ললিতমেদুর কুহেলি
ম নো তো ষ আ চা র্য
সেদিন চৈত্রমাস
একটি নতুন শব্দ-বন্ধ ঘিরে ফেললো আমাকে। শুধু আমাকে কেন বলবো আস্ত একটা মানুষের দেশকে। ভাবিনি তার এত পরিণাম। বসন্তের বাতাসও কেমন অপরিচিত মনে হতে লাগলো । ভাবলাম একদিন তো। ছুটির মেজাজে রবিবারটা কেটে গেল। সোমবার স্কুলে গেলাম। না কেউ পড়তে চাইলো, না আমরা পড়াতে। কি হয় কি হয়। সপ্তাহখানেকের হোমওয়ার্ক দিয়ে নোটিশ পড়লো ১ এপ্রিল স্কুল খুলবে। ধুলোমাখা ঝরাপাতা মাড়িয়ে ফিরে এলাম কবিতার বাসাবৃত্তে। যেন গ্রীষ্মের ছুটি এগিয়ে এলো। বাজারে দোকান পাটে যুদ্ধ বেজে গেল। অপ্রত্যাশিত ছুটিভোগের আনন্দে ও ব্রেকিং নিউজ এ-র আতঙ্কে কেটে যাচ্ছে দিন। বর্ষশেষের সূর্যডোবা মায়াবী আলো প্রথম দেখলাম মনে হয়। এমনই কত কিছুইতো নতুন সংজ্ঞা নিয়ে জীবনে আসে। আবার কতকিছুই তো জীবন থেকে চলে যায়। সাত-পাঁচ বেহিসেবী ভাবনার ভেতরেই লিখে ফেলি কত কত শব্দ। এভাবে শব্দের অপচয় নাকি অপব্যবহার কে জানে। সাম্প্রত বাসাবদলের হ্যাঁচকায় খুঁজে পেলাম পুরোনো চিঠির ঝাঁপি। কাল-হস্তে মর্দিতা অঙ্গভূষণের সে কি অপার্থিব আক্ষরিক টান। সেই সোঁদা গন্ধময় ভাষার কথকতা আর হারানো বেলার উপপাদ্যের ভেতর নিজেকে নৈবেদ্য দিলাম। পুরোনো লেখা ও পুরোনো ম্যাগাজিনের আত্মরতিতে, বাউণ্ডুলেপনায় ‘কালসিন্ধু জলতলে’ হারিয়ে গেলাম। অতলান্ত স্রোতের ঘূর্ণিজলে ভেসে উঠলো কয়েকটি পোস্টকার্ড। সেইসব শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আবেগের হিমশৈলগুলি ভেঙে দিল ব্যথার সুষুপ্তি। কাল বদলালেও আমি যে একটুও বদলে যাইনি। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম অবয়ব নয় অস্তিত্বের দহন ও ক্ষত।
জিহ্বা মে মধুমত্তমা
মধ্যরাত পার করেও পড়ে ফেলছিলাম কিছু পুরোনো সিনেমার ভাষা। কুরোসাওয়া থেকে সত্যজিতের নন্দনবিশ্ব ভাবনায় ঢেউ তুলতে শুরু করলো। বর্তমান দশকের সেলুলয়েডিয় মনোবিকলন ও বাদ যায় নি। বোধহয় একঘেয়ে বস্তুটা পাশ ঘেঁষেনি। আতঙ্ককে বৈঠক খানায় ঢুকতে দিইনি। ধ্রুপদী যন্ত্র সংগীতের মূর্ছনায় তেতে উঠছিল চরাচর। রূপময় অন্তঃকরণের কোশে কোশে কেঁপে উঠছিল ললিতলবঙ্গলতা। চরিত্র থেকে চরিত্রান্তরে পল্লবিত ‘আমি’ স্থান- কাল- আধারের ভিন্নতামাত্র। গুহাবন্দী যাপন জারণ চেতনার উপরিতলে অধিষ্ঠিত জুকেরবার্গিয় সমাজ সক্রিয় হয়ে উঠলো। বিচিত্র বাকবৈভবে, শব্দবিভ্রমে, সংখ্যাতত্ত্বের ভুবনায়িত তথ্যে- তর্কে,সঙ্গ-প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে মেতে উঠছিল দেবাঙ্গন। পরিযায়ী দধীচিদের লংমার্চ দেখে ভেতরে ভেতরে কেঁদে উঠছিলাম। যুক্তি পালটা যুক্তির শব্দবাণে ধীরেধীরে আঁধার নামতে লাগলো মুখ-পুস্তকের পাতায়। বারোয়ারি জীবনকথায় তেতে ওঠা কানে বেজে চলেছিল অন্তহীন ছায়া-জীবাশ্ম-ধ্বনি। সেই ধ্বনি পৌঁছে যায় অকূল দূরের চেতনায়। ধাক্কায় ধাক্কায় জেগে ওঠে অপরিচিত স্বাক্ষরলিপি। জিভে মধু দাও মা। স্পর্শ করি সেই ঐশ্বর্যের অন্তরাল। জানি কালচেতনা আপেক্ষিক। মানুষ কি পেয়েছিল আত্মখনন করার এত সুযোগ। আত্মরতির এত প্রশস্ত করিডোর। আত্মপ্রচারের এত সময়। ‘কালস্য কুটিলা গতি’ বুঝে উঠবার এত অখণ্ড অবসর। জানিনা সময়ের জোয়ারে জেগে ওঠা নতুন চরের ঠিকানা মানুষ হয়তো খুঁজে পাবে, হয়তো বা পাবে না। শব্দ খুঁটে খুঁটে এগিয়ে চলেছি উত্তর-মানবতাবাদের উর্বর জমি পাবার আশায় । মায়াময় দেহ থেকে দেহান্তরে খুঁজে চলি পৃথিবীর অতীত ও অনাগত আগামী। আয়ুস্রোতে ভেসে যাই অজানা নদীর মোহনায়।
জীর্ণপাতা ঝরার বেলায়
পরিচিত পৃথিবীর ডাক শোনা যায় না। ঘামমোছা দুপুরের চেনা রুটিনের গন্ধ কবে ফুরিয়েছে। শিলাবৃষ্টির বিকেলে আমকুড়োনোর হুল্লোড়ে , কোকিলের গোধূলি কূজনে, নিশাচর বিহঙ্গের পাখসাটে মুছে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের পাতা। ব্যবহারিক কর্মধারায় বিজ্ঞানের মিশেলে তৈরি হচ্ছে আগামীর জলছবি। বস্তুই কি তবে সংবেদনের গোড়ার কথা। কথায় কথায় বেজে ওঠে শাঁখ, জ্বলে ওঠে শিখা। আর পাড়ায় পাড়ায় তালি ও গালিতে কানের পোকা মারার জোগাড়। হৃদয়ের সরোবরে যথোচিত উপচারসহ ছুঁড়ে দিই টোপ। ক্ষয় ও বিকাশের চিরায়ত দ্বন্দ্বে প্রহর জুড়ে ত্রিতালের ধ্বনিসাম্য। এরই মাঝে কবির ‘আমি’ থেকে কবিতার ‘আমি’কে খোঁজার তোড়জোড়। ব্যঞ্জনার পদ্মকোরক পেতে চেয়ে অতিমারীর ভুবনায়নে মৃত্যু-রস আস্বাদন। শাসক তর্জনীর নির্দেশে মৃত্যুও আজ প্রদর্শন-শিল্প। মস্তিষ্কের ভেতর শুভ চেতনা সংক্রামিত হয়। খোঁজ নিই পুরোনো বন্ধুদের। মাটি বড় আপন মনে হয়। গাছ লতা, তৃণমঞ্জরী, অবলা প্রাণীকুল বড় আপনার জন বলে মনে হয়। বনভূমি, সৈকতভূমিতে বেড়ে ওঠা উঞ্ছজীবী মানুষের দিনযাপন দেখতে পাই। তাদের জন্য স্নিগ্ধ নিরাময় কামনা করি। পরিচিত ভুবনের অস্তিত্ব প্রবাহে কুশলাদি বিনিময় ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেড়েই চলে। আবিষ্কার করি অনেককালের গ্রন্থিবন্ধন। গোধূলির আজানে শুনতে পাই ঔপনিষদিক ধ্বনি- ব্রহ্ম। সময়ের সুদীর্ঘ শিরদাঁড়ায় বেজে ওঠে সাম্যবাদের অস্থি-নিক্কন। এই কি তবে ঋতপথ। নিরঞ্জনের মহিমা ‘সমানো মন্ত্রঃ’।
সৃষ্টির অমোঘ শান্তি
বহুরৈখিক পঠন ও বহুমাত্রিক চিন্তনের ক্যানভাসে ফুটে উঠল প্রকাশের দুর্মর বাসনা। তাগাদা এলো ব্লগজিনগুলো থেকে। এমনিতে আমার কলম অতিপ্রজ নয়। কলম তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে চাইল। ক্ষুধা-তৃষ্ণার ব্যাঘাত ঘটল না। সাংসারিক যাপনগত দাবি মেটাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সময়ের প্যারা-ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করে ফেলি। ডায়েরি লেখার ফাঁকে লেখা এলো। প্রকাশিত হলো। খণ্ড খণ্ড সময়ের বিচিত্র অভ্যাসে জীবন খুঁজে পেল জীবনকে। স্মৃতির বোতাম খুলে তার প্রত্ন-শরীরের ঘ্রাণ পেলাম। শব্দে শব্দে মাথা কুটে মরার সে কী আকুলি। নিজেকে এতটা নিজের করে পাইনি কোনোদিন। পেশাগত অস্থিরতার চাপে পিষে গেছে জীবন-যৌবন-ধন-মান। এই ভাবে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে আত্মভুবনকে স্যানিটাইজ করার সুযোগ কে কবে পেয়েছে। অনেক পুরোনো নম্বরের ফোন এলো। কুশল বিনিময় করলো। খোঁজ খবর নিল। আলাপের ছোঁয়াচ কাটিয়ে নতুন প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চাইল। শোকভয়শূন্য চিত্তে সৃষ্টির বীজমন্ত্রের ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। আত্মঅচেতনার পথ দূরে ফেলে হাঁটতে চাইছি। আপন হাঁটু ওকোমরের শক্তিতে পেরোতে চাইছি চড়াই। জন্মকুণ্ডলী বিপদমুক্তির আশায় দুর্মর। দুর্দান্ত ভ্রষ্ট আত্মাগুলির দাপটে উদাসীন ভিক্ষুচর্যা আজ বিপন্ন। “কালো বৈ দূরতিক্রমঃ”। তবু এ মর জগতের আস্ফালন মুহূর্তের জ্বলন মাত্র। চোখে জল এসে পড়ে। কালের উদ্ধত সঙ্গীনের কাছে এ-র কোনো দাম নেই। নিজেকে খুঁজে চলার এ পিপাসা অন্তহীন। লাভ- ক্ষতির বহুবিভাজিত সময়ে শুধু শুদ্ধতার আঁচড় কাটতে চাই। আচ্ছা আঁচড় শব্দে সেই আদিমতার গন্ধ। আদিমতম প্রবৃত্তিকে ঢাকা দেওয়ার এ-ই যে শিল্প-সম্ভার আমি তার কতটুকু জানি। এই আত্মদীনতাকে সহজ স্বীকারের মাধ্যমে রেখে যেতে চাই। অন্তরাত্মা, ব্যক্তিক আমি, সামাজিক আমি, খণ্ড-খণ্ডাংশ অথবা অখণ্ড আমি’র সীমানা পেরোতে চাই। আনন্দের বাহুল্যবর্জিত বহুস্তর ঘনত্বের দিকেই আমার আদর। শুভ চেতনার দিকেই উজিয়ে যেতে চায় যে সৃজন প্রয়াস তাকেই তো আগলে রেখেছি এতকাল। মনে পড়ে যায় অনেক বাক-বিভূতি। আনন্দের এক উৎস থেকে আরেক উৎসে আমি যে বিহঙ্গবিহারি। তর্ক থেকে সরে যাই। সমূহ বোধের কাছে উজাড় করি আত্মদীপন।
অঙ্গে অঙ্গ বাঁধিছ রঙ্গপাশে
রাস্তাকে এত একা হয়ে যেতে দেখিনি। বাজার হাটের এত নিঃস্বতা আগে দেখিনি। সবজি বিক্রেতা গ্রাম্যবধূটির এত আকুতি কি কখনো দেখেছি। মরশুমি শাক সবজির এত অনাদর, এত নীরব ব্যথা তো দেখিনি। মনে পড়ে সেই অক্ষয় কাব্য-পঙক্তি –“শিশির বিমল প্রভাতের ফল শত হাতে সহি পরখের ছল / বিকালবেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা।” চাষি পাড়ার রোদপোড়া কিশোরটি কাঁপা কাঁপা হাতে মেপে দিচ্ছিল শশা তরমুজ লঙ্কা ঢেঁড়শ। রাজ্য সড়কের ধার ঘেঁষা জবরদখলি বস্তিতে থাকে তৈমুর। মাসির মেয়েকে বিয়ে করে চারটি বাচ্চা নিয়ে তার সংসার। পুরোনো লোহা-লক্কড়, কাচ, প্লাস্টিক দুয়ার দুয়ার ঘুরে কিনে বড় পাইকারের গোডাউনে বেচে। সে এখন পাড়ায় পাড়ায় মাছ – সবজি বেচছে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে রোল চাউমিন মোগলাই দোকানি সব কিছু ভুলে গিয়ে প্লাস্টিকের চাদর পাতিয়ে হাঁক মেরে বিক্রি করছে আলু পেঁয়াজের সাথে আদা রসুন। এমনই হাজারো পেশা বদলে গেল, না হয় বন্ধ হয়ে গেল। সামাজিক সঙ্গরোধের সংকটে প্রজাপুঞ্জকে অনাহার ও আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। আকাশে বিচিত্র পাখির ঝাঁক। রাত্রিতেও মাঝেমধ্যে শোনা যায় বিহঙ্গের কূজন। ঘুম আসে না। অজাগর চোখে নেমে আসে নক্ষত্র ও উল্কা। মনে মনে ভাবি দূরতর দ্বীপের পথে সাগর বুকে ভেসে চলেছি দোলায়মান বজরায়। দূরদর্শন এত ভয়ের বস্তু আমার কাছে অন্তত ছিল না। রাষ্ট্রীয় সমাচার থেকে নিজেকে আড়াল করছি কেন কে জানে। বরং ছোট ছোট মানবিক উদ্যোগ, মানবিক মুখের উজ্জ্বলতা দেখে শান্ত হচ্ছি। কতগুলো প্রস্তাবিত কবিতার আড্ডা বাতিল হল। আরো কতগুলো বাতিল করতে হবে কে জানে । সঙ্গসুখের আঘ্রাণে মন বড়োই উতলা। শব্দ-সঙ্গমের আনন্দে মন যে চাতকিনী। জানি বজ্রগর্ভ মেঘের আড়াল খুঁজে ফুটে বেরোয় চন্দ্রগর্ভ জ্যোৎস্না। পৃথিবীর আগামী সুস্থতা দেখতে চেয়ে বেদনাকে চাপা দিচ্ছি বইয়ের স্তুপে, গল্পের প্লটে, কবিতার শব্দ-বন্ধে, ছবির রেখায় ও ভাস্কর্যের সূক্ষ্ণ দর্শিতায়, যাপনের ছকভাঙা আত্মীয়তায়,গৃহদেবতার সেবায়। মৃত্যুমনস্ক সময় সব ক্ষত মুছে ফেলে অচিরেই আবিষ্কার করে ফেলবে বিজ্ঞানমনস্কতার অমৃতলোক। ললিতমেদুর কুহেলি ভেদ করে জ্বলে উঠবে মহাকালের পথবাতি।