মা সারদা, এক উজ্জ্বল মাতৃমূর্তি
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
শ্রীশ্রী মা সারদা ছিলেন জগজ্জননী। তিনিই
সৃষ্টির নিমিত্ত, আবার তিনিই সৃষ্টির উপাদান।
তিনিই আধার, আবার তিনিই আধেয়। তিনিই
মা, আবার তিনিই ঠাকুর স্বয়ং। এক।অভিন্ন।
অভেদ। কোনো ভেদ নেই, কোনো আড়াল নেই।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে মুখে বলে গেছেন, ” তুমি
আর আমি কী আলাদা? আজ এই পর্বে আমরা সেই মায়ের কথা শুনবো। শুনবো তঁার নানান লীলা কাহিনী। শুনবো নানা মাতৃভূমিকা।সামনে অতি সামান্য এক গ্রাম্যনারী, পিছনে স্বয়ং মা জগদ্ধাত্রী। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘের সংঘজননী, যথার্থ গর্ভধারিণীও।দক্ষিনেশ্বরে ঠাকুরের নানা লীলায়, পর্দার আড়ালে পথেকে মা সম্পূর্ণ করেছেন তঁার নিজ মাতৃভূমিকা। তারপর ঠাকুরের লীলা পর্বের শেষভাগে, ঠাকুরেরই নির্দেশে, বুক দিয়ে রক্ষা করেছেন রামকৃষ্ণ সংঘকে। আগলে রেখেছেন ঠাকুরের অন্তরঙ্গ পার্ষদদের, নিজ ভক্তদের, শিষ্যদের, এবং আমাদের মতো সাধারন গৃহস্থদের। এই ধারা এখনো নদীর স্রোতের মত বহমান এখনো, যে কেউ, ওই মাতৃমূর্তির মুখের দিকে আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তি নিয়ে সজল নয়নে তাকালে তিনি যেন এখনো, চোখে চোখে বলেনঃ ” ভয় কী বাছা, আমি তো আছি, আমি মা, সবার মা, এই জগতের কীটটি পর্যন্ত আমার সন্তান। ভয় পেয়ো না।” ” গুরোর্মধ্যে স্থিতা মাতা, মাতৃমধ্যে স্থিতো গুরু”
বলেছেনঃ ” আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।
সবাই আমার সন্তান। কেউ যদি ধুলো-কাদা মাখে,
আমাকেই তো তাদের ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে
হবে। আমি যে মা। “কী অসামান্য বানী। কী মধুরতা! কী মুগ্ধতা! কথা গুলি শুনলেই মনে হয় একজন বড় আপনার জন একথা বলছেন। কত আত্মবিচার। কী অনন্ত শক্তির এক দৈবী আধার! তিনি গুরুর মধ্যে ” মা ” হয়ে আছেন, আবার মায়ের মধ্যে আছেন ” গুরু ” হয়ে। মা সারদা সমস্ত কুসংস্কার, দেশাচার, ও লোকাচারের গন্ডীর মধ্যে থেকেও, নিজেকে এগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। এটি কিন্তু খুব সহজ কাজ ছিল না। মাননীয় পাঠক, এটা বলা এবং বাস্তবে করে দেখানো সমগ্র জগতবাসীকে জানানো বড়ই কঠিন কাজ। একজন লেখাপড়া না জানা, গ্রাম্য মহিলা হয়ে, সেই সময়ের গ্রাম বাংলায় এবং পরবর্তীকালে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায়, যে ভাবে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছিলেন, তা চিন্তা করলে আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেই সময় কালের পুরুষ শাসিত সমাজে তিনি অনেক সময় এমন সাহসিকতার সঙ্গে ; সংসারে এবং রামকৃষ্ণ মঠের কর্মকাণ্ডে, নিজেকে তুলে ধরে ছিলেন, যা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। এ সব কিছুই তিনি করতে পেরেছিলেন তাঁর অনন্ত আত্মশক্তির জোরে। এবং অবশ্যই এ জগৎকে ভালবেসে। আমাদের কে সন্তান স্নেহে দেখেছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। গোটাটাই ছিলো তাঁর “ঠাকুরের সংসার”। এর মধ্যে ধর্ম – জাতি – বর্ণ – দেশ- কাল- ভাষা সংস্কৃতি প্রভৃতির গন্ডী তঁাকে বঁাধতে পারেনি। তিনি ভগিনী নিবেদিতাকে ( তখন মার্গারেট নোবেল) “খুকি” বলে যে ভাষায় কথা বলতেন নিবেদিতাও তা উপলব্ধি করতে পারতেন। শুধু ভালবাসার প্লাবনে এ সব সম্ভব হতো। সেই সময়ে একজন বিদেশিনীকে কাছে বসিয়ে তাকে খেতে দেওয়া ও থাকতে দেওয়া, একজন সাধারন রমনীর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। যে সময় সমাজে শ্বেতাঙ্গ মানুষদের ম্লেচ্ছ ভাবা হত। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সব সময় এদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতো। কেননা তারা ছিলো খৃষ্টান। অন্য ধর্মের মানুষ। তারা ছাইপাঁশ খায়। যে অপরাধে নিবেদিতাকে রানী রাসমনির দক্ষিনেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি সেইসময়। স্বামী বিবেকানন্দ; যিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা, তাঁকেও শুধু সাগর পেরনোর অপরাধে, (তখন বলা হত ‘ কালাপানি ‘) নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়েছিল, সেই সময়ের সমাজে।তখনকার সমাজপতিরা স্বামীবিবেকানন্দ কে এড়িয়ে চলত। এবং শুনলে মর্মান্তিক লাগে, শুধুমাত্র সাগর পারে যাবার জন্য এবং মাংস ভক্ষন করার অপরাধে স্বামীজীর কোলকাতা সভার সভাপতিত্বে কোনো বিদ্বৎজন পন্ডিত রাজি হননি। এর থেকেই বোঝা যায়, মা সারদা কত ব্যাক্তিত্ব সম্পন্না নারী ছিলেন। না হলে এই সব ঘটনায় তাঁকেও অপদস্থ হতে হতো।কেননা স্বামীজী এবং নিবেদিতা, দুজনকেই মা সারদা স্নেহময় টানে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। সেই সময়ের সমাজে জাত পাতের গভীর প্রভাব ছিলো।
তা সত্বেও তিনিই বলতে পেরেছিলেন.. ” আমার আমজাদ ও যা, আমার শরৎ ও তা”। আমজাদ কে? আর শরৎ ই বা কে? আমজাদ একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমান। তথা তার পেশা ডাকাতি করা। আর শরৎ হলো একজন উচ্চকোটির সন্ন্যাসী এবং রামকৃষ্ণ ভাবগ্রাহী; রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারন সম্পাদক। এ দুজনের কোনো তুলনাই কোনোদিন হতে পারে না। তথাপি মা সারদার কাছে শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে, দুজনের কোনো তফাৎ ছিলো না। তাঁর স্নেহের কাছে, আত্মার আত্মীয়তার কাছে, ভালবাসার কাছে, মানবতার কাছে সকলেই ছিলো এক। একই প্রেম নদীর সব উচ্ছ্বল
ঢেউ যেন………..
( চলবে )