সহজ মানুষ-সহজপাঠ(আজ বত্রিশতম পর্ব)

ধারাবাহিক গদ্য পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

ধারাবাহিকেরর পরবর্তী অংশ

তোমাদের চৈতন্য হোক (বিশেষ নববর্ষ পর্ব)

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়

আজকের এই পুন্য দিবসে-
মাননীয় পাঠক বৃন্দকে, শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা অভিনন্দন ভালবাসা ও শুভকামনা
জানাই।
এবং ” বাইফোকালিজম্ ” এর এডমিন প্যানেলের
সকল সদস্য / সদস্যা দের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও
অভিনন্দন নিবেদন করি।

” সহজ মানুষ সহজ পাঠ ” আজ ৩২ তম পর্বে পা
দিল, আপনাদের ভালবাসার জোরে। এরজন্য সাধুবাদ আপনাদের প্রাপ্য। আমি, ঠাকুর মা আর
স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ ভরসা করে তাঁদের
কথা লিখি। গোটাটাই ‘ গংগা জলে গংগা পূজো ‘।
আমার না আছে সাধন – ভজন, না আছে স্তব-স্তুতি। আছে তাঁদের চরন বন্দনা করার মতো
ভক্তি শ্রদ্ধা আর অন্তরের আকুলতা।

যাঁরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ,জগজ্জননী মা সারদা, আর স্বামী বিবেকানন্দ মহারাজের জীবন চর্চার
সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় এই
প্রবন্ধ গুলির সাথে পরিচিত। আসলে এই দিব্য
ত্রয়ীর পুন্যজীবন পুনঃপুনঃ স্মরনে মননে আনলে
নিজেদের মনোজগতই আলোকিত হয়ে ওঠে।
অনেক অনুভব, অনেক বিশ্বাস, অনেক বিচার,
অনেক বুদ্ধি, অনেক দর্শন, নিয়ে আলাপ আলোচনা করলে, নিজেদের অন্তরের দৃষ্টিকোণ,
পরিচিত চৌহদ্দির মধ্যেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

আজ পয়লা জানুয়ারী। শ্রী রামকৃষ্ণ অনুগামীদের
কাছে এক মহা শুভদিন। আজ “কল্পতরু “দিবস।
কাশীপুর উদ্যানবাটিতে সেদিন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
“কল্পতরু ” হয়ে সেখানে উপস্থিত সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে ছিলেন। আর বিখ্যাত এক
উপদেশ দিয়েছিলেন। যা আজও মানুষের মনের
কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আসছে নানা ভাবে।নানা
দর্শনে। নানা জনের নানা উচ্চারণে। কখনো
জটিল দার্শনিক দক্ষতায়, তো কোথাও ঘরোয়া খোলামেলা সাদামাটা ব্যাখায়।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন, সেই ক্ষনে,সমগ্র
জগতবাসী কে শুনিয়েছিলেন, তিনটি শব্দের
এক জগদ্বিখ্যাত উক্তি, যা সকল মানবজাতির
চিন্তা ও দৈবী চিন্তনের চিরন্তন উপলব্ধিতে
ভরপুর এক পূর্ণাঙ্গ বাক্য ” তোমাদের চৈতন্য হোক”।
মানুষের সব আছে, কিন্তু চেতনা বা চৈতন্য নেই।
সে বুদ্ধিমান, কিন্তু চৈতন্যহীন।
ভীড় বাসে আরও
অনান্য সহযাত্রীদের মধ্যে বসে, ধূমপান শুরু করে
দিলে।এখনো ট্রেনে বাসে লিখে রাখতে হয় ” ধূমপান করিবেন না “। ” চলন্ত রেলগাড়ীতে বা বাসে মাথা জানালার বাহিরে রাখিবেন না। ” এখানে ময়লা ফেলুন “। ” ( ঠাকুরের সময় ছিল না,এখন হয়েছে) ” সামাজিক দূরত্ববিধি বজায়
রাখুন বা সর্বদা মাস্ক ব্যাবহার করুন।”
— এ লক্ষ্মণ গুলি চেতনার অভাব থেকে জন্ম
নেয়। এ অভাব, এ ঘাটতি ঠাকুরের আমলে ও
ছিলো , এখনো আছে। এবং ততটাই আছে।
তখনও ঠাকুর বলেছেন, “হরিনামের ঝোলা নিয়ে
বসে জপ করতে করতে ইশারায় মাছ কেনার
গল্প। ” হরিবাসরে বসে পাশের বৌ’ টির সাথে যত
কথা, ফিসফিসানি। অন্যের অসুবিধা হবে – এই
সামান্য বোধটুকুও মানুষের থাকে না।


এখনো সরকারের তরফ থেকে সচেতনতা – শিবির বসাতে হয় গ্রামে গ্রামে, এমনকি শহরেও।
” জলের অপচয় করবেন না ; গাছ কাটবেন না ;
প্লাস্টিক ব্যাবহার বন্ধ করুন; গুজব ছড়াবেন না”
এমন হাজারো নির্দেশ এই সব শিবিরে দেওয়া হয়।
জনগন কী এতটাই বোকা যে এসব জানেন না?
সবটাই জানেন ;কিন্তু সচেতন নন। আমার স্বার্থ
যতক্ষণ ক্ষুন্ন না হচ্ছে – ততক্ষণ নড়ব না। এইরকম মনোভাব। অর্থাৎ সেই ‘ চেতনার ‘ অভাব। চৈতন্যের আকাল।

আর সেজন্যই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেলেন, “তোমাদের চৈতন্য হোক।”
সনটা ১৮৮৬। তারিখ ১ লা জানুয়ারী। আজ থেকে প্রায় ১৩৪ বছর আগের কথা।
তখন তিনি খুবই অসুস্থ। এক মারন রোগে
ভুগছেন। গলায় ক্যান্সার। গলা ভাত, সুজির
পাতলা পায়েস – তাও গলা দিয়ে নাবে না। কষ্ট
হয়। ভক্তরা বারবার অনুরোধ করছেন, ঠাকুর,
একবার আপনার মা,— – মা ভবতারিণীকে বলুন।
দেখুন, উনি ঠিক শুনবেন আপনার কথা।ভালো
হয়ে যাবেন। খেতে পারবেন। আপনার এ্যাতো
কষ্ট আমরা দেখতে পারছি না।

এমন অনুরোধ নরেনও বহুবার করেছে।যে নরেন
কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের সন্তানের মত দেখেন, বলেন, ” নরেন খাপখোলা তলোয়ার।
মাছেদের মধ্যে নরেন রাঙা চক্ষু রুই। বাকি সব
কাটা বাটা। অর্থাৎ চুনোপুঁটি। নরেন বসানো
শিব নয়, ও পাতাল- ফোঁড়া শিব। নরেন সপ্তঋষীর এক ঋষি। ” তার অনুরোধের জবাবে
ঠাকুর বলেছেন” লজ্জা করে রে, নিজের জন্যে
বলতে। ” নরেন ও ছাড়বার পাত্র নয়। সে বলল,
” আমাদের জন্য বলবেন। আমরা কী আপনার
কেউ নই? “
— ঠাকুর বল্লেন : “তুইও বলছিস? দেখি, যাব।”
— স্বামীজী বল্লেন : আজই যাবেন। আমাদের
জন্য মনটা গামছা নিংরোনোর মত হয় না বুঝি? “

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গেলেন মা ভবতারিণীর মন্দিরে। নরেনের কথার চোটে। আবার ফিরেও
এলেন।
— নরেন দৌড়ে গিয়ে শুধালো ” কী বললেন, আপনার মা? দেখবেন, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
— “না রে, হল না “। ঠাকুর বললেন, ” মা ভবতারিণী বললেন, “এক মুখ বন্ধ তো কী?
এখন থেকে তুই হাজার মুখে খাবি। লক্ষ মুখে
সেই স্বাদ গ্রহণ করবি। “
শুনেই নরেন মন্দির চাতালে পাথরের মূর্তির মতো
বসে রইলেন।

সেই থেকেই ঠাকুর অত্যন্ত দূর্বল। বিছানায় মিশে
গিয়েছেন যেন।
কিন্তু সেদিন, অর্থাৎ ওই ১ লা জানুয়ারী ১৮৮৬,
বিকালে, ঠাকুরের মনে হলো তাঁর কোনো রোগ
নেই। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ।
তখন শীতকাল। ঠাকুর গরম জামা পড়েছেন।তার ওপর একটি পিরান।লালপেড়ে ধুতি। কানচাপা টুপি।পায়ে চটি। তাঁকে দেখে মনেই হচ্ছে না তিনি একজন রোগী।

কাশীপুর উদ্যানবাটীর দোতলা থেকে ঠাকুর সিঁড়ি
দিয়ে টকটক করে নিচে নেবে এলেন। নরেন, অর্থাৎ আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ ও অনান্য
অন্তরঙ্গ পার্ষদ রা পাশের ঘরে বিশ্রাম করছে,
আহা! করুক, ওদের ডাকিস নে, রাতভোর ওরা
ঠাকুরের সেবা করেছে, একটু ঘুমুক। সংগে লাটু
ছিলো। পরবর্তী কালের স্বামী অদ্ভূতানন্দ মহারাজ। লাটু মহারাজ। তিনি ভাবলেন, ঠাকুর
যখন নিচে নেবে এসেছেন, তো এই সুযোগে ঠাকুরের ঘরটা একটু ঝাঁট- পাট দিয়ে পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন করে, বিছানা মাদুর একটু রোদে দিয়ে আসি। তিনি আবার ওপরে উঠে গেলেন।

নিচের বাগানে তখন বেশ কিছু ভক্তের ভীড়।
ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন হওয়ার জন্য সেদিন ছুটি ছিলো। যাঁরা অফিস আদালতে কাজকর্ম করেন তাঁরাও এসেছেন ঠাকুরকে
দেখতে।তাঁরা ঠাকুরকে দোতলার ঘরে শুয়ে থাকা
অবস্থায় দেখবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু তার বদলে
এমন সুস্থ স্বাভাবিক ঠাকুরকে দেখে, তাঁর নামে
জয়ধ্বনী দিতে শুরু করলেন।

শ্রী গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের পরম ভক্ত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও গিরিশকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন ” গিরিশের পাঁচসিকে পাঁচ আানা বিশ্বাস! এরপর লোকে ওর অবস্থা দেখে অবাক হবে। ” গিরিশ ও ঠাকুরকে সাক্ষাৎ ভগবান —
জীব উদ্ধারে এবার অবতীর্ণ বলে – সকলের কাছে
বলতেন।সেই গিরিশ ঘোষ ও সেদিন সেই সময়
সেখানে উপস্থিত।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অন্য ভক্তদের সঙ্গে বাগানে এসে পৌঁছাতেই গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের কাছে
এগিয়ে এসে তাঁর সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ল।
গিরিশ যে, ঠাকুরকে সাক্ষাৎ ভগবান, পূর্ণব্রহ্ম
নারায়ণ, এবার নররূপ ধারন করে এসেছেন —
ইত্যাদি অন্য অন্য লোকের কাছে বলতেন, তা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এর কানে এসেছিল, এবং তিনি
এসব পছন্দ করতেন না। সেজন্য ঠাকুর গিরিশকে সামনে পেয়ে তাকে সম্বোধন করে শুধালেন, ” গিরিশ, তুমি কি দেখেছ, যে অত কথা
যাকে তাকে বলে বেড়াও?”
হঠাৎ করে এমন কথা ঠাকুর জিজ্ঞেস করবেন তা
গিরিশ ধারণা করতে পারে নি, কিন্তু তবুও নিজের
বিশ্বাসে সে অটল, অচল। সে নতজানু অবস্থাতেই
শ্রদ্ধার সঙ্গে বললে, ” ব্যাস বাল্মিকী যাঁহার কথা
বলিয়া অন্ত করিতে পারেন নাই, আমি তাঁহার
সম্বন্ধে,অধিক আর কী বলিতে পারি? “
গিরিশের অমন অদ্ভুত বিশ্বাসের কথা শুনে
ঠাকুরের মন উচ্চ ভূমিতে উঠে গেল এবং সাথে সাথে তিনি সমাধিস্থ হয়ে গেলেন ।
গিরিশও দেবভাবে ঠাকুরকে সমাধিস্থ হতে দেখে
” জয় রামকৃষ্ণ, জয় রামকৃষ্ণ ” বলে বার বার
ঠাকুরের পদধূলি নিতে শুরু করলেন।
ধীরে ধীরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এর মন উচ্চ ভূমি
থেকে নীচে নাবতেই ওই রকম অর্ধবাহ্যদশায় হাসি মুখে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” তোমাদের কি আর বলব, তোমাদের
চৈতন্য হোক। “

এটি তাঁর আশীর্বাদ – বানী। তিনি সব সময় মানুষের চেতনার জাগরণ চেয়েছেন। তিনি চাইতেন মানুষ একটু ভাবুক, তার নিজের সম্বন্ধে,
তার জীবন সম্বন্ধে। তিনি নিজেও ব্যাক্তি জীবনে
তাই চেয়েছিলেন। তাঁর কৌতুহলী মন, জিজ্ঞাসু
মন, অনেক তথ্য খুঁজে বেরিয়েছে দিনরাত।
‘ কেন নদীতে জোয়ার ভাঁটা হয়? , নদীতে বান আসে কেন? , সূর্য গ্রহণ কেন হয়?, বিদ্যাসাগর
মশাই কেমন মানুষ ?, দেবেন ঠাকুরের ঈশ্বর
সম্বন্ধে মতামত কী? —– সব তিনি জানতে চান যেমন —ঠিক তেমনই জানাতে চান মা, ভবতারিণী —
“তুই সত্যিসত্যিই চিন্ময়ী না মৃন্ময়ী ?

” আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা, চৈতন্যময়ী”।

ঋণস্বীকার :১) ।। ধ্যান ও শান্তি।। শ্রীমৎ স্বামী
সোমেশ্বরানন্দজী মহারাজ।।
২) শ্রীরামকৃষ্ণ এর গুরুভাব।। শ্রীমৎ স্বামী
সারদানন্দজী মহারাজ।। গ্রন্থ : কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণ।।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *