মিথ মন্দিরঃ৩- রহস্য ও ইতিহাসে মোড়া গন্ধেশ্বরী মন্দির

 

দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

গন্ধেশ্বরী মন্দিরের অজানা ইতিহাস 

ছবি ও কলমেঃ দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

মা গন্ধেশ্বরীর ঘাট

সুর টা খুব মিষ্টি সেদিন যে গানটি শুনলাম –
“হুগলি জেলার গঙ্গার তীরে
গন্ধেশ্বরী ধাম ,
দুর্গারূপে বিরাজ করে
সেথায় ভগবান ।”

মা গন্ধেশ্বরীর মূর্তি

কাছাকাছি রয়েছে প্রবাদপ্রতিম হংসেশ্বরী মন্দির যা অনেকেরই জানা আর চেনা। কিন্তু গন্ধেশ্বরী মন্দির? গেছেন কখনও? বাঁশবেরিয়ার ইতিহাস বেশ গভীর। গঙ্গার মূল নদীর মাঝেই এক বিশাল চড়া, ওপাশে মুল নদী বয়ে চলেছে, এপারে তার সত্তার কিছুটা অংশ। গায়েই অবস্থিত বিখ্যাত গন্ধেশ্বরী শ্মশান। তার সাথে, তার গায়েই দুটি ছোট ছোট মন্দির – গন্ধেশ্বরী ও শিব- তারা মন্দির।গন্ধেশ্বরীদেবীর বিষয়ে কথা হচ্ছিল পুরোহিত শ্রী শৈলেন ভট্টাচার্যের সাথে। উনি যথাসম্ভব সাহায্য করলেন তথ্য সংগ্রহের ব্যপারে । কলকাতার নামকরা ব্যবসায়ী শ্রী বটকৃষ্ণ পাল নৌকাযোগে গঙ্গাবুকে যেতে যেতে, হঠাৎ প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হন। বিপদ বুঝে নোঙ্গর ফেলেন এই ঘাটে। এই স্থানে বসতেই একটু একটু করে কেটে যায় ঝড়ের প্রকোপ। বড় স্নিগ্ধ আর মনোরম লাগে তার এই পরিবেশ। মনে মনে স্থির করেন এই স্থানে তৈরি করবেন এক মন্দির – তার আরাধ্যা দেবী দূর্গার গন্ধেশ্বরী রূপ। জাতে গন্ধবণিক ছিলেন তিনি অতএব গন্ধেশ্বরী দেবীর পূজারী। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা প্রচলিত বিশ্বাস আছে যা পুরাণকাহিনীর প্ররোহ হয়ে থেকে গেছে । দেবী দুর্গা চামুণ্ডারূপ ধারণ করে অসুর নিধন করতে করতে রক্তস্নাত হয়ে গেলে, তার শরীর থেকে রক্তের তীব্র গন্ধ নির্গত হতে থাকে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে পূজাকালে, দূর্গার মহাস্নানকালে, বৈশ্যদের গন্ধবণিক সম্প্রদায় দেবীকে প্রচুর মৃগনাভি, চুয়া, চন্দন, অগুরূ, ধূপ, কর্পূর প্রভৃতি দিয়ে স্নান করান দেবীকে। রক্তের কটুগন্ধ মুছে দেবী দুর্গা সুগন্ধিতা, স্নিগ্ধ হয়ে ওঠেন। এই রূপ তাই গন্ধেশ্বরী রূপ নামে পরিচিত । যেমন নাম ও কাহিনীটি, তেমনি অপূর্ব বিগ্রহটি। শ্বেতপাথরের রঙটিও যেন বড় সরস, বড় সজল।

মা গন্ধেশ্বরীর পাথরের মূর্তি

বুদ্ধপূর্ণিমায় আড়ম্বর করে পূজা হয় এই দেবীর। এছাড়াও নিত্য পুজো পান রূপবতী গন্ধেশ্বরী মা।

দেবী ব্রহ্মময়ীর মূর্তি ও উপাসনা কক্ষ

গন্ধেশ্বরী মন্দির যেদিন স্থাপিত হয়, সেদিন বটকৃষ্ণ পাল মহাশয়, একটি অপূর্ব সিংহাসন স্থাপন করেন অনতিদুরে; যেখানে ব্রহ্মময়ী কালীরূপে পূজা চলে আসছে একই সময় থেকে। মন্দিরের পাশেই একটি নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে মা কালীর ভক্ত কিছু সাধকের সমাধি।স্থানটি গন্ধেশ্বরী ঘাট (শ্মশান) নামেই বেশী পরিচিত। ঘাটের গেটের একপাশে এই মন্দির। অন্যপাশে শিব-তাঁরা মন্দির। এখন তো মা তাঁরার বিগ্রহ দেখা যায় মন্দিরটিতে; কিন্তু কিংবদন্তি রয়েছে, পাশের প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে, মাটির তলদেশ থেকে উঠেছিল একটি বিগ্রহপ্রতীম পাথর। সেখানে লোকনাথের একটি বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় ।এই মন্দিরটির পাশেই রয়েছে সাধকের পঞ্চমুন্ডির আসন। বলা বাহুল্য, সাধনার স্থান হিসেবে জায়গাটি নির্দিষ্ট করা আছে ।স্থানটি অতিপ্রাচীন নয়, তেরশ কুড়ি সালে তৈরি। সুতরাং, এক-দেড়শ বছর বই নয় । কিন্তু এই ঘরোয়া, বৈভবহীন স্থানটিতে লুকিয়ে আছে বেশ কয়েকটি মিথ। কাছেই আছে কমলে-কামিনী দেবীর মন্দির। কথিত আছে, কাছেই কালীদহ নামক জলাশয় থেকে পাওয়া কালীমূর্তিটি কমলে-কামিনী রূপে পূজা পান।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *