র যুগান্তকারী এই প্রশ্ন, “– কিগো! তুমি কী আমাকে সংসার পথে টেনে নিতে এসেছ ?” আর মা জগজ্জননীর সপ্রতিভ জগত- দৃষ্টান্তকারী উত্তর, “না, না, তা কেন? আমি তোমাকে তোমার ইষ্ট পথেই সাহায্য করতে এসেছি।”
চলবে…
তথ্যসূত্র: ” উদ্বোধন”।। পৌষ ১৪২৪।। কথাপ্রসঙ্গ।।