মধু বাতা ঋতায়তে
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
“কায় বাক্য আর মন – এই তিনে ধন।” এরাই
আসল মূলধন। অর্থাৎ শরীর হল- কায় ; বাক্য হল
মুখের প্রার্থনা ; আর মন হল – মনের স্বচ্ছতা,মনের
পবিত্রতা, মনের শুচিতা। এইগুলি একত্রে নিয়ে
কায়মনোবাক্যে – সেবা। কার সেবা? জীবের।
জীব- সেবা। শিব জ্ঞানে জীব সেবা। তাহলেই
ঈশ্বর খুসি হবেন। সেটিই ভগবানের পূজা।
“সেবা বস্তুতে নয়,সেবা অন্তরের ইচ্ছাটিতে”। এক
দিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, লাটু মহারাজকে। —” যদি কেউ ভিক্ষা করে এনেও তার প্রিয় বস্তটিকে ভগবানকে উৎসর্গ করে – সে সেবাও উত্তম জানবি। ” অর্থাৎ কী দিলি সেটা বিচার্য নয়, কেমন করে দিলি, কোন্ ভাবের সাথে দিলি, কতটা অন্তরের অন্তস্থল থেকে উজাড় করে দিলি সেটাই বড় কথা। মা সারদা বলেছেন, ” ঠাকুরকে নিজের লোক জেনে, নিজের মত করে ভোগ নিবেদন করবে। মন্ত্রতন্ত্র না জান ক্ষতি নেই। আসনে বসে, বলবে ঠাকুর এসো, বসো আমার সামনে। নিবেদন গ্রহণ করো। মনে ভাববে, তিনি এসেছেন তোমার গৃহে। বসেছেন ভোজন করতে। আর গ্রহণ করছেন তোমার নিবেদিত বস্তু। হোক না শুধু জল- বাতাসা। হোক না আধখানা সন্দেশ। কোনো ক্ষতি নাই। যেটুক দেবে আন্তরিকতার সুধা ঢালো,তাতে। ঈশ্বর হাত বাড়িয়ে নেবেন। সমস্ত উৎসর্গ সুধাময় হয়ে উঠবে। মা সারদা ছিলেন সাক্ষাৎ মা জগদ্ধাত্রী। এবারে রূপ ঢেকে এসেছিলেন এ ধূলার ধরনীতে। তিনি যে নিজের স্ব-রূপ ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন সে তথ্য আমাদের দিয়ে গেছেন
পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং। বলে
গেছেন, ” ও সারদা সরস্বতী, জ্ঞানদাত্রী, এবার
জ্ঞান দিতে এসেছে। পাছে ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে
লোকের অমঙ্গল হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে— বল দেখি মন, কেমনে শ্যামা, মনের কথা জানতে পারে”। কে জানতে পারে? ঈশ্বর। তিনি অন্তর্যামী। তিনি তো জানবেনই। সেজন্যই মা বলে গেছেন ” আন্তরিকতার সুধা ঢালো”। আন্তরিক হও। সর্বক্ষন। সর্বক্ষেত্রে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা ভবতারিণীর পূজা করতেন এমন সুধা ঢেলে, যে দেখত সেই মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, ঠাকুরের তন্ময় পূজায়। মনে হত এক ভগবান বসেছেন আর এক ভগবানের ভজনায়। সময় কখন পেরিয়ে যেত “সময়” ও বুঝতে পারত না। অনেক সময় ঠাকুরের পূজার সহকারী,ভাগনে হৃদয় এসে, ঠাকুরের ভাবসমাধি যুক্ত তন্ময়তা ভাঙাতো ঠাকুরের অন্যতম অন্তরঙ্গ পার্ষদ, ঈশ্বর-কোটি সাধক শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী মহারাজ বলেছেন, ঠাকুরের তন্ময়তার কথা। তিনি মা ভবতারিণীকে সর্বদা চিন্ময়ীরূপে দেখতেন। জীবন্ত। বলতেন “মা যে নিশ্বাস নেন এটা ঠিক। বাস্তবিক। তোরা একটু তুলো মায়ের নাকের সামনে গিয়ে ধর, দেখবি তুলোটা কাঁপছে। এর মধ্যে এতটুকু মিথ্যে নেই। মাইরি বলছি”। অর্থাৎ মা’ কে জলজীয়ন্ত ছাড়া ঠাকুর আর অন্য কিছু ভাবতেই পারতেন না। আর তাই তিনি মা’য়ের কাছে আবদার করতেন, উপদেশ নিতেন, ঘরের লোকের মত কথাবার্তা বলতেন। ভোগ নিবেদন করতেন, মা’কে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে। ঠাকুর নিজের ঘর থেকে রাতে শুনতে পেতেন মা পায়ে ” পাঁইজর” পরে বালিকার মত আনন্দে ছোটাছুটি করতে করতে মন্দিরের ওপর তলায় উঠছেন আবার ঝম্ ঝম্ শব্দ করতে করতে নিচের দিকে নাবছেন। আবার কখনও দেখতে পেতেন দোতলার বারান্দায় আলুলায়িতকেশে মা ভবতারিণী কলুষনাশিনী গঙ্গা দর্শন করছেন। এই বোধ, এই দৃষ্টি, এই অনুভব, এই শ্রবণশক্তি দৈবযোগে ঘটে। ঠাকুরের ক্ষেত্রেই এমন অপূর্ব সব বর্ণনা পাওয়া যায়। ঠাকুরের মত এমন সাত্ত্বিক সভক্তি আরাধনা, পূজা এবং প্রার্থনা করার মতো সাধক আর নেই। কিন্তু সেই একই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এখনো দণ্ডায়মান, একই মা ভবতারিণী বর্তমান,সেই রানীরাসমনির দেবালয়ে। পরবর্তী কালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন- তাঁর ভক্তদের, ” ঈশ্বরে যার প্রেম হয়, তার জগত ভুল হয়ে যায়। আর তেমন প্রেম হলেই ভক্তের কাছে ঈশ্বর বাঁধা পড়ে যান। গল্পটি শুনুন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একজন ঈশ্বর- ভক্ত মহাপুরুষ। ঠাকুরের যেমন মা ভবতারিণী,বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর তেমন শ্যামসুন্দর। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ।একজনের কালী আর একজনের কৃষ্ণ। একজনের শ্যামা, তো আর এক জনের শ্যাম। দুজনেই দেব অনুরাগী উচ্চ স্তরের সাধক। দুজনে একদিন গিয়ে হাজির হলেন এঁড়েদার এক দেবালয়ে। সেই মন্দিরের গাত্রে এক অপূর্ব “চিত্রপট” আছে যা দেখলে মন ভরে যায়। চিত্ত হয় চমকিত। অতএব দুই ঈশ্বর অনুরাগী সেখানে পৌঁছে গেলেন। এসে শুনলেন মন্দিরের পূজারি মহারাজ মন্দিরে তালা দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। খুলবেন আবার সেই সন্ধ্যারতির সময়। অতএব কী আর করা যায়? মন্দিরের আঙিনার পাশে দুজনে গিয়ে বসলেন। একটু বিশ্রাম করা যাক। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মধুর কণ্ঠে গান ধরলেন। আর ভাবাবেগে বিজয় কৃষ্ণ আবেশে আকুল ধারায় কাঁদতে শুরু করলেন। গড়াগড়ি দিয়ে কান্না। হঠাৎ কী হল কে জানে? মুহূর্তে খুলে গেল মন্দিরের দরোজা। পূজারি ফিরে এলেন না কি অসময়ে? না তো! তাহলে ব্যাকুলতায় খুলে গেল। আন্তরিকতার সুধায় খুলে গেল। দুই ঈশ্বর- পাগল মহামানবের অপূর্ণ ইচ্ছার সিদ্ধিলাভের কামনার জোরে খুলে গেল দেব মন্দিরের অর্গল। পূজারি এসে এই দৃশ্য দেখে আনন্দে কাঁদতে লাগলেন। দেবতার গলার মালা খুলে এনে পরিয়ে দিলেন ঠাকুর আর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর গলায়। সকালের পূজার প্রসাদ এনে নিজ হাতে খাওয়াতে লাগলেন দুই পুরুষোত্তমকে। “আজ আমার কী সৌভাগ্য! কী লীলা প্রভু তোমাদের! সব হয়। ঈশ্বর প্রেমে সব হয়। ঈশ্বর নিজেই খুলে দিয়েছেন দোর। আয়, সবাই এসে দেখে যা।” — বলেন আর আনন্দে কাঁদেন পূজারি ব্রাহ্মন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জড়িয়ে ধরলেন পূজারিকে। বললেন, ” কেঁদনি গো কেঁদনি। দেখলে তো ভগবানের কত শক্তি! এই শক্তিই মানুষকে বারবার আলোর দিশা দেখায়। আলোর পথে থাকো। তাহলেই হবে সর্বভূতে সাক্ষাৎকার। চাই ঈশ্বরে প্রেম। প্রেমই মধু। সেই মধু ব্রহ্মের ভজনা
করো।
ওঁ মধু।। ওঁ মধু।। ওঁ মধু।।
মধু বাতা ঋতায়তে।।
চ ল বে