৪-র্থ পর্ব
পটের রকমসকম
লেখা-বর্ণালী রায়
লেখিকার পায়ের তলায় সর্ষে।আজ পুরুলিয়ার এই মেলাতে তো কাল ইতিহাসের হাত ধরে পৌঁছে যায় মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজারাজড়ার কোনও অলিন্দে।”গরীবের ঘোরা রোগ” বারবার তাঁর তথ্য তত্ত্ব ও ভিন্ন দর্শনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর সম্প্রতি এই ছোট ছোট ভ্রমণের চোরাকুঠরির সমন্বয়ে বর্ণিক প্রকাশন থেকে সম্প্রতি “ভ্রমণ-যাপন১”
শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।পাঠকরা সংগ্রহে রাখতে পারেন।চেনা পৃথিবীর অচেনা দর্শন।বর্ণালী বাইফোকালিজমের একজন অন্যতম সদস্যাও।
চিত্রকরদের ইতিহাসঃ
সংস্কৃতিবিদরা মনে করেন মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অনুযায়ী যে শিল্পকলারর পরিচয় আমরা পাই তার ইতিহাস আনুমানিকভাবে ৪০,০০০ বছর। পৃথিবীরর আদি লগ্ন থেকে মানুষ বিভিন্ন গুহাচিত্র, শিলালিপি, তাম্রপট্ট তে নিজের বিবর্তনের ধারা লিখে রেখে গেছে।বাংলায় এই ধারার বাহক হল পটচিত্র।পটের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। পঞ্চম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতকের বহু প্রাচীন গ্রন্থে পটের ইতিহাস পাওয়া যায়।আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পটুয়া সম্প্রদায়ের জন্মকথা থেকে তাদের সমাজচ্যুত হবার ইতিহাস সবই লিখিত আছে।পুরাণে বর্ণিত কাহিনীতে স্বয়ং বিশ্বকর্মা ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর অভিশাপে স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচী গোয়ালা মন্মথের ঘরে পার্বতী বা প্রভাতী নামে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বকর্মা তপস্যারতা ঘৃতাচীককে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।তাদের বিবাহের পর বিশ্বকর্মারর ঔরসে ঘৃতাচীরর গর্ভে একে একে নয় দক্ষ শিল্পীরর জন্ম হয়: ১.মালাকার ২.কর্মকার ৩.শঙ্খকার ৪.তন্তুবায় ৫.কুম্ভকার ৬.কাংসকার ৭.সূত্রধর ৮.চিত্রকর ৯.স্বর্ণকার। এদের মধ্যে চিত্রকরা অষ্টমগর্ভের সন্তান।এদের কপালে ছিল স্বয়ং মহাদেবের অভিশাপ। এদের নাকি জাত কুল বলে নাকি কিছু থাকবে না।
পুরাণের উপাখ্যান পেরিয়েও প্রাচীন ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল চিত্রকরদের প্রাচীত্বের সাক্ষী বহন কর। খ্রীষ্ট জন্মের ৫০০ বছর আগেকার জৈনধর্মের কল্পসূত্রে চিত্রকরদের কথা পাওয়া যায়।পুরি, কোনারকের মন্দির পটচিত্রের উৎকৃষ্টতা বহন করে আজও। গৌতম বুদ্ধের জীবন চিত্রকে মনেষ্ট্রির দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা হয়েছিল সেটাও উৎকৃষ্টতম চিত্রকরদের কাজ।কৌটিল্যের কূটনৈতিক কার্যকলাপে সাহায্যকারী হিসেবে দক্ষ চিত্রকরদের নমুনা মেলে।২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্র শিল্পকলার এক অভূতপূর্ব নিদর্শন।মহর্ষি পতঞ্জলির রচনায়,কালীদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ ও ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকে,বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষসে’ প্রাচীন পট থেকে শুরু করে মুঘল সাম্রাজ্যের আকবরনামায় গাজিরপট , এমনকি ইংরেজ আমলে সাহেব পটের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নানা ঘরাণার চিত্রকরঃ
আগের অধ্যায়টিতে আমরা কয়েকপ্রকার পট নিয়ে আলোচনা করেছি।আরো কিছু রকম সকম নিয়ে আজ বলব।বিষয়বস্তু অনুযায়ী পট কে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—
ধর্মীয় পট( যেমন : হিন্দু পট, মুসলমানীপট,খ্রিষ্টীয়পট, জৈনপট,বুদ্ধ বিষয়কপট,)
ধর্মনিরপেক্ষ পট(পণ প্রথাবিরোধীতা,নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বৃক্ষ রোপণ )
লৌকিক পট(লৌকিক দেবদেবীরপট, লৌকিক উপাখ্যান পট)।
আবার লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ গুরুসদয় দত্ত পটের ভাগ করেছেন একটু অন্যভাবে,তাঁর মতে পটচিত্র তিন প্রকার লীলাকাহিনীমূলক,পাঁচকল্যানীবিষয়ক(দেবদেবী বিষয়ক ছড়ার পাঁচমিশেলি) ,গোপালন বিষয়ক।
পশ্চিমবঙ্গে চিত্রকরদের দুটি ঘরানা ছিল:
১. তমলুক –কালীঘাট– ত্রীবেণী সমাজশৈলী
২. বীরভূম –কান্দি– কাটোয়া সমাজশৈলী
কালীঘাটের পটের উৎস থেকে বিলুপ্তি (১৮১৫–১৯৩৫সাল)পর্যন্ত প্রধান মোট ৩টি ধারা প্রচলন ছিল।
১.ইন্দ্রমোহন ঘোষ ও তাঁর দুই পুত্র নিবারণ ও কালীচরণের ধারা।এই দুই ভাইয়ের শিষ্য হিসেবে বলাইদাস বৈরাগী ও পরাণ চন্দ্র দাস স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন।পরবর্তীকালে বলাই ও পরাণ এই দুই খ্যাতিমান শিল্পী কালীঘাট ত্যাগ করে যথাক্রমে নদীয়া ও রেঙ্গুনে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
২.বলরাম,নীলমণি ও গোপাল দাসের ধারা।এই ধারায় আদি পর্বে ভাবনা দাস ও তাঁর ভাইপো গোপাল দাসের নাম পাওয়া গেলেও এঁরা কোনোভাবে বলরাম ও নীলমণির সাথে সম্পর্কযুক্ত কিনা তা জানা যায় না।
এই ঘোষ ও দাস ধারার বাইরে বটকৃষ্ণ পালের নাম।এছাড়াও আরো দুজন বিখ্যাত কালীঘাট পটের শিল্পী ছিলেন দু:খীরাম ও মাথুর।
৩.চিত্রকর সম্প্রদায়ের ধারা(দিঘল পটের)। এই ধারায় প্রথমেই উল্লেখ্য কার্তিক চিত্রকরের নাম।ইনি আকুবপুরের লোক।তবে কালীঘাট পটের আদি পটুয়া।তাঁর বংশতালিকায় আট নয় প্রজন্মের নাম পাওয়া যায়।কার্তিক >গদাধর>গৌরাঙ্গ >গণেশ>প্রভাস>নারায়ণ (এঁর দুই ছেলে ধরনীধর ও মেঘনাদ )।মেঘনাদের ছেলে উদয়।
এছাড়াও এই ধারায় রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত পটুয়া রজনী চিত্রকরের(১৮৯২-১৯৬৮) নাম উল্লেখনীয়। তিনি বলরাম দাস ও নিবারণ ঘোষের শিষ্যা।তবে তাঁর তিন ছেলে শ্রীশ,শম্ভু আর রমানাথ পটের বাজার উঠে যাওয়ার পর্যায়ে এই কাজে আসেন।
দুই মেদিনীপুর এবং বীরভূমে পট শিল্পের চর্চা এখনো থাকলেও নদীয়া,হাওড়া,হুগলী,দক্ষিণ ২৪ পরগণা,মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।যদিও বীরভূমের হাটসেরান্দি গ্রামের দূর্গা পট,কিংবা পানুর গ্রামের বিখ্যাত ছবিলাল চিত্রকর যাকে গুরুদয় দত্ত বিশ্বকর্মারর বংশধর বলতেন, ইটাগড়িয়ার সুদর্শন চিত্রকর যার কথা বিখ্যাত সমাজবিদ বিনয় ঘোষ লিখে গেছেন সেসব আজ কিংবদন্তি। ,বাঁকুড়ার যামিনী রায়ের হাতে আঁকা পটচিত্র এখনো বিশ্ববন্দিত। মুর্শিদাবাদের পাঁচুপি,কান্দি,গোকর্ণ এসব অঞ্চলে থেকে গেছে পটুয়া পাড়াগুলি কিন্তু বিলুপ্ত হয়েছে কান্দি ও গণকর ঘরানার পট।বেশীর ভাগ পটুয়াশিল্পী অভাবের তাড়নায় অন্য পেশায় চলে গেছে।
চিত্রকরদের ধর্ম বেতান্ত
চিত্রকর১ঃ ছবিঃ গৌতম মাহাতো
অবাক ব্যাপার কালের ইতিহাস ঘাটলে সত্যিই দেখা যায় একসময় এই চিত্রকরেরাও বাকি শিল্পীদের মতোই সামাজিক মর্যাদা ভোগ করলেও পরবর্তীকালে ঐতিহ্য বিরোধী চিত্র অঙ্কনের অপরাধে সমাজচ্যুত হয়।যদিও এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত প্রচলিত।এ বিষ য়ে উল্লেখ যোগ্য মতটি হল: পটুয়ারা ছিলেন হিন্দু ধর্মের মধ্যে নিম্ন বর্ণের মানুষ,তাদের প্রতিনিয়ত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার সহ্য করতে হত।এই অত্যাচার আর সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে নিত্য বঞ্চনা এদের মুস লিম শাসনে ধর্মান্তরিত হবার মূল কারন।কারন তাদের মনে হয়েছিল রাজার ধর্ম তাদের সব দিক থেকে সুফলদায়ী হবে।যদিও এই ধর্মান্তকরণ বাস্তবে সুফলদায়ী হয়নি,মেলেনি প্রাপ্য সম্মান।পটুয়ারা পরোক্ষভাবে ধর্মপ্রচারের কাজই করতেন।মুসলিম শাসক তাদেরকে কাজে লাগিয়ে অবিভক্ত বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচার চালাতেন।সেই কাজে পটুয়ারা পটে হিন্দু দেব দেবীর মতোই হজরত মহম্মদের ছবি আঁকার অপরাধে ইসলাম থেকে বিতাড়িত হন।প্রথমে হিন্দু,পরে ইসলাম থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা এই পটুয়াদের একটা বড় অংশকে হিন্দু মহাসভা দ্বারা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী,প্রমথ নাথ মাইতি প্রমুখ সে সময়ে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। রজনী চিত্রকরের নাম পাওয়া যায়। তারাপদ সাঁতরা মেদিনীপুরের কেশব গড়ের প্রবীণ চিত্রকর সতীশ বাবুর উদাহরন দিয়ে বলেছেন,হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় ভারত সেবাসংঘ থেকে কিছু চিত্রকর কে হিন্দু ধর্মে রূপান্তর করা হয়।যদিও অনেকেই আবার পুরানো ধর্মাচরণে ফিরে গেছিলেন হিন্দু সমাজের স্বীকৃতি না পেয়ে।আসলে এদের ধর্ম বেতান্ত পুরোটাই ঘেঁটে ঘ।তাই তো এই টালমাটালে পটেও ছাপ পড়েছিল।সত্য নারায়ণ থেকে সত্য পির,দক্ষিণ রায় থেকে গাজি সাহেব।সবই কালের আবহে অদল বদল হয়েছে।ধর্ম বাহ্যিক কিছু পরিবর্তনের জন্য দায়ী হলেও শিল্পধারায় কিছু ছাপ পড়লেও শিল্পী সত্ত্বায় সেটা ছিল না।
এই চিত্রকরদের কিছু আবার দুই ধর্মের চিহ্ন বহন করেই থেকে যায়।এদের অনেকেরই একটা হিন্দু নাম,একটা মুসলিম নাম।পদবি হিসেবে সবাই চিত্রকর ব্যবহার করেন।বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে দুই ধর্মের নিয়ম মানা হয়,।যে যেভাবে পালন করেন। কেউ স্বেচ্ছায় সিঁদুর পড়েন,কেউবা শুধুই কাঁচের চুড়ি।মৃত্যুর পর শরিয়ত মেনে কবর দেওয়া হয় কাউকে,তো কাউকে দাহ করার রীতি প্রচলিত।এরা সরস্বতীপূজা করেন,বিশ্বকর্মার বন্দনা করেন। বেশীরভাগই চিত্রকর পদবি ব্যবহার করেন।কেউ কেউ আছেন যাঁরা সূত্রধর পদবি ব্যবহার করেন। যদিও এঁদের বঞ্চনার ইতিহাস বলে যায় এঁদের বেদনার কাহিনী।কিন্তু কোথাও এই বঞ্চনাই হয়তো শিল্পী সত্তাকে দৃঢ়তা দিয়েছে। আজকের ধর্মীয় অসুহিষ্ণতার ভারতে দাঁড়িয়ে এই মানুষগুলো প্রমাণ দেয় শিল্প ধর্ম চেনে না, জাত চেনে না চেনে শুধু রং, তুলি, আর পট। এ যেন এক অন্য ভারতবর্ষ। ,যেখানে এঁদের একমাত্র পরিচয় এরা শিল্পী, চিত্রকর,পটুয়া।
সমাজে চিরকালই চিত্রকরা প্রচারক,বিনোদনকারী।ধর্ম প্রচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজা মহারাজা, জমিদার কিংবা বিত্তবান মানুষদের বাড়ির পুজোপার্বণে,অনুষ্ঠানে পটুয়াদের ডাক পড়ত পট খেলানোর জন্য। এখন আর সেভাবে পট খেলানো হয় না, পটুয়াদের ডাকও পড়ে না। দিন বদলেছে শিল্পীদের। এখন তাঁরা অনেকটাই স্বাবলম্বী, কর্পোরেট ছোঁয়া লেগেছে শিল্পে।মূল ধারার শিল্পীরা প্রায় নেই বললেই চলে।যেসব পট আঁকা হচ্ছে সেগুলো শুধুমাত্র অনুকরণ।এক্রেলিক রং,আর্ট পেপার পট,জামা গেঞ্জি,চাদর,বাসন এসব এসে পড়েছে বাজারে।আসলে চিত্রকরদের বর্তমান প্রজন্ম কাছে ধারা বহনের পথে পুঁজিই মূল অন্তরায়।প্রাচীণ শিল্পকে ধরে রাখার তাগিদ খুব কম শিল্পীর মধ্যেই চোখে পড়ছে। অর্থের তাড়নায় বহু শিল্পী অন্য পেশায় চলে গেছে।
আজকের পটের গ্রামঃ
মাটির বাড়ির নিকোনো দেওয়াল যেন হঠাৎই হয়ে উঠেছে ক্যানভাস— শিল্পীর রঙিন হাতে বিচিত্র তার রূপ। একে একে রঙে ভরে গিয়েছে কুঁড়ে ঘরগুলি। বিভিন্ন পটচিত্রের গল্পে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল। তা ছাড়া পটচিত্রের নিজস্ব অঙ্কন রীতিতে রঙিন হয়ে উঠছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি শার্ট, ছাতা, হাতপাখা, হ্যান্ড-ব্যাগ বা ট্রে, মোড়া, ঘর সাজাবার নানা উপকরণ। প্রতিটি বাড়ির দাওয়ায় আছে বিকিকিনির আয়োজন। মাঝেমধ্যেই জমে ওঠে কর্মশালা। তৈরি হয়েছে একটি মঞ্চ। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় সেখানে।বছরে নানা সময়ে জমে ওঠে পটমেলা।পটুয়াদের জীবন ও শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দারুন এক সুযোগ। শুধু মেলার সময়ই নয়, বছরভর দেশ বিদেশের মানুষের আনাগোনা লেগেই আছে।কলকাতার বেশ কয়েকটি বুটিকের কর্ণধাররাও এখানে এসে নিয়ে যান অর্ডার মাফিক পোশাক,অন্যান্য জিনিসপত্র
৮৬ টি পরিবারের ২৭০ জন পটুয়াদের নিজস্ব সংগঠন “চিত্রতরু” এবং সহযোগীতায় পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ। ইউনেসকোর সহায়তায় পটশিল্পের Rural Craft Hub গড়ে উঠেছে। এখানে একটি পটশিল্পের সংগ্রহশালা, বাহাদুর চিত্রকরের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা এবং অতিথি নিবাস রয়েছে।
নির্দিষ্ট কোন কাহিনীকে ভিত্তি করে পট আঁকা হয়। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বা সাম্প্রতিক ঘটনা পটের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। রামায়ণ, মহাভারত, চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলের মতো কাহিনীগুলিকে পটুয়ারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। সেইসঙ্গে বর্তমান দিনের বন্যা, দুর্গা পূজা, পালস্ পোলিও, ডেঙ্গু, এডস্, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, বনভূমি ও বন্যপ্রান রক্ষা, সেভ ড্রাইভ কর্মসূচী সহ আরো নানান সচেতনতামূলক প্রচার পট চিত্রের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। পটের ছবির কাহিনীটিকে গান গেয়ে বর্ণনা করেন পটশিল্পীরা। ছবি ও সুরে জীবন্ত হয়ে ওঠে বিষয়। এই শিল্প কর্মের সঙ্গে মূলতঃ মহিলারাই যুক্ত। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, পটচিত্রে যে রঙ ব্যবহার করা হয় সেগুলি বিভিন্ন গাছপালার প্রাকৃতিক উপাদান থেকে শিল্পীরা নিজে হাতে তৈরী করেন। তাই রঙ তৈরীর পদ্ধতিটিও একটি দর্শনীয় বিষয়।
১৫-২০ বছর আগে পটিদার মানে পটশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পটের গান শুনিয়ে বেড়াতেন। গান শুনে কেউ দিতেন টাকা, কেউ আবার চাল-ডাল। আর এখন গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে। পট শিল্পীদের রোজগার বেড়েছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, সন্তানদের এই গ্রামের শিল্পীরা পটুয়াই বানাতে চান। সেই লক্ষ্যে প্রতি রবিবার নিয়ম করে পট আঁকার ক্লাস বসে। তাতে যেমন গ্রামের কচিকাঁচারা যোগ দেয়, তেমনই আশেপাশের গ্রামের লোকও আসে। অনেক শিল্পী রাজ্য সরকারের পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে পটচিত্র। নয়ার পটচিত্র AIACA এর Craftmark পেয়েছে।
অনেক মাটির বাড়ি পাকা হয়েছে। দেশে-বিদেশে তাঁদের শিল্পী সত্ত্বা ছড়িয়ে পড়ছে। একজন শিল্পীর কাছে অর্থের চেয়েও সম্মান অনেক বেশি কাম্য। আর তার থেকেও বেশি কাম্য তাঁর শিল্পসত্ত্বার কদর করার লোকজনের। পটগ্রামের জনা ষাট-সত্তর লোক আজও সব ছেড়ে অন্য পেশার সন্ধান না করে নিজেদের এলাকায় থেকে এই শিল্পকে বিশ্বের দরবারে যেভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন তাকে কুর্ণিশ।
গ্রন্থ ঋণঃ
১.পট ও পটুয়া কথা- ভোলানাথ ভট্টাচার্য
২.পুরুলিয়ার পটশিল্প ও পটের গান
৩.বাংলার পটকথা–আত্রেয়ী
৪.পশ্চিম বঙ্গ পত্রিকা মেদিনীপুর জেলা সংখ্যা
৫.মেদিনীপুরের ইতিহাস
৬.লোকজ শিল্প
৭.তবুও প্রয়াস ‘কুটিরশিল্প’ সংখ্যা
৮.আরশিনগর– লীনা চাকী
৯.বাংলার লোকদেবতা ও লোকসংস্কৃতি — দেবব্রত নস্কর
১০.কিছু ছবি — গুগুল
★★★