বাংলার পাখ-পাখালি-বিটার্ন কথা

 
★বাংলার পাখ-পাখালি নিয়ে লিখছেন —
                                             রাকেশ সিংহদেব

                                              ছবিঃ রাকেশ সিংহদেব
            
                         *বিটার্ন কথা*

বিটার্নরা জলাভূমির পাখি। আকারে সাধারণ কোর্চে বক বা Pond Heron এর তুলনায় অনেকটাই ছোট। দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও যত্রতত্র দেখা যায় না। আমাদের জেলায় সংখ্যায় অপ্রতুল, তার ওপর স্বভাবে অত্যন্ত লাজুক। সতর্কভাবে নিজেদের লুকিয়ে রাখে জলার পাশের কচুরিপানা, ঢোলকলমি, নলবন, ধানক্ষেত কিংবা জলার ধারের ঝোপজঙ্গলে। দেখতে কিছুটা সাধারণ কোর্চে বকের মতো মনে হলেও এদের গায়ের রঙ ভিন্ন। গায়ের রঙের সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের মিল থাকার দরুন খুব সহজে এরা ঝোপজঙ্গলের ভেতর লুকাতে সক্ষম হয়। বিচরণ করে একাকী। স্থান পরিবর্তনের সময় ‘কেকের-কেকের বা কাকাক-কাকাক’ স্বরে ডেকে ওঠে। নির্জনতা প্রিয় এই ছোট বক বা বিটার্ন ‘রা সব সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করে। নলবন কিংবা জলাশয়ের পাশের ঝোপ-জঙ্গলে একাকী বসে শরীরটাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে রাখে এরা। তবে সুযোগ পেলে বা পরিবেশ অনুকূলে থাকলে শিকারের নেশায় ধান ক্ষেতের আলে বসে মাছ কিংবা ব্যাঙাচি শিকার করতে দ্বিধাবোধ করে না।
 এদের বিভিন্ন প্রজাতির দেখা মেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশানিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা যায়। বিশ্বের প্রায় ৮৬ লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাব্যাপী এদের বিস্তৃতি। সংখ্যা এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি ফলে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

১. *বাংলা নাম: ‘হলদে বক’*
 *ইংরেজি নাম:  Yellow Bittern*
*বৈজ্ঞানিক নাম: Ixobrychus sinensis*

হলদে বক লম্বায় ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার। গলা খয়েরি, আকারে খাটো। ঠোঁট লম্বা, শক্ত মজবুত ও ধারালো। চোখের বলয় হলুদ, মণি কালো। পুরুষ পাখির মাথায় কালো টুপি। দেহের উপরের দিক হলুদ বাদামি। নিচের দিকটা হালকা হলুদ। ডানার পালক হলুদাভ বাদামি হলেও ডানার প্রান্তের পালক কালো। পিঠ গাঢ় বাদামি। ওড়ার পালক কালো। লেজের পালক কালচে। স্ত্রী পাখির মাথায় লালচে বাদামি রেখাযুক্ত পালকে আবৃত। উভয়ের পা ও পায়ের পাতা হলদে-সবুজ। শাবক দেখতে মায়ের মতো হলেও দেহের নিচের দিকে বাদামি রেখা বেশি দেখা যায়।

প্রধান খাবার ছোট মাছ ও জলজ কীটপতঙ্গ। প্রজনন মৌসুম জুন থেকে সেপ্টেম্বর। জলাশয় সংলগ্ন ঝোপজঙ্গল, কচুরিপানা কিংবা ধানগাছের আড়ালে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫ দিন।

২. *বাংলা নাম:‘নলঘোঙ্গা’*
এরা লাল বক নামেও পরিচিত।
*ইংরেজি নাম:Cinnamon bittern or Chestnut bittern*
*বৈজ্ঞানিক নাম:  Ixobrychus cinnamomeus*

 বক প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আকারে খানিকটা ছোট এ পাখি।
নলঘোঙ্গা লম্বায় ৩৮-৪০ সেন্টিমিটার। গায়ের রঙ বাদামি-লালচে। গলা ও পেট হালকা লাল। গলার মাঝ বরাবর গাঢ় ডোরাদাগ গিয়ে ঠেকেছে ঘাড় পর্যন্ত। বুকের সামনের ভাগ লালচে কালো মেশানো। তলা ফিকে এবং ডোরাকাটা। শক্ত, মজবুত ঠোঁটের গোড়াটা হলুদ, অগ্রভাগ কালো। পা ও আঙ্গুল হলদে সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম মনে হলেও সামান্য পার্থক্য রয়েছে। সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকু হচ্ছে, স্ত্রী পাখির পিঠের বর্ণ পুরুষের তুলনায় হালকা ফিকে।

নলঘোঙ্গা পাখির প্রধান খাদ্য মাছ, ছোট ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড়। প্রজনন সময় বর্ষা থেকে শরৎকাল। নলবন কিংবা জলাশয়ের কাছে ঘাসবনে অথবা কচুরিপানার ঘনপাতার আড়ালে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে ব্যবহার করে যৎসামান্য লতাপাতা। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২১-২৩ দিন।

৩. *বাংলা নাম: ‘কালিবক’*
এরা ‘কালা বগলা’ নামেও পরিচিত।
 *ইংরেজি নাম:Black bittern* *বৈজ্ঞানিক নাম: Ixobrychus flavicollis*

কালিবক লম্বায় ৪৮ সেন্টিমিটার। মাথার তালু চকচকে স্লেট বর্ণের। ঘাড়, গলা হয়ে পিঠে কালো রঙ ছড়িয়ে গেছে। গলার নিচ দিয়ে কমলা-নীল চওড়া রেখা ঘাড়ের পাশ হয়ে বুকে এসে মিশেছে। বুকে খাড়া কালচে টান। ঠোঁট লালচে ধূসর। পা ও পায়ের পাতা গাঢ় বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম।

প্রধান খাবার ছোট মাছ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, ফড়িং ইত্যাদি। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল। জলাশয়ের কাছাকাছি গাছের ডালে ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ২০-২১ দিন।

স্থানীয় পাখি হলেও এই পাখিদের দেখা আজকাল খুব কমই মেলে আমাদের দেশে। খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকলেও প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ সংকটের কারণে বংশ বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। এদের প্রধান শত্রু মানুষ। সামান্য মাংসের লোভে ফাঁদ পেতে শিকারিরা শিকার করে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়াও ভোঁদড় বা বেজি এদেরকে যথেষ্ট বিরক্ত করে। সুযোগ পেলে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। শিকারে বের হয় নিয়ম মেনে, ভোর এবং গোধূলিলগ্নে। এই কারণে এদের জ্যোৎস্না বক ও বলা হয়।

                       ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *