পদ্ম পাতায় জল (ছয়)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সমস্ত রকম সাধনা সরে ফেললেন
দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়িতে মা ভবতারিণীর মন্দিরে।
তাঁর এই সাধনা, সর্বধর্মে- সাধন। ইসলাম ধর্ম,খৃষ্ট
ধর্ম, বেদান্ত ধর্ম, তন্ত্র সাধনা, সব কিছু সেরে উঠে
এক বৈপ্লবিক উক্তিতে গোটা বিশ্বকে জানালেন,
তাঁর সেই মহাকালের সেরা উপলব্ধি, ” যত মত তত পথ “। তিনি বললেন, ” সব ধর্মই সমান। কেউ
ছোট নয়, কেউ বড় নয়। ” শুরু হল এক নতুন
অধ্যায়। ” সর্ব ধর্ম সমন্বয় ” ভাব আন্দোলন।
★
ঠাকুর জানতেন এই ধর্ম বিপ্লবে তাঁর চাই কিছু চন্দন তরুর মত শুদ্ধ সত্ব সন্তান দল। একান্ত
আপন পার্ষদ। মা ভবতারিণীর কাছে তাঁর একান্ত
প্রার্থনা ছিলো, ” মা, কিছু সোনার টুকরো ছেলে
এনে দে। যারা আমার ভাব প্রচারে আমাকে সাহায্য করবে। “
অবতাররা যখন অবতীর্ণ হন তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সেই সময় কালে তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদরা ও
কোথাও না কোথাও জন্ম নেন এবং এসে মিশে
যান সেই অবতারের মূল স্রোতে। এ উদাহরণ
সব ভগবানের ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই।
গৌতম বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণ
সবার জীবনে। সবার লীলা প্রসঙ্গে। এঁদের সবার
দিব্যলীলা সাতরঙা রামধনুর মতো উজ্জ্বল হয়ে
আছে রামকৃষ্ণালোকেও।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিনেশ্বরের মন্দিরের কুঠী –
বাড়ির ছাত থেকে চিৎকার কার ডাক দিতেন “কোথায় তোরা, আমার ঈশ্বর -কোটি ভক্ত সন্ন্যাসী
সন্তানদল? আয়, আরও একটা দিন চলে গেল।
তোরা সব কে কোথায় আছিস, আয় রে? ” একে
একে এসে জুটে গেলেন ষোলো জন অন্তরঙ্গ পার্ষদবৃন্দ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এর চরণতলে।
ঠাকুর, তাঁর নিজস্ব ভাষায় তাঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন ” সংসারের তপ্ত খোলা থেকে
ছিটকে বেড়িয়ে আসা দাগহীন শুদ্ধ ধানের খই। “
★
দক্ষিনেশ্বরের নহবতের ওই ছোট্ট ঘরটিতে, তখন আমাদের জন্ম জন্মান্তরের মা, মা সারদা ঘোমটার আড়ালে নিজেকে আড়ালে রেখে নিজের শক্তি – সাধনায় এবং সেবায় রত। এরই
মধ্যে এসেছেন নরেন – পরবর্তী কালের স্বামী বিবেকানন্দ। রাখাল – পরবর্তী কালের স্বামী ব্রহ্মানন্দ। লাটু – পরবর্তী কালের স্বামী অদ্ভূতানন্দ। বুড়োগোপাল – পরবর্তী কালের স্বামী
অদ্বৈতানন্দ। বাবুরাম – পরবর্তী কালের স্বামী
প্রেমানন্দ। যোগেন – পরবর্তী কালের স্বামী যোগানন্দ। শরৎ – পরবর্তী কালের স্বামী সারদানন্দ। সারদাপ্রসন্ন – পরবর্তী কালের স্বামী
ত্রিগুণাতীতানন্দ। নিরণ্জন- পরবর্তী কালের স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। তারক – পরবর্তী কালের স্বামী
শিবানন্দ। শশী – পরবর্তী কালের স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। হরি – পরবর্তী কালের স্বামী
তুরীয়ানন্দ। হরি প্রসন্ন – পরবর্তী কালের স্বামী
বিজ্ঞানানন্দ। গঙ্গাধর – পরবর্তী কালের স্বামী
অখণ্ডানন্দ। কালী- পরবর্তী কালের স্বামী
অভেদানন্দ। এবং খোকা; -পরবর্তী কালের স্বামী
সুবোধানন্দ মহারাজ । আর এই সব সন্তানদলের
মাথায় সর্বদা বিরাজ করেছেন, মা সারদা সরস্বতী সংঘজননী হয়ে।
★
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন আর স্থূল দেহে নেই, তখন পৃথিবীটা “আলুনি ” হয়ে উঠেছিল মা সারদার কাছে। ঠাকুর বলে গেছিলেন, মা’ কে
“আমার অবর্তমানে কারোর কাছে কিচ্ছুটি চাইবে না। কামারপুকুরে ফিরে গিয়ে রঘুবীরের সেবা- পূজা করবে, বাড়িতে শাক বুনবে তারপর শাকান্ন
রঘুবীরকে নিবেদন করে নিজে প্রসাদ পাবে।”
এরমধ্যে দক্ষিণেশ্বর মন্দির কতৃপক্ষও ঠাকুর
শ্রীরামকৃষ্ণ এর মাসিক বেতন ‘ সাতটাকা’, তাও
বন্ধ করে দিয়েছিল।শুনে মা সারদা বলেছিলেন,
” আমার অমন স্বামীই চলে গেলেন, যিনি স্বয়ং
নারায়ণ আমার কাছে আর সামান্য ওই ক’ টা
টাকা বন্ধ হয়ে ভালোই হয়েছে। “
— মায়ের কারোর কাছে কোনো
অভিযোগ নেই। কোনো প্রতিবাদ নেই। কোনো
অশান্তি নেই।
★
একদিন মা সারদা কামারপুকুরে বসে বসে ভাবছিলেন — যা এমন সময়ে সব মানুষই ভাবে।
কোনো সন্তানাদি নেই, ছেলেপুলে নেই। কি হবে? কেমন করে চলবে আগামী দিনগুলো? —
বিশ্বজননীর একটা সন্তানের জন্য হা – হুতাশ।
নি: সহায় এক অবলা নারীর চিন্তা!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেন বললেন মা সারদাকে,
আড়াল থেকে , ” এ্যাতো কী ভাবছো বসে বসে?
তুমি একটি ছেলে চাইছ তো? আমি তোমাকে
এমন সব সোনার টুকরো ছেলে, রত্ন ছেলে দেব-
যে সব ছেলেদের মাথাকাটা তপিস্যে করেও
মানুষ পায় না “।
★
এই সব ছেলেরাই ওই নরেন, রাখাল, লাটু,শশী,তারক – এরা সব। মোট ষোলো জন।
ওরাই চন্দন তরু।ওরাই সূর্যোদয়ের আগে তোলা
মাখন।ওরাই মল্লিকা ফুলের মতো শুভ্র খই।এঁদের
দলপতি নরেন্দ্রনাথ। বিশ্বজয়ী বীরসন্ন্যাসী স্বামী
বিবেকানন্দ।
আমাদের জগতের মা, মা সারদা তখন সশরীরে
লোকচক্ষুর আড়ালে দক্ষিণেশ্বরে” নহবতে” বাস
করছেন। সবাই জানে মা আছেন, কিন্তু কেউ
তাঁকে দেখতে পায় না। চেনা তো অনেক দূর! অথচ সবাই এটা বুঝতে পারে অদৃশ্য এক স্নেহের
ফল্গুধারা অজান্তে তাঁদের ঘিরে রেখেছে। কে কখন কী খাবে মা জানেন। কার কেমন পথ্য মা
জানেন। নরেনের জন্য চাই মোটামোটা রুটি আর
ঘন ছোলার ডাল। মা জানেন। কোন সন্তানের
দক্ষিণেশ্বর থেকে বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়া বা নৌকা ভাড়া লাগবে মা ঠিক সেই কটা পয়সা
চৌকাঠের পাশে নাবিয়ে রেখেছেন। তিনি যে মা!
তিনি সবার জীবনের খবর না রাখলে কে রাখবে?
ক্রমে ক্রমে সব ছেলেরাই মনে প্রানে বুঝতে
পারলো তাঁদের এই মা, প্রতিদিনের মা। চির
দিনের মা। সত্য জননী ।
তিনি নিজেও বলে গেছেন সেই বিখ্যাত বানী
” আমি সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়, সত্য জননী। “
— তিনি স্বরূপত ” সচ্চিদানন্দস্বরূপিনী জগদ্ধাত্রী
জগজ্জননী। “
চ ল বে…
তথ্যসূত্র : – পূজনীয়া প্রব্রাজিকা অশেষপ্রানা।।
” জন্ম জন্মান্তরের মা।।পৃঃ ১৫০।।