মানভূমের ছাতা পরব
ছাতা পরব-ছাতা মেলা
লেখা ও ছবি – বর্ণালী রায়
‘মাই ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের দুনিয়াতে খুব চলছে কথাটা।কিন্তু এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বাইরেও একটা ভারতবর্ষ আছে।কিছু মানুষ আছে যাদের অনেকেই গোটা ভারতবর্ষ তো দূরস্থান পশ্চিমবঙ্গে বাস করেও কল্লোলিনী কলকাতার শুধু নামই শুনেছে মাত্র।যারা আমাদের এই ভারতবর্ষের মাটিতেই জন্ম নিয়েছে,বসবাস করছে পুরুষের পর পুরুষ।তাদেরই আদিবাস ভূমি এই মাটি।যারা আমাদের কাছে সাঁওতাল।যদিও আদিবাসীদের মধ্যেও অনেক ভাগ আছে।কিন্ত আমরা শহুরে তথা কথিত সভ্য মানুষেরা আদিবাসী মানুষ মানেই বুঝি সাঁওতাল।যাদের সাজ পোশাক, নাচ গান, জীবনযযাপন নিয়ে নাগরিক মানুষের বিস্তর কৌতূহল। আজকাল আবার শহুরে বাঙালীর হিরিক উঠেছে গ্রামের মেঠো পথে বেড়াতে যাওয়ার।নাগরিক তকমা মুছতে মরিয়া বাঙালী দোল থেকে পিকনিক সব উৎসব উদযাপনের জন্য বেছে নিচ্ছে লালমাটির দেশকে।দীপুদা(দীঘা,পুরি,দার্জিলিং) ছেড়ে পুরুলিয়া। যদিও ওই দেশের ভূমি পূত্রদের এবিষয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই।তারা নিজেদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাটুকু নিয়ে দিব্বি আছে।আর আছে তাদের নিজস্ব প্রথা,পরব,মেলা।
আমরা যারা শহুরে মানুষ তাদের কাছে পুরুলিয়া হল দারিদ্রপীড়িত, পিছিয়ে পড়া,অন্ত্যজ শ্রেণীদের জেলা,কারণ প্রকৃতি এখানে দারুণ রুখাশুখা। অনুর্বর,বন্ধ্যা মাটি,প্রতিকূল আবহাওয়া,বন্য জীব জন্তুদের উপদ্রব।নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিত্যনৈমিত্তিক কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়।কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরুলিয়ার অমোঘ আকর্ষণ থেকে নিজেদের বিরত রাখা সম্ভব নয়।ছোট ছোট পটে আঁকা ছবির মতো গ্রাম,নীলচে-ধূসর পাহাড়,বিশাল বিশাল বাঁধ,বাঁধের জলে সবুজ ধূসর রঙের মায়াবী খেলা।বসন্তে শিমূল পলাশের রঙ্গোলী। তার সাথে আছে আদিবাসী সুরের মূর্ছনায় ধামসা মাদোলের তালে তালে নাচ।
বছরের সব মাসেই নানা পালা পার্বণ আর পরবে সেজে ওঠে, মেতে ওঠে পুরুলিয়া।এইসব উৎসব ও মেলাগুলি বেশীরর ভাগই ধর্মীয় অনুষ্ঠান, প্রাচীন ইতিহাসের সাথে জড়িত।
খোঁজ পেয়ে একটা মেলা দেখতে গিয়েছিলাম পুরুলিয়ার চাকোলতোড় গ্রামে।ছাতা পরব।ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিনে চাকলতোড়ে ছাতা মেলার মাঠে একটা বিশাল বড় মেলা বসে।
আসানসোল টাটানগর লাইনে পুরুলিয়ার পরের স্টেশনইই হল টামনা।সেখান থেকে গাড়িতে পৌঁছানো যায় ছাতার মাঠে।
এই ছাতা পরবের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু গল্প শুনতে পেলাম।একদল বলল পঞ্চকোট রাজার সাথে ছাতনার রাজার যুদ্ধ বাঁধলে পঞ্চকোট রাজা জয়ী হন,তারই বিজয় উৎসব ছাতা পরব।আবার কেউ কেউ বলেন ইংরেজদের বিরূদ্ধে সাঁওতালদের সংগঠিত করে,পঞ্চকোট রাজা যুদ্ধ লড়েছিলেন।শয়ে শয়ে সাঁওতাল একত্রিত হয়ে এই মেলার মাঠে শপথ গ্রহণ করে।আর তারই প্রতীক স্বরূপ ছাতা তোলা হয়।ছাতা মেলার প্রাক্তন সম্পাদক তথা স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মান্যবরেন্য ব্যক্তি কালীপদ কিস্কু শোনালেন সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প।তাঁর কথা অনুযায়ী আনুমানিক ১৮৫৫ সালের কথা হবে।ভারতবর্ষ তখন ইংরেজ অধ্যুষিত।একজন সাঁওতাল রমনীকে ইংরেজ সেনারা আক্রমণ করে।সেই মেয়েটি নিজের সম্মান বাঁচাতে গ্রামে এসে উপস্থিত হয়।তখন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।তখনই যুদ্ধ বাঁধে ইংরেজদের সাথে।এই যুদ্ধে পঞ্চকোট রাজা সাহায্য করেছিলেন।কালীপদ বাবুর কথা অনুযায়ী, সেটা রাজা গন্ধর্ব সেনের রাজত্বকাল।এই যুদ্ধে অস্ত্রের যোগানে সাহায্য করেছিলেন পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজা।অনেক যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যদের হারিয়ে আদিবাসী আর দেশীয় রাজারই জয় হয়।
ছাতার মাঠের পাশেই আছে ছাতা পুকুর।সেটা নিয়েও আদিবাসী সমাজে নানা গল্প প্রচলিত আছে।কালিপদ বাবুর কাছেই শুনলাম রাজা লালদেও সিং এর ও পূর্বপুরুষরা যখন এই পুকুর খনন করছিলেন,সেই সময় সেই পুকুরের মাঝখান থেকে একটি সোনার ছাতা ভেসে ওঠে,এই সেই আজকের ছাতা।বিজয় উৎসব আর ছাতা পরব সেই থেকে প্রতি বছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে(৩১শে ভাদ্র) একইসাথে পালিত হয়।
প্রথমদিকে যদিও মেলা এত সংগঠিতভাবে হত না।দেশজ রাজার সাথে আদিবাসী জন গোষ্ঠীর মতভেদও হয়েছে নানা বিষয়ে।পরবর্তি সময়ে মানে ১৯৮২ সাল থেকে কমিটি গঠনের মাধ্যমে মেলা পরিচালনা করা হচ্ছে।ধিরে ধিরে বিষয়টা অনেক সংগঠিত হচ্ছে।মেলার ব্যাপ্তি হয়েছে।
তবে গল্প বা ইতিহাস যাই থাকুক না কেন,এই পরবটা যে নিখাদ সাঁওতালদের পরব,তার টের পেলাম।হাজার হাজার মেয়ে,পুরুষ,বাচ্চা,বুড়ো সাঁওতাল দলে হেঁটে, সাইকেল,ট্রেকার চেপে ছাতা পরবে আসছে।বিশাল মাঠ জুড়ে মেলা বসেছে।আর তার পাশেই আরেকটা মাঠ, যেটাকে সবাই ছাতার মাঠ বলছে।দূর থেকে দেখতে পেলাম বিশাল উঁচুতে একটা সাদা ছাতা।যত কাছে যাচ্ছি ছবিটা পরিষ্কার হচ্ছে।একটা বিশাল শাল কাঠের ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে।আর সেই ম্যারাপের মাঝেই দুটো শাল কাঠকে কপিকল সিস্টেমে এমনভাবে আটকানো হয়েছে,যাতে ছাতাটাকে পতাকার মতো উঁচুতে খাড়া করা যায়।আসলে সাদা মখমল কাপড়ে মোড়া থাকে আসল ছাতাটা।লোক মুখে শুনলাম ছাতাটা সোনার।সারা বছর ওটা রাজবাড়ির মন্দিরে থাকে।পরবের দুদিন মেলার মাঠে থাকে।বেশ অবাক লাগছিল গল্পগুলো শুবে পঞ্চকোট রাজা নিজে সাঁওতাল না হয়েও এটা সাঁওতাল পরব।পুরোহিত মশাই ওই শালের গুড়ির নীচে বসে কুলদেবতার পূজা করে চলেছেন।অবশেষে এল সেই প্রতীক্ষিত সময়। দেখলাম হৈ হৈ বেঁধে গেছে।কি না রাজা আসছে।রাজা এলেন কাসর,ঘন্টা,শঙ্খ, শিঙা ধামসা,মাদল বাজনা বাজিয়ে।পরনে রাজবেশ, মাথায় পাগরি,পায়ে নাগরাই,কোমরে তলোয়ার গোঁজা। পঞ্চকোট রাজবংশের বর্তমান বংশধর। সে এক জমজমাট ব্যাপার।ততক্ষণে মেলার মাঠ ফাঁকা।ছাতার মাঠ উপচে পড়ছে লোকে।লোকের মাথা লোক খাচ্ছে।রাজা এসেছেন,এবার ছাতা উঠবে।রাজা এসে প্রশেসন নিয়ে ছাতার চার পাশ ঘুরছেন।পর পর তিন পাক।তারপর সষ্টাঙ্গে কূলদেবতাকে প্রণাম জানালেন।রাজার সাথে সাথে উপস্থিত সবাইও প্রণাম করছে।তারপর রাজা সরাসরি হেঁটে চলে গেলেন উঁচু একটা বেদির উপর প্রথমটা বুঝতে পারিনি,তারপর লক্ষ্য করে দেখলাম রাজা একটা সাদা রং এর রুমাল উড়িয়ে দিলেন ছাতার দিকে তাকিয়ে।আর সাথে সাথেই ওই শেগুন কাঠের কপিকলের সাহায্যে ছাতা তোলা হল প্রায় আকাশ ছুঁই ছুঁই। সাথে সাথে হাত তালি দিয়ে জনগন অভিবাদন জানালো।এরপর সবাই মেলার মাঠের দিকে চলে গেল।শুনলাম ছাতাটা নাকি পরেরদিন পর্যন্ত এমনভাবেই থাকে।তারপর আবার ফিরে যায় রাজবাড়িতে।আমরাও গেলাম মেলার মাঠে।সেদিন ছাতা মেলার সাথে সাথে পাতা পরবেরও আয়োজন ছিল।মেলার মাঠে একদিকে সিধুঁ কানহুর মূর্তি,তীর ধনুক রাখা একটা ঘেরা জায়গায়।শুনলাম রাজ পরিবারের লোকজন যেমন নিজেদের মতো পূজার্চনা করেন,তেমন আদিবাসীরাও নিজেদের প্রথা মেনে পরব পালন করে।
একদিনের রাজা, গণতন্ত্রেও রাজতন্ত্রের স্বাদ!একদিনের রাজা আজ চাকলতোড়ের অমিত সিং দেও।বিশ্বকর্মা পূজার দিন অনুষ্ঠিত হয় পুরুলিয়ার ঐতিহ্যপূর্ণ ছাতা মেলা। সন্ধে থেকে এখানে ভিড় জমাতে শুরু করেন আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে থাকা চাকলতোড় গ্রামে ছাতা মেলায় দূরদূরান্ত থেকে আসেন আদিবাসীরা। সারা রাত ধরে চলে এই মেলা। এই মেলা আদিবাসীদের কাছে মিলন মেলা বলে পরিচিত। পূর্বাঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে পুরুলিয়ার ছাতামেলা আজও সবথেকে বড় মিলনমেলা গুলির অন্যতম। । ইতিহাস যাই হোক না কেন, এখন পুরুলিয়ার এই ছাতা মেলা হল আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের মন দেওয়া নেওয়ার জায়গা। সাঁওতাল সমাজে বলা হয় চাকলতোড়ের ছাতা মেলায় না গেলে সাঁওতাল কন্যারা নারী হিসেবে পরিণত হয় না। তাই এই মেলায় কিশোরী ও তরুণীদের ভিড় হয় সবথেকে বেশি। শুধু পুরুলিয়া বা এ রাজ্য নয়। এই মেলায় ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার এমনকি ছত্তিসগড় থেকেও আসেন বহু আদিবাসী তরুণ তরুণী। নাচ গানের মাধ্যমে মেলাতেই হয় একে অপরের সাথে পরিচয়। হয় মন দেওয়া নেওয়া। মনের মিল হলে একরাতের মধ্যেই বিয়ের ঠিক হয়ে যায় তাঁদের। ছাতার মাঠের একটা অংশ ঘিরে দেওয়া হয় মেলার জন্য। রাত্রে নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রেখে এখানে নাচগান-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকেন আদিবাসীরা।
সারি সারি দোকান।জিলিপি,তেলেভাজা, কাঁচের চুড়ি,খেলনাপাতির দোকান।আর দেখলাম ধামসা মাদলের দোকান।আর এখানেই মেলার রূপ টা বদলে গেল।সার বেঁধে সাজানো আছে ধামসা মাদল।লাল,নীল রংকরা। ছোট বড় নানান মাপের।মেলার ভিতর দিকে যত এগোচ্ছি মেলার রূপ বদলে যাচ্ছে।নানান ধরনের বিষয় নিয়ে চলছে জুয়াখেলা।সেগুলো কোনটা কোনটা যেমন মজার তেমন কোনটা আবার বিপদজ্জনক।আর ভিড় উপচে পড়ছে সেইসব দোকানে।চলছে সাপের খেলা।ধারালো ছুড়ি পায়ে হাসিল মুরগির যুযুধান লড়াই। পাহুর মুরগির নিলাম চলছে জোড় কদমে।মেলার এক কোনে মঞ্চ বেঁধে চলছে পুরুলিয়ার নাচনীদের অনুষ্ঠান। আর বসেছে নানা স্বাদের আদিবাসী খাবারের দোকান।শুক্রি জিল(শুয়োরের রান্না করা মাংস),পাতরা পিঠা,মাংস পিঠা থেকে মহুয়া,রসু সবই পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।মেলার এই অচেনা ছবির সাথে সাথে কিছু চেনা ছবিও দেখতে পাচ্ছি।বাচ্চারা হাওয়াই মিঠাই হাতে ভিড় করেছে নাগরদোলনার কাছে।নিখাদ গ্রামীণ একটা পরিবেশ।মেয়েরা কাঁচের চুড়ির পসরার উপর ঝুঁকে পড়েছে।ছেলে বুড়োর দল উপচে পড়েছে নানা স্বাদের ফটকা খেলার দোকানে।লক্ষ্য করে দেখলাম বেশিটাই সাঁওতাল মানুষদের ভিড়।শুনেছি নাকি প্রথা আছে মেয়েদের নাকি একবার এই মেলায় আস্তেই হয়।ঠিক যেমন পুরুষদের শিকার পরবে যেতেই হবে।সাঁওতাল মেয়েদের প রনে সাপ্টা শাড়ি,খোঁপায় ফুল।ছেলেরা পড়েছে পাঞ্জি ধুতি,পায়ে বাঙ্কি।ওরা আজ পাতা নাচ করবে।এই নাচের একটা বিশেষ তাল আছে।মহিলা পুরুষরা একসাথে নাচ টা করে।
একটা সময় পর মাইকে ঘোষণা হতে লাগল মেলার মাঠে যত ‘দেকো'(নাগরিক মানুষ) আছেন,তারা মেলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাইরে যান।বুঝলাম এর পরের সময়টা একান্ত ওদের নিজেস্ব প্রথা পরবের। সেখানে নাগরিক সভ্যতার প্রবেশ নিষেধ,আর তাই এর বেশি জানাতেও পারি না আমরা।ফেরার পথে দেখলাম যে দলেদলে সাঁওতাল মেয়েরা মেলার মাঠে বসে আছে,কেউ দল বেঁধে,কেউ একা একা।ওরা যেন কিসের অপেক্ষা করছে।মনে মনে ভাবলাম আমার চেনা ভারতবর্ষের ভিতরে যেমন একটা ভারত আছে,তেমনি হয়তো বিকেলের এই মেলাটা একটা সাধারণ রূপ।আসল উৎসব শুরু হবে নগর ঘুমিয়ে পড়লে।
(এখানে আলোচিত ছাতা পরবের ইতিহাস,সাল তারিখ সব স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে শোনা)।
★★★