পরবর্তী অংশ
আমাদের সবার “মা” মা সারদা
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
আমাদের ঘরের মা’য়ের থেকে তাঁকে কোনো ভাবেই আলাদা করতে পারবেন না। –কেন না তিনি জন্ম থেকেই আপনার আত্মার আত্মীয়। তাঁকে দেখলেই মনে হবে একটিবার “মা” বলে ডাক দিই। তাঁর চোখের দিকে সরাসরি তাকালেই মনে হবে যেন তিনি কিছু বলছেন। শুধাচ্ছেন, ” বাবা, ভালো আছ তো? ”
তিনি কে?
তাঁর চেহারা, জীবন- দর্শন, ব্যাবহার, কথাবার্তা,
ঘরের কাজ, অতিথি- বাৎস্যলতা, সর্বজীবে সমান দয়া, আর অহৈতুকী স্নেহময় বন্ধণ, সকলের জন্য
যিনি উন্মুক্ত করে রেখেছেন — তিনি কে? তিনিই আমাদের সকলের ” মা সারদা “। অতি সাধারণ একজন গ্রাম্য গৃহস্থ বাড়ির গৃহিণী তিনি। আপাত দৃষ্টিতে, একজন এলেবেলে লেখা পড়া না জানা সহজ সরল মহিলা। কিন্তু অনন্য জীবনচর্চায়, ত্যাগে, তিতিক্ষায়, সবার প্রতি সমদৃষ্টিতে সমৃদ্ধ, প্রতিটি মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গার নাম – ” মা সারদা “। নির্দ্বিধায় সকলের ভালো মন্দ গ্রহণ করে তাকে সঠিক দিশা দেখানোর অপর নাম –” মা সারদা।’ মা সারদা ছিলেন নিরব সাধিকা। অচঞ্চল নিরবতা,ধৈয্য, শান্তি,আর আত্মনিমগ্ন হয়ে, ঈশ্বরে আত্মনিয়োগ ছিল – তাঁর জীবনের সংগী।ভোর
তিনটের সময় উঠে লক্ষ্যবার নাম- জপ করে আামাদের শিখিয়ে গেছেন ধর্ম কী, জীবনচর্চা কী, বাঁচার পথ কোন দিকে! ভালোবাসার দিকে….
সত্যের দিকে.. ন্যায়ের দিকে….. ধর্মের দিকে….
তাঁর আকুলতা লক্ষ্য করা গেছিল তিনি যখন
নিতান্তই ছোট। অত্যন্ত গরীব ঘরের কিছু মানুষ
এসেছে তাঁদের বাড়িতে দুপুরের খাবারের জন্য।
কেননা, সেইসময়, গোটা দেশ জুড়ে চলছে মহা-মারি। সেই সঙ্গে অনাহার। দুর্ভিক্ষ। খাদ্যের জন্য মানুষ ভিক্ষা করছে। মা সারদার পিতৃদেব
তাঁর সঞ্চিত খাদ্য- ভান্ডারে যতটুকু চাল ডাল
মজুত ছিল তার থেকে রোজ খিচুড়ি রান্না করে
ওই সব দরিদ্র মানুষের জন্য রাখতেন। তারা এলে তাদের বসিয়ে খেতে দেওয়া হতো। একদিন, মা সারদা দেখছেন – গরম খিচুড়ি পাতে পড়েছে, লোকটি অত গরম খিচুড়ি খেতে ও পারছে না, আবার পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা। অপেক্ষা ও করতে পারছে না। তখন একটা তালপাতার পাখা যোগাড় করে নিয়ে মা সারদা – তখন ওঁর মা- বাবার আদরের ‘ সারু’, ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতে সেই মানুষটির পাতের কাছে বসে হাওয়া করতে লাগলেন। কেউ তাকে বলেনি, কেউ এগিয়ে দেয়নি হাতপাখা খানি। নিজের আগ্রহে, ভালোবাসার টানে, হৃদয়ের আনন্দে, অন্য এক ধরনের স্বভাবে,অপরের অসুবিধা দেখে এগিয়ে আসার মানসিকতায়-নিজেকে এমন উৎসর্গ, এ আমাদের মা’য়ের পক্ষেই সম্ভব।
পরবর্তী কালে আমরা দেখেছি, মা সারদা সমাজের সব ধরনের মানুষের সংগে কী আনন্দে
মিশে থাকতেন। সবাইকে তাঁর ভালোবাসায় কেমন ভিজিয়ে রাখতেন আর সবাইকে তাঁর স্নেহের
অমৃত ধারায় আপন আত্মজের মতো সিক্ত করে
রেখে গেছেন। বলে গেছেন ” আমি সত্যিকারের
মা। গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা
মা নয় — সত্য জননী।”
আমরা দেখেছি, জয়রামবটিতে থাকাকালীন
মা নিজের তিন ভাই, তাদের সংসার, ভাইঝি দের,
তাদের সন্তানাদি, এমন সকলকে নিয়ে এবং
তার সাথে তাঁর ভক্তরা, এছাড়া আরও আত্মীয়
আপনজন, বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে সংসারে সানন্দে কাটিয়েছেন। তাঁর একদম কাছের মানুষরাই তাঁকে শান্তি দেয়নি। তারা অনেকেই ছিল কলহপরায়ন, ধান্দাবাজ গোছের। মা সারদা সব বুঝতেন – কিন্তু হাসিমুখে সব সহ্যও করে যেতেন। কোনো কিছুই তাঁকে ছুঁতে পারত না। আমাদের মত গৃহীদের তাঁর কাছ থেকে এ ব্যাপারে শিক্ষা নেওয়ার বিশেষ দরকার। সংসারে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় থেকেও তিনি নির্বিকার থাকতে শিখিয়ে গেছেন।
তিনি শান্তিরূপেণ সংস্থিতা। তাই তিনিই একমাত্র
শোনাতে পারেন, এই অমোঘ বাণী, ” যদি শান্তি
চাও মা, কারো দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগতকে আপনার করে নিতে শেখ।
কেউ পর নয় মা, জগত তোমার। ” — এই উপদেশ সমগ্র জগতবাসীর জন্য।
মায়ের শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু স্থানীয় – যেমন যোগীন মা, গোলাপ মা হয়তো ক্ষুন্ন হয়েই শুধিয়েছেন -“এরা, মা তোমার মত দেবীর সঙ্গে দিনরাত কাটিয়ে দিচ্ছে অথচ একটু জ্ঞান হচ্ছে না, হুঁশ হচ্ছে না, চেতনা হচ্ছে না। কেন মা?” উত্তরে মা সারদা খুব হেসে হেসেই বলেছেন, “চন্দন বনের সব গাছই কি সুগন্ধ বহন করে?” কত তাৎপর্যপূর্ণ কথা। অর্থাৎ কোনো ভালো মানুষের ” ভাল” টা নেবার মতো পাত্র হতে হবে। সব পাত্রে সব জিনিস আঁটে না। সামঞ্জস্যপূর্ণ উদার একটা হৃদয় দরকার। আর এটা বোঝার মত একটা সুস্থ মন। আর সবচেয়ে আগে চাই মা সারদা সরস্বতীর অপার কৃপা ও করুনা প্রার্থনা।
মা চেয়েছিলেন সব মানুষের আত্মিক উন্নতি।
তাহলেই মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটবে। তাহলেই
সেই মনে, সেই জীবনে, সেই আত্মায় ইতিবাচক
অনাবিল আনন্দ আসবে। আর এমনটা হলে –
সেই মানুষটি ঈশ্বর সান্নিধ্য -অনুশীলনের পথে,
ভগবানের পথে এগিয়ে যেতে পারবে। মা বলেছেন – ” যারা এসেছে, যারা আসেনি, আর যারা আসবে — আমার সকল সন্তানদের জানিয়ে দিও, মা, আমার ভালবাসা,আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।” — এ শুধু কথার কথা নয়। মা সারদা দশভুজা হয়ে আমাদের রক্ষা করছেন। সর্বক্ষেত্রে। সর্বত্র। ডাকার মত ডাকতে পারলে তা বোঝা যায়।
সমাপ্ত