সহজ মানুষ-সহজপাঠ

 

পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

পরবর্তী অংশ… 

দেবী দুর্গার যানবাহন ও পূজা-পদ্ধতি

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য় 

প্রাচীন কাল থেকে, শাস্ত্রমতে, প্রত্যেকবার মা
দুর্গা স্বামীর ঘর থেকে (কৈলাসধাম) বাপের বাড়ি
( মর্তধাম) আসেন প্রধানত চারটি যানবাহনের
মাধ্যমে। মা দশভুজার আগমন এবং প্রত্যাগমন
ঘটে মূলতঃ হাতি (গজ), ঘোড়া ( ঘোটক), নৌকা,
এবং পালকিতে ( চতুর্দোলা)। এবার মা দশভুজার
দোলায় আগমন, এবং গজে গমন। এখন দেখুন, মা আসছেন বাপের বাড়িতে এবং তিনিই কিন্তু নিজের পছন্দসই যানবাহন ঠিক করে রাখছেন ফি বছর। এমন নয় যে একই পছন্দের যান প্রতি বছর সুযোগ পায়। তা হয় না। লক্ষ্য করার বিষয় হল– তিনি আসা যাওয়ার জন্য যে চারটি যান ব্যাবহার করেন , তার মধ্যে দুটি পশু – বাহিত; আর বাকি দুটি মানুষ-বাহিত। হাতি এবং ঘোড়া – এরা পশু, অন্যদিকে নৌকায় দাঁড় বায় মাঝি, আর পালকি বহনকারীদের বলে – বেহারা – তারা মানুষ। মা আমাদের সমদর্শী। তাঁর চোখে সক্কলে সমান। মায়ের মর্ত্যে আগমন এবং কৈলাসে প্রত্যাগমন- এই ধর্মযাত্রার মধ্যে, এই প্রথার মধ্যে, একটা ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। কী সেই ইংগিত? এটাই এই ধর্মযাত্রার শিক্ষা যে মানুষ এবং পশুপাখি
সকলেই এই জগৎসংসার বাসী। মা আমাদের
সবার রক্ষাকর্ত্রী। জগতের সবার শুভার্থী এবং
পরিত্রাতা। মানুষদের যেমন অভয়দান করেন রক্ষা করেন শুভকামনা জানান তেম্নি তাঁর কৃপা থেকে, করুনা থেকে পশুপাখিরাও বাদ পড়ে না। তারাও মাতা পার্বতীর আশ্রিত এবং পালিত। মা দুর্গার সংগে আছেন লক্ষী এবং সরস্বতী কন্যাদ্বয় ; আর কার্তিক ও গনেশ পুত্রদ্বয়। এঁদের চারজনেরই সংগে আছেন একটি করে বাহন।তারা দুটি পাখি। মা লক্ষীর বাহন প্যাঁচা, আর দেব সেনাপতি কার্তিকের বাহন ময়ূর। একটি উভচর প্রানী – হাঁস। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর সংগে আছেন বাহন হয়ে। অন্যটি একটি পশু মুষিক। এই জন্তুটি আবার গৃহস্থ বাড়িতে ও থাকে, আবার মাঠের শস্যক্ষেতে ও বাস করে। আবার গনপতি দেবের লাড্ডুর লোভে তাঁর বাহন হয়ে আছে পায়ের কাছে। অর্থাৎ পশু পাখি জলচর উভচর সকলকেই মা ঠাঁই দিয়েছেন চরনতলে। এই বাহনরাও কিন্ত মা দশভুজার সংগে পূজা পান। পূজিত হন। পশু পাখিরাও সম্মান পান। মায়ের সংসারে সবার আমন্ত্রণ। সবার নিমন্ত্রণ। মাতৃ বন্দনায় পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মন্ত্রে” সঃবাহনায়” কথাটি উচ্চারিত হয়ে থাকে।


এখন কথা হল দেবী দুর্গারও তো একটি বাহন
আছে। আর তিনি যে সে বাহন নন। একেবারে
পশুদের রাজা। পশুরাজ সিংহ। মা দুর্গা
তার পিঠে চেপেই তো আসতে পারেন?বাধা
কোথায়? পশুরাজ থাকা সত্বেও হাতি ঘোড়া নৌকা আর পালকির প্রয়োজনীয়তা কেন? বাধা একটা আছে। দুষ্ট অসুর মহিষাসুরকে বধ করতে মাদুর্গাকে সাহায্য করেছিলেন স্বর্গের সকল দেবদেবীরা। নানা অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করে তাঁরা দশভুজাকে পাঠিয়েছিলেন অসুর নিধনে। স্বয়ং বিষ্ণুূদেব পশুরাজ রূপ ধরে মায়ের সাহায্যকারী রূপে মায়ের বাহনের রূপ নিয়ে এসেছিলেন। তাই বাহন হলেও মা তাঁর পিঠে চেপে আসেন না। আর সেই কারনে দেবী প্রতিমায় প্রান প্রতিষ্ঠার আগে, অধিবাসের সময় বিষ্ণুরূপী সিংহকে ধ্যানমন্ত্রে অর্চনা করা হয়। পৈতে পরানো হয়। পূজা নৈবেদ্য দেওয়া হয় ষোড়শপচারে। সিংহ এখানে দেবী দশভুজার সাহায্যকারী দেবতাদের একজন।
মা দুর্গা শুধু মানুষ্যকূলকে নিয়ে, পশু পাখি
জলচর উভচর প্রানীকূলকে নিয়ে চলেন না —
তাঁর সংগে আসেন সমগ্র প্রকৃতি ” নবপত্রিকা “
স্নানের মাধ্যমে। নয় টি গাছের গুচ্ছ বা সমষ্টিতে
একতাবদ্ধ এক প্রকৃতি- সমাজ। নবপত্রিকায় যে কলাগাছ থাকে তিনি এখানে ব্রহ্মাণীর এক রূপ। কচুগাছ হলেন কালিকা। হরিদ্রাগাছ হলেন উমা।জয়ন্তী হলেন কার্তিকী। বিল্ব সহ বিল্বশাখা হলেন দেবী শিবা। ডালিম হলেন রক্তদন্তিকা। মানকচু হলেন চামুণ্ডা। ধানগাছ হলেন মহা লক্ষী। এবং অশোক এখানে “শোকরহিতা ” কে বোঝানো হয়েছে। দেবী দূর্গার মতো এ্যাতো পূজার জাঁকজমক এবং উপাচার আর অন্য কোনো পূজায় লাগে না। শাস্ত্র মতে পূজার জন্য যা প্রয়োজন তা অনেক সময়
জোগাড় করে ওঠা ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবু মা
আমাদের স্নেহময়ী। করুনাময়ী। কৃপাময়ী। সানন্দে
সন্তানের পূজা গ্রহণ করেন। কোনো এূটি কখনোও ধরেন না। তিনি অমৃতজ্যোতি! মহামায়া,
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী। এখনো, কোনো প্রাচীণ দেবীমূর্তির পূজায় এমন এমন উপাচার বা ভোগ লাগে যা শুনলে আশ্চর্য লাগে। কোথাও মায়ের ভোগে লাগে ” পান্তাভাত”, কোথাওবা ” ল্যাটামাছ পোড়া “। কচুর তরকারি,মাষ কলাইয়ের ডাল, এমন অতি সাধারণ পদ ও মা দুর্গার প্রিয় এবং পছন্দের। এবং আজও তা মা ভবানীকে , সযত্নে নিবেদন করা হয়ে থাকে। তিনি যে ঘরের মেয়ে। কন্যা রূপেন সংস্থিতা। দুর্গাপুর সন্নিকটে রনডিহায় বন্দোপাধ্যায় পরিবারের পূজায় যে রীতি এখনো চলে আসছে
তা হল — তাঁদের মন্ডপে মা দশভুজা প্রথানুযায়ী
ষষ্ঠী থেকে দশমী পূজা গ্রহণ করার পর পতিগৃহে
দশমীর সন্ধ্যায় ফিরে যান না। একাদশী থেকে
অমাবস্যা পর্যন্ত মন্ডপে থেকে পূজা গ্রহণ করেন।
ইতিমধ্যে মা কালীর মূর্তি তৈয়ারি হয় ওই একই
মন্ডপে,মা দশভুজার সামনেই। তারপর মা কালীর
পূজা সমাপনান্তে, মা দশভুজা এবং মা কালী একসাথে বিসর্জ্জনের শোভাযাত্রায় নিরঞ্জনের
শোভা বর্ধন করেন। সত্যিই অপূর্ব সেই প্রথা এবং
স্মরণীয় সেই দৃশ্য। আমার একবার সৌভাগ্য
হয়েছিল সেখানে এক আত্মীয়ের সাথে যাবার
এবং উভয় মায়ের প্রসাদ গ্রহন করার।

তিনি সর্ব রূপে, তিনি সর্বভূতের মধ্যে। তিনি
গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে। তাই কোনো বাড়ির আচার
পদ্ধতিতে ” মুড়ি চাল ছোলা ভাজা ” ভোগের পর বৈকালিক দেওয়া হয়, সন্ধ্যারতি পর্বের আগে।
এবারের পূজায় অনেক বাধা আবার অনেক
বাঁধন। মায়ের দর্শনেও আমাদের অনেক ধাপ
পেরতে হবে, আইন কানুন মেপে। আইন ভাঙা
চলবে না। এখন আমরা কোন্ পথে যে চলি!
কোন্ বিধি যে মানি! যিনি বিধাত্রী তাঁর কাছে
ঘেঁষতে ও “স্যানিটাইজার “লাগবে? জানি না।
মন্ডপ জীবানুমুক্ত নয়? তা ও জানি না আমরা।
শুনেছি অঞ্জলি, সিঁদুর খেলার অনুমতি নেই। হে মা মহামায়া, এই মহাবিশ্বের মহামারী ধ্বংস হোক
তোমার হাতে। পৃথিবী আবার সুস্থ হোক তোমার
আশীষে। বাতাস আবার শুদ্ধ হোক তোমার আগমনে। মানুষের মনপ্রাণ আবারও খুশিতে,
আনন্দে ভরে উঠুক তোমার আশীর্বাদে। সকল আগ্রহী পাঠককূলকে, ” বাইফোকালিজম” এর এ্যাডমিন প্যানেলের সমস্ত সভ্য/ সভ্যাবৃন্দকে এবং এই জীবনের পথে যেতে যেতে সব পরিচিত বন্ধুবান্ধব, আপনজনদের আজ, এই শুভ বিজয়া
দশমীর পুন্যলগ্নে আমার সপ্রীতি শুভেচ্ছা অভিনন্দন জানালাম। ছোটদের স্নেহাশীষ এবং গুরুজনদের প্রনাম জানাই।

চলবে

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *