মন নিয়ে (পর্ব-১)
মানুষের মন বড় বিচিত্র। এর গতি ও বিচিত্র। নদীর মত।কখনো দূর্বার তো কখনও শীর্ণ।বর্ষায় উচ্ছ্বাস তো হেমন্তে ঝিরিঝিরি।
এই মনে কখন কি আসে, কখন কি ভাসে – যার মন, সেই মানুষটিও হদিশ পান না। আবার যখন পান, তখন নতুন করে ভাবতে বসেন।
আসলে মানুষের “মন” বস্তুটিই বড় গোলমেলে। সারাদিন সারাক্ষণ কত যে ভাবনা, কত যে হুটুর-পাটুর চিন্তা এসে জড়ো হয়! আর সব সময় তারা মানুষটির বশেও থাকে না।
তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ ” মনকে বেঁধে রাখবি।ধর্মের দড়ি দিয়ে।শৃঙ্খলার শাসন। ঘড়ির কাঁটার মত সব সময় মনের মধ্যে ইষ্টদেবতার নাম- জপ করবি। তাহলে মন আর এদিক – ওদিক ছুটতে পারবে না, পালাতে পারবে না।বলেছেন ” মানুষ মনেতেই বদ্ধ, আবার মনেতেই মুক্ত। ”
না হলে মন বস্তুটি একটি বাঁদরের ছানা। এখনি নিজেকে নিয়ে ভাবছে, তো পরক্ষণেই ছোট নাতনিটির জন্য কাতর। এই এ ডালে তো ওই ও ডালে বসে দোল খাচ্ছে।
মন স্থির, শান্ত,আত্মস্থ যার সেই পারে সব সমস্যার সামনে দাঁড়াতে।সফল হয়।না হলে উল্টো।সেজন্যই ঠাকুর বলেছেন -মনকে ধর্মের বেড়ি পরাও।
জপ,ধ্যান,মেডিটেশন এগুলি মনকে স্থির করে। ভাবনাকে উন্নত করে। মনে চেতনা আসে।মনে চৈতন্য আসে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেনঃ “প্রতিটি মানুষের নিজের ওপর বিশ্বাস থাকার প্রয়োজন। নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখো। নিজের ওপর বিশ্বাস না এলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না।” তাই সব সময় পজেটিভ(Positive) চিন্তা রাখ মনের মধ্যে। মনকে উন্নত কর।সব সময় আলোয় ভরিয়ে রাখ তোমার মন।মনে কুয়াশা জমতে দিও না।আরও বলেছেনঃ- “পবিত্র আর নিঃস্বার্থ হতে চেষ্টা করো।তার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম।”
‘পবিত্র ‘আর’ নিঃস্বার্থ ‘– দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ন এবং স্পর্শকাতর শব্দ। পবিত্র হতে গেলে গঙ্গাস্নানে হবে না।তীর্থে তীর্থে ঘুরলে হবে না। পবিত্র হতে হবে মনে। শুদ্ধ হতে হবে মনে। আর নিঃস্বার্থ হতে হবে তোমাকে, তোমার কর্মে।তোমার ব্যবহারে। তোমার ভাবনায়।তোমার চিন্তায়।তোমার অন্তরে। তোমার অন্দরমহলে।
আর এই কর্মসূচির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল কথাটি। সেটি কী? সেটি হল “ধর্ম “। ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠান নয়।তিলক চন্দন নয়। ফুল বেলপাতা নয়।উপবাস পশুবলি নয়।
তাহলে ধর্ম কী? ধর্ম হলো একটি পবিত্রতা পূর্ণ মনে,সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ-সব কর্মই যা পরের উপকারে লাগে। একটি ক্ষুধার্ত পশুর মুখে কিছু খাবার তুলে দেওয়াই ধর্ম।একটি নিরন্ন মানুষের মুখে যদি অন্ন তুলে দিতে পারো তাহলে সেটিই পরম ধর্ম।
আর এ সব কাজ করতে তোমাকে উৎসাহিত করবে কে? তোমার মন। তোমার বুদ্ধি। তোমার বিবেক। তোমার ভাবনা। তোমার চেতনা। তোমার চৈতন্য।
১৮৮৬ খৃঃ ১লা জানুয়ারি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সমস্ত মানবজাতির উদ্দেশ্যে কাশীপুর উদ্যান বাটী থেকে বলে গেছেন– “তোমাদের চৈতন্য হোক।”
আজ থেকে ১৩৪ বছর আগের এই বানী আজও সময়োপযোগী এবং সমান প্রাসঙ্গিক।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ “মন মত্ত করী”। অর্থাৎ মন খ্যাপা হাতির সমান।এই মাহুত তাকে নদী থেকে স্নান করিয়ে আনলে, তখনই সে শুঁড়ে করে ধুলো তুলে নিজের গায়ে ছিটিয়ে দিল। এবার মাহুত কী করল? সে হাতিটিকে হাতিশালে এনে লোহার মস্ত শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখলে।
তেমনই মনকে ধর্মের শেকল পরাও।আত্মোপলব্ধি হবে। চেতনা আসবে। হনুমানের মতো লাফিয়ে এ ডাল ও ডাল করতে পারবে না তখন।
আর একবার মন বশে এলেই, তাতে আত্মস্ফূরণ ঘটবে।ঈশ্বর-চিন্তন, ঈশ্বর-অনুসরণ ঘটবে। সেই শুদ্ধসত্ত্ব মনেই হবে ঈশ্বরের আসা যাওয়া। আলোকিত মনই ঈশ্বরের রত্ন-সিংহাসন।
চলবে…