বাঁদনা ও তার অহিরাগীত

মৃণালকান্তি মাহাত এই সময়ের একজন বলিষ্ঠ কলমের অধিকারী।কবিতাতে যেমন তাঁর বলার ভঙ্গি পৃথক তেমনই গল্পের বুনোটেও এককত্বের পূর্ণ দায় বহন করতেও সক্ষম।আজ নয় প্রায় এক দশক ধরে মৃণাল লেখনিকে করে তুলেছেন তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর,আর নিভৃতে জমিয়েছে নিজের তুণীরে সাধনাকৃত এক একটি অসাধারণ শর।মৃনাল এখন শর্টফিল্ম ও তথ্যচিত্র নিয়ে ব্যস্ত।বানিয়েছেন রাঢ় বাংলার সংস্কৃতি ও অনটন নিয়ে বেশকিছু ভিন্নস্বাদের তথ্যচিত্র।পেয়েছেন বহু পুরস্কার।মৃণালও বাইফোকালিজম্ পরিবারের অন্যতম একজন।

 

বাঁদনা ও তার অহিরাগীত

মৃ ণা ল কা ন্তি   মা হা ত 

ছবিঃ রাকেশ সিংহদেব 

একটা সময় ছিল বাঁদনা পরব কে বলা হত গরুবাগাল বা রাখালদের উৎসব। আজ থেকে কুড়ি বা পঁচিশবছর আগেও বাগালদেরই ছিল সবচেয়ে বেশি রমরমা। এখনকার মত বাঁদনা এতটা সার্বজনীন ছিলনা।সার্বজনীন বলছি এই অর্থে তখন সমাজের শিক্ষিত, তরুণ, ধনী এবং আদিবাসী সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষের অংশগ্রহণ ততটা ছিলনা। বলা ভালো, বাঁদনা -সহরাই পরব কে শাসন করতেন কুড়মী সহ সমগ্র আদিবাসী সমাজের বাগালরাই।গরুজাগানো থেকে শুরু করে কাড়াখুটান পর্যন্ত বাগালরাই পরব টা নিয়ন্ত্রণ করতেন।ঘট ডেঙ্গা আয়োজন, গরুজাগানো,অহীরা গীত গাওয়া,খুটানের জন্য চামড়া সংগ্রহ এবং সর্বোপরি খুটানের সময় গরু কাড়া খেলানো সবজায়গাতে বাগালরাই হতেন আগদহলি। বলা ভালো, বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশুদের কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি, বাগালদেরও সম্মান জানানো হত বিভিন্ন উপাচারের মাধ্যমে।
তো যে কথা বলছিলাম, এই লেখার উদ্দেশ্য বাগাল সম্প্রদায় নয় বরং বাগালদের লালনকরা এক অসাধারণ সংগীত ঘরানা। অহীরা। ছোট থেকেই আমার এই গীতের প্রতি একটা বীতরাগ ছিল। খুব একটা ভালো লাগতো না। অবশ্যই এই গানের কথাগুলো বুঝতে না পারা, এই অপছন্দের অন্যতম কারণ ছিল। সেসময় এই গানগুলোর ব্যপকতা বোঝার মত শিক্ষিত ছিলাম না হয়তো। তাই এই সংগীত ঘরানার প্রতি আমার একটা মানসিক দূরত্ব দীর্ঘদিন ধরেই ছিল।পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করি, তখন 4th সেমেস্টারে প্রজেক্ট করতে হত একটা আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যের উপর।আমি কুড়মালি সাহিত্যের উপর করেছিলাম। তখন থেকেই গ্রামের বয়স্ক মানুষ গুলোর কাছে এই গীতগুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর করা শুরু হয়। পরবর্তী কালে ‘বাঁদনা’ তথ্যচিত্র করতে গিয়ে আরও একটু গভীরভাবে পড়াশোনা করা। বলা ভালো, ঠেলায় পড়ে বিড়ালের গাছে উঠা। এরপর থেকেই এক গভীর অনুরাগে জড়িয়ে পড়া।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় কুড়মালি তে যতগুলি সংগীত ঘরানা রয়েছে, সবচেয়ে গভীর অর্থযুক্ত গান হল অহীরা। অহীরার মত এত দর্শন ভাবনা জঙ্গলমহলের আর অন্য কোন সংগীত ঘরানা তে পাওয়া যায় না। দেখুন জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে কি অসাধারণ গান-

ছামড়া নিয়ে নাচ

–ভালা অহিরে মানুষ জনম ভালা ঝিঁগা ফুলের কলি যে বাবু হো,
সাঁঝে ফুটে সকালে হয় মলিন।
আর ভবেরি লীলা ভালা হাসি খেলি লিহ গো,
মরিলে তো দুনিয়া আঁধার।
জীবন কে উপভোগ করে যাও।ঝিঙ্গা ফুলের মতই জীবন ক্ষণস্থায়ী। যতদিন বাঁচবে জীবনকে উপভোগ করে যাও।এই গীতটার আমি প্রেমে পড়ে গেছি। কত সাধক সারাজীবনের সাধনার পরেও এমন লাইন লিখতে পারেন নি। সেখানে কোন এক জঙ্গলমহলের অখ্যাত কবি এমন মারাত্মক গীত রচনা করতে পারেন।

-অহিরে কাপাস ফুলে অহিরা উঢ়ন পিঢ়হন বাবুহ
ধানঅ ফুলে করত ভক্খন
তিল ফুলে খোঁপা চিকন অ
সিন্দুর ফুলে রাখল সংসার
কি অসাধারণ কবিত্ব! সিঁদুর কে ফুলের সঙ্গে তুলনা করে মানবিক,সাংসারিক বন্ধনে ভারতীয় সমাজে সিঁদুরের গুরুত্বের কথা উঠে এসেছে। Simile ও Metaphor এর কি অসাধারণ প্রয়োগ।

“অহিরে
কিসের লাগি ভালা আঁচিরঅ পাঁচির অ রে বাবু হো কিসের লাগি ধনঅ বিষয়?
আর কিসের অ লাগি ভালা সনার অঙ্গ দেহি রে, কিসের লাগি ভবের অ বাজার????? “

“অহিরে,
দেখন সভার লাগি আঁচির অ পাঁচির অ রে বাবু হো মানেক লাগি ধন অ বিষয়।
আর কামেক অ লাগি ভালা সনার অঙ্গ দেহি রে ফুরতির লাগি ভবের অ বাজার।। “
কত আধ্যাত্মবোধ থাকলে এই ধরনের গীত রচনা সম্ভব। কিসের জন্য আমরা সুন্দর ঘরবাড়ি নির্মান করি, কিসের জন্য এত ধনসম্পদ? কি-ই বা কাজে লাগে সোনার অঙ্গ। জঙ্গলমহলের কবিরা কি অসাধারণ ব্যখ্যা দিয়েছেন।

খুটান ও অহিরাগীত

দুঃখের বিষয় এই অহীরা গীতগুলি বেশিরভাগই প্রচলিত।গীতিকার দের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। যেহেতু প্রাচীন কাল থেকে এই গীতের ধারক বাহক কুড়মী সমাজের বাগাল ও ক্ষুদ্র চাষি সম্প্রদায়। তাই আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় বেশিরভাগ অহীরা গীতগুলির গীতিকার ছিলেন ছোটনাগপুর এর বাগাল বা রাখালরা। পেশাগত কারনে যতই তাদের হীনচোখে দেখা হোক, তাদের কিন্তু আশ্বর্য এক সাংস্কৃতিক বোধ রয়েছে। কথাই কথাই গান বাঁধতে জুড়ি মেলা ভার। জঙ্গলমহলের পাহাড়, ডুংরি, জঙ্গল, নদী তাদের মনে গড়ে তুলেছে আশ্বর্য এক সংগীত চেতনা।তারা ভালো আড়বাঁশি বাজাতে পারেন।ঢোল,ধামসা,মাদল তাদের হাতে কথা বলে। এমনকি এখনো প্রতিটি গ্রামেই এই ধরনের দুএকজন রসিক মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও গলায় মাদল ঝোলালেই দু এক কলি গান বেরিয়ে আসে। এরা মাটির অনেক কাছাকাছি থাকে বলেই, এদের সাধারণ জীবন যাপন, এদের দারিদ্র্য নিয়ে ঘর করতে হয় বলেই মেঠো কথাই এরা সহজ করে জীবনের দর্শন গুলি সহজেই ফুটিয়ে তুকলে পারেন গানের মাধ্যমে।

মজায় মজা

অহিরা গীতে এত কবিত্ব, এত দার্শনিক চেতনা থাকলেও সেভাবে এই গীতগুলি জনপ্রিয়তা পায় নি। প্রধান কারন, বাঁদিনাউৎসব এর সময় ছাড়া অন্যসময় এই গীত গাওয়ার নিয়ম নেই। দ্বিতীয়ত, সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি এতদিন।মঞ্চে সেভাবে গাওয়া হত না।তাই, টুসু, বা করম গীত যে ভালোবাসা পায়, অহীরা গীত ততটা পায়নি।’সিজিওনাল’ গীত হিসাবেই রয়ে গেছে।

গরু খুঁটান-এর মজা

আমার মনে হয়, সময়ের প্রয়োজনে এই নিয়ম সংশোধন এর প্রয়োজন রয়েছে। চাই প্রচার প্রসার।তাহলেই অহীরা গীত অদূর ভবিষ্যতে ঝুমুর,টুসু,করম গীত এর মত ছোটনাগপুর এর এক আলাদা সংগীত ঘরানা হিসেবে উঠে আসবে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *