“জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান
কা র্তি ক চ ন্দ্র গ ঙ্গো পা ধ্যা য়
এক
বেশ কিছু দশক আগের কথা। বর্ধমান পৌরসভার আগের বারো নম্বর ওয়ার্ডে বহু বছর কাজ করে মারা যান বাদামী ঝাড়ুওয়ালী। তাকে নিয়ে লেখা হয়–
“আশি বছরের বয়সেতে তারে
দেখেছি নিত্য ভোরে
ঝাঁট দিয়ে ফেরে এ-গলি সে-গলি
প্রতিটি রাস্তা মোড়ে
দাঁড়াতে পারে না সোজা হয়ে হায়
কোমড় ভেঙেছে তার
শীর্ণ শরীর বহিতে পারে না
যেন আর দেহ ভার।”
ভোলানাথ মোহান্ত এরপর বলছেন,
‘‘যুগ যুগান্ত মানুষের ইতিহাসে কত যে বাদামী আজও যায় আর আসে।
তাদের সেবার দাম
পায়নি স্বীকৃতি পায়নি আজিও
রবে চির ব্যবধান।”
বিষয়টা হলো সে সময়ে কবি এই বাদামী ঝাড়ুওয়ালী, হাসপাতালের মেট সর্দার বুধুয়া, বা পৌরসভার ধাঙর রামরূপ সর্দারকে নিয়ে নানা কবিতা লিখেছেন। সে সময়ে বর্ধমানের মূলতঃ আলোচিত ও প্রকাশিত সাহিত্যচর্চা হয় রাজস্তুতিনির্ভর অথবা উদ্ভিন্ন স্বাতন্ত্রের ললিত অথবা স্পর্ধিত উচ্চারণ। বলার ধরণে কোনো অচলতির কোনো বিন্যাস নেই, শব্দনির্বাচনেও তেমন কোনো অভিনবত্ব নেই।কিন্তু এত দরদ দিয়ে এই উপেক্ষিত নীচের তলার গতরঢালা মানুষগুলোর অবদান বঞ্চনা ও বেদনাকে যেভাবে কবি ভোলানাথ মোহন্ত তুলে এনেছেন তার তুলনা মেলা ভার।
কিন্তু সেই অনুচ্চারিত বঞ্চনা ও জ্বালার উত্তরাধিকার যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিষ্ফোরণউদ্যত এক প্রলয় চাড় হয়ে উঠছে, কবিতার উত্তরাধিকারত্ব কিন্তু তার হদিশ দিতে ভোলে না।
‘‘উজ্জ্বল ভাতের দিকে কীভাবে যে চেয়ে থাকে – যেন
ক্ষুধা নয়, ক্লেশ নয়, নয় কোনো লোভের নিশপিশ শুধু এক বোঝাপড়া আক্রমণ।অশুভ এক ছায়ায়
ভরে যায় বুক, গলা, গৃহস্থালি, সন্তানের মুখ।
ঠান্ডা সরু হাতে ওরা টেনে নেয় সব টুকিটাকি –
কাগজ , কলম, বই; ঠাকুরের বেলপাতা ধূপ – আমাদের সব পরিত্রাণ
ক্ষুধার্ত মানুষ খায়, খেয়ে সব ফাঁকা করে দেয়’’
সুব্রত চক্রবর্তীর উচ্চারণগুলি এই হৃদয় দুর্ভিক্ষ সমাজ সংসারের অমোঘ ভবিষ্যৎকে কী স্পষ্ট অথচ অসাধারণ বাকব্যঞ্জনায় তুলে ধরে।নিখিলেশ মহান্ত লেখেন,
“—বিকট পোড়া গন্ধ
হাওয়ার ছুরিতে, শিশিরস্নান স্নিগ্ধ সকালের আলো
আগুন ও ধোঁয়ায় মধ্যরাতের অন্ধকার”।
অজিত ভট্টাচার্য লেখেন,
‘আমার স্বর্ণদ্বারকা
আরবসাগরের তলায় তলিয়ে গেছে
দুঃখ নাই তাতে
আমি আছি কবিতার কাছে
সাগরের নীল জল কান্না হয়ে আমার চোখের পাতায়…’
আব্দুল গণিখান লেখেন,
“অন্যায় তো করছি নাকো ধর্মমতে –
বানিয়ে সতী করছি পুজো দেখার মতো
গাঁয়ের বধূ রূপ কানোয়ার জানতো কি কেউ
পুজো পাবে দুলবে চামর সোহাগ ভরে?”
কবি তপন চক্রবর্তী লেখেন-
“আমাদের চাল নেই তলোয়ার নেই
ভোর কবে হবে তাও এখনও জানি না
তবু কাকজ্যোৎস্নার সামান্য আলোতে খুঁজে ফিরি রাজবাড়ি জরির পোশাক
বিড়ির আগুনটা একটু দেবেন ,কমরেড
আমাদের বিচ্যুতি পোড়াব।”
গৌরী চট্টোপাধ্যায় লেখেন,
“কেউ কাঁদে অন্ধকারে
কেউ কাঁদে আলোয় দাঁড়িয়ে
কতটুকু তফাৎ দুজনের চোখের জলের?”
কবি সনৎ মন্ডল লেখেন,
‘’কারা যেন খুব গভীরে শেকড়ে মেলেছে বোঝা যায়।
হাওয়ায় নড়ছে ওই ঘাসফুল
অফুরন্ত হাওয়ায় শিহরণ…।”
বলাইচাঁদ দাস লেখেন,
‘’মাটিখুঁড়ে আদিম সিন্ধুসভ্যতা
তাক লাগাবে ফিরিয়ে আনতে
আগের বিশ্বাসের ভিতটা।”
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন,
‘‘মেয়েটির দু-চোখে আছাড় খাচ্চিল
খাঁড়িতে আটকে থাকা ভোর।
জঠরে কেঁপে উঠছিল ভ্রুণের শূন্যতা।
তার বালির আকাশে তিরতির করে
কেঁপে উঠছিল রাতের অভ্র।”
শান্তনু বসু লেখেন,
‘’ব্যস্ততা গাছেরও আছে, উত্তেজনা শিকড়ের বেড়েই উঠছে
ফিরে আসা ফিরে যাওয়া সব কিছু বাতাসের মতো বয়ে যাচ্ছে
যে বাতাসে বালকের পদশব্দ নেই, কিশোরীর স্তনের বেড়ে ওঠা নেই,
শব্দহীনতায় তারা হাসে, কথা কয়, কাঁদে মাথুর সংলাপে।‘’
লেখা শুরু থেকে যেসব কবিরা ঘোরাফেরা করলেন তারা কেউ বয়েসকালে, কেউ মধ্যবয়সে, কেউ বা টাটকাই এই বিয়োগের, বিবাদের ও বিস্বাদের প্রত্যহে সংযমস্পৃহা ও যন্ত্রনাভোগের অমোঘতার নানা চিহ্ণ রেখেই মাটি থেকে মহাকাশ হয়ে গেছেন। এদের ও আরও অনেক অজানা কবির আমৃত্য কাব্যচর্চার রকমারি সঞ্চয় এ শহরের কাব্যচর্চায় যেমন মাটির কোলতল তেমনি নক্ষত্রের দাহ দিয়ে চলছে। ক্ষমতার রকমফের থাকা সত্ত্বেও কবিতার প্রতি এদের দায়বোধ বর্ধমান শহরের সংস্কৃতি চর্চার বিশ্বস্ত পাথেয়।
বর্ধমানের বর্তমান কাব্যচর্চা মূলতঃ তিনটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে, যদিও সেই মূল ধারাগুলির নানা উপধারা আছে।আবার যান্ত্রিকভাবে না দেখলে দেখা যাবে এসব ধারা উপধারার মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন সচল থাকার ফলে কোথাও কোথাও নানা মিশেল ধারা উপধারার চলন তৈরি হচ্ছে।কোথাও তা সফল হচ্ছে, কোথাও তা হতে পারছে না।মোটামুটি প্রথম ধারাটি প্রবাহচলেরই চলিত সম্প্রসারণ।এই ধারায় বিষয়বস্তুর স্পষ্ট প্রাধান্য কবিতাকে বহুজনবোধ্য করে তুলেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ধারায় বিন্যাসের কারিকুরি ও ব্যঞ্জনার অভিনবত্ব তুলনামূলকভাবে কম।এ ধারায় আত্ম উন্মোচন বিষয় অনুগত। দ্বিতীয় ধারায় আত্ম অবরুদ্ধ অভীপ্সার উদ্ভাস কবিতাকে কখনও বিষাদময়, কখনও প্রাণচাঞ্চল্যের তীব্র উত্তেজনাস্পৃষ্ট, আবার কখনওবা বিযুক্তিপ্রবণ করে তুলেছে।এ ধারার লেখায় গড়ার অনেক নতুন নতুন নক্সা পাওয়া যায়।পাওয়া যায় শব্দের অনেক গাঢ় দ্যোতনা।প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতাও অনেক সময় এ ধারার বৈশিষ্ট্য।কোথাও যেন প্রকৃতি মাধ্যমেই প্রতিফলিত হচ্ছে বেদনা বা আনন্দের নন্দনভাষ্য।তৃতীয় ধারায় এই নিষাদ সভ্যতার ব্যভিচারী উপসর্গগুলি যা শুধু মানুষ কেন, গোটা জৈবমন্ডলের শরীর ও সত্তাকে দূষিত ও বিধ্বস্ত করে চলেছে – তার বিরুদ্ধে সমবেতর লড়াইকে উপস্থাপিত করে তুলেছে। কিন্তু এসব তো মোটা দাগের কথা। কবি তো প্রতিধ্বনিত নয়, আত্মধ্বনিত, প্রতিকর্মা নয়, আত্মকর্মা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকেই কাঠামোগত চেহারা দিতে প্রয়াসী হয়।এই প্রচেষ্টার ভেতর থেকেই প্রতিটি কবি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পাঠকের ভেতর সঞ্চালিত হতে চায়।
কোথাও কবির অনুভবের মাধুর্যে পাঠক আপ্লুত হন।কোথাও কোনো কবির শ্লেষে স্পৃষ্ট হন পাঠক।আবার কোনো লেখকের মেজাজের দরাজে প্রভাবিত হন পাঠক।কোনো কবির পদসংগঠনে পরস্পর বিপরীত ভাবভাবনার বহিরঙ্গে অর্থ সংঘর্ষে যে মহিমা উঠে আসছে তা পরস্পর বিপরীতের মিশেলের সদর্থক নির্য্যাস বলে পাঠক মনে করতে পারেন। আবার কোথাও সারিবদ্ধ ছন্দিত পদগুলি আসলে এক প্রবল বেগসৃষ্টির অনুঘটক।সে বেগ যেন আলো আঁধারের এক জটিল রাসায়নিক খেলা, যা সংশয়ে আর সংশয়হীনতায় , বেদনা আর বেদনাজয়ের এক দ্যুতিঘূর্ণি উচ্চারণ।কোনো কোনো কবিতায় অনুভব যেন মেদুর , কটু , জ্বালাময়, আবার ছায়াশীতল ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ।আবার এমন লেখাও আছে, কথা যেখানে কাটা কাটা, শুকনো।চলিত জীবনচর্চা, তার বিধিব্যাকরণ যেন এক অভ্রংলেহী তাচ্ছিল্যে আক্রান্ত।অথচ এই ঊষরকথনের পরতে পরতে রয়েছে অচয়িত, অনাদৃত ও অপব্যবহৃত শ্রমচলের প্রতি প্রাণবন্ত দরদ।কিন্তু সে দরদ যেন ঝকঝকে খরতায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে।অন্ধ নয়, চক্ষুষ্মাণ আক্রমণ; নির্বিচার নয়, বিচারসাপেক্ষ গ্রহণ বর্জন; নিছক ভাঙা নয়, ভাঙাগড়ার সুষম যুগলবন্দীতে উচ্চারিত হতে চায় কবিতা।বর্ধমানের লেখালেখি তার ব্যতিক্রম নয়।এখানকার নানা সমর্থ কবির লেখার উদাহরণ টেনে তা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু সামগ্রিক সাহিত্যচর্চা নিয়ে লিখতে গিয়ে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সে প্রয়াস থেকে বিরত থাকতে হলো।
★শিরোনামের কবিতা পংক্তিটির কবি শান্তনু বসু★