চন্দ্রকোনার হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ইতিহাস নিয়ে মেদিনীপুরের ভুলে যাওয়া ইতিকথা
পর্ব-১৪
গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে
ঐতিহাসিক চোয়াড় বিদ্রোহ:
গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে প্রথম চোয়াড় বিদ্রোহ
শুরু হয় ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে থেকে।
কারণ তখন কর্ণগড়ের রাজা অজিত সিংহের সৈন্য
সংখ্যা ছিল ১৫০০০। তিনি এই বিদ্রোহ দমন করেন। আর ১১৬২ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দে
রাজা অজিত সিংহের নি:সন্তান অবস্থায় মৃত্যু হয়।
তারপর তার দুই রানী যথা বড় রাণী ভবানী ও ছোট রাণী শিরোমণি তদ্বীয় রাজ্য প্রাপ্ত হন। এই সুযোগে চোয়াড় অধিনায়ক গোবর্ধন দিকপতি
কর্ণগড় রাজভবন আক্রমণ করেন। রাণীদ্বয় বড়ই
ভীত হন। তাঁরা নিরুপায় ও নি:সহায়তা হয়ে
কর্ণগড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহের মাতুল পুত্র
নাড়াজোলের জমিদার ত্রিলোচন খানের নিকট
আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁরা গোপনে ত্রিলোচনের
সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কথিত আছে যে, যে স্থানে
সাক্ষাৎ হয়েছিল আজও তাহা “রাণী পাটনা” নামে
বিখ্যাত।
বর্তমান লেখক এর একটি প্রামানিক দলিল আবিষ্কার করেছেন ১১৬২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দে বর্গক্ষত্রিয় নেতা গোবর্ধন দিকপতি ব্রাম্ভণ রাজাদের আড়রাগড়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ৺জয়চন্ডী মাতার সেবাঈতকে দেব সেবার জন্য
৮বিঘা জমির পাট্টা দান করেন। লেখক এই ভূমিদান পাট্টাখানি ব্রাম্মন ভূমির শ্যামচাঁদপূর গ্রামের মল্লিকের বাটির প্রাচীন পুঁথি থেকে উদ্ধার
করেন ‘বন্ধুবর ‘ অধ্যাপক প্রনব রায় মহাশয়কে
আড়রাগড় ভ্রমণের সময় দিয়েছিলেন (১৯৭৪ খ্রী:
ইতিহাস ও সংস্কৃতি পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত-
‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’, মেদিনীপুর জেলা’, দ্বিতীয়
সংকলনে লেখকের লেখা চন্দ্রকোণার আঞ্চলিক
ইতিহাস’ দ্রষ্টব্য)। এই ভুমিকা পাট্টারই আলোক
চিত্র ঘাটালের কথা- পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও
প্রনব রায় মহাশয়ের পুস্তকে ৪০-৪১ পৃষ্ঠার মধ্যে
প্রকাশিত হয়েছে।
এখন ‘ঘাটালের কথা’ পুস্তকে ২৫৬ পৃষ্ঠার উক্ত পাট্টাখানিতে কি লিখা আছে দেখা যাক:-
সন ১১৬২ বঙ্গাব্দে ‘চূড়ায় নায়ক’ গোবর্ধন দিকপতির স্বাক্ষরিত একটি ভূমিদান পাট্টা:-
৭শ্রী শ্রী কৃষ্ণ স্বা: শ্রী গোবর্ধন
ববসমকে(?) জয় চন্ডী জী: গোবর্ধন দীগপতিস্য
দিলাঙ সন মহারাজ: ৮বিঘা দিলাঙ
আগাম হইতে যোয়া
(?) করহ ইতি তাং
৬ আষাঢ় সন ১১৬২
সাল
৭ পাট্টা কবুলকরির থাকে কবুলাতে প্রা: ব্রম্ভণভূমি
সরকার গোয়ালপাড়া নানকার পছিমতরফ মোজ্জাত: । (মৌজ্জেতে: )? পিধা(?) ডিহির সঙ্গে
মৌজে ঝাটাডা সঙ্গে জল সাল জমি পতিত হাসিল
৮ আট বিঘা শ্রী শ্রী ৺জ:জী:কে সেবার কারণ শ্রী জুত ভগীরথ মল্লিক ঠাকুরকে দেবত্তর পাট্টা দিলাঙ শ্রী জুত রাজা জজী:কে এবং আমাদিগকে
আশীর্ব্বাদ করিআ আমার দত্ত বলুদ?) করিয়া পরম পরম যুকে পুত্র পৌত্র সেবা করিআ পরম কে
সেবা করহ অপর দাআ নাস্তি”
★★বিদ্রোহ বহ্নি
(আমশোলের বুড়ো দিকপতির মন্দির)
জনশ্রুতি আছে যে গোবর্ধন দিকপতি মহাশয়ের
আর এক রণ শিবির ছিল বগরীর গহন অরণ্যে।
লেখক গবেষণা করে দেখেছেন যে,গড়বেতা থানার
অন্তর্গত আমশোল মৌজায় এখন তাঁর স্মৃতি মন্দির বিরাজিত আছে। এই মন্দিরটি চারচালা, পাথরের তৈরি ওপূর্ব্বাভিমুখী। এখানে প্রতি বৎসর মকর সংক্রান্ত উপলক্ষ্যে মেলা হয়। মন্দিরটির নাম বুড়োদিকপতির মন্দির। লোকে বলে, ‘লায়কালি হাঙ্গামা অর্থাৎ নায়েক বিদ্রোহের সময় দিকপতি ইংরেজদের মুখ দর্শন করবেন নি বলে এখানে সমাধি নিয়েছেন ‘। এই মন্দির সংস্কারের সময়
একটি ভস্মাধার পাওয়া গিয়েছিল। বগড়ীর জঙ্গলেনেড়াকপা ও চাঁদবিলা মৌজার দক্ষিণ দিকে ‘দিকপতি পুস্করিণী ‘ বলে দুটি পুস্করিণী আছে।
এছাড়া শালবনী থানার অন্তর্ভুক্ত ভঞ্জভূম পরগণার
এই দিকপতির প্রতিষ্ঠিত সুবিশাল দীঘি বিরাজিত
আছে। অনেকে মনে করেন, বহগড়ীর জঙ্গলেই তাঁরগোপন অস্ত্রাগার লুক্কায়িত রয়েছে, বীর বিপ্লবী গোবর্ধন দিকপতির যেখানেই মৃত্যু হোক না কেন,
দেশব্যাপী পরম শ্রদ্ধার সহিত এই স্থলেই তাঁর পবিত্র স্মৃতি মন্দির নির্মাণতৈরি করে দেন। মন্দিরটি পূর্ব্বোক্ত ফাঁসী ডাঙ্গা হতে কিয়ৎ দূরে দক্ষিণ পশ্চিম কোনে অবস্থিত। এই বুড়ো দিকপতিরমন্দিরের পূজারী বৈষ্ণব। এখন ব্রাম্ভণ বৈষ্ণবের পা ধুইয়ে মন্দিরে জল দেবার রীতি আছে। এ থেকেবোঝা যায় গোবর্ধন দিকপতি মহাশয় ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও অধ্যাপক প্রনব রায় মহাশয়ের মতে তিনি ছিলেনচেতুয়ার উত্তর ধান খালের বাসিন্দা।
এই ঐতিহাসিক গণবিদ্রোহ সম্বন্ধে মেদিনীপুরের
ভূতপূর্ব কালেক্টর ও সেটেলমেন্ট অফিসার
জে .সি. প্রাইস সাহেব লিখেছেন ” মেদিনীপুরের
চোয়াড় বিদ্রোহ এক নৃশংস অত্যাচারের ইতিহাস।
জায়গীর বাজেয়াপ্ত সরদার ও পাইকগণ উন্মত্ত
প্রায় হইয়া সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করিতে থাকে। “
ক্রমশঃ…