বাবলু গিরি-র কবিতাগুচ্ছ

 কবিতাগুচ্ছ

                                                                                                 ছবিঃ গৌতম মাহাতো

বাবলু গিরি-র কবিতাগুচ্ছ

                                   

                                            
 মেদিনীপুরের চন্দনপুরে জন্ম  কলকাতায় কলেজে পড়তে পড়তে লেখালেখি শুরু। কলেজ জীবন থেকে বহু পত্র পত্রিকায় লিখে আসছেন। গোটাকয়েক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দীর্ঘদিন লেখালেখির থেকে নিজেকে প্রচারের আড়ালে রেখেছেন । প্রায় তিরিশ বছরের পর প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ ” পর্যাষণ” বেরোয় দেজ পাবলিকেশনের কমলিনী থেকে। পরে ” ব্রহ্মান্ড শব্দ সরসী ” এ ছাড়া আরও দুটি সাহিত‍্য ও কাব‍্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন । “জয়দেব পদ্মাবতী” পুরস্কারপ্রাপ্ত। এছাড়া বহু সাংস্কৃতিক সংস্থা থেকে সন্মানিত । বাবলু গিরি একটু ভিন্ন স্বাদের কবি জীবন বোধের গভীর অনুসন্ধান তার প্রধান বিষয়বস্তু । 

কবি

             
কবি অতি ক্ষুদ্র থেকে 
জাগছেন এবং বৃহৎ থেকে বিশ্বরূপ হচ্ছেন । 
ঈশ্বর ও ভয় পাচ্ছেন । 
ঈশ্বর তো সৃষ্টি করেন না,তিনি হাত পাতেন 
নৈবেদ্য গ্রহণ করেন । 
কবি সৃষ্টি করেন,তিনি রৌদ্র ও ছায়া সৃষ্টি করলেন, 
ফুল ফুটে উঠলো নাম গোত্র নিয়ে । 
অজস্র কোলাহল জন্ম নিচ্ছে –
উজ্জ্বল অক্ষর শব্দ সুরে বেসুরে 
নৈঃশব্দের কীর্ত্তণ মন্ত্র হয়ে যায় । 
কবি ফিরে যাচ্ছেন, আলোকবর্ষ ধরে 
পর্যেষণে পর্যটনে ….
চক্রাকারে তিনি আসছেন তিনি আসছেন 
তিনি নৈঃশব্দের পথ ধরে মুখরিত হচ্ছেন ।

 বৃক্ষ 
           
      
আমি ঝরিয়ে দিছি আমার 
আল্পনা আঁকা পাতা । 
আমার কোন ভয় নেই 
নৈঃশব্দের পথে উলঙ্গ দাঁড়িয়ে, 
দেখো না কেমন গন্ধ মাখানো ফুলগুলি 
বিছিয়ে দিছি সেই পথে । 
আমার নিঃস্বতার কোন ভয় নেই । 
উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছি 
রৌদ্রে ভিজে যাবো বলে । 
আর পাখিরা বিছানা পেতেছে শরীরে । 
আমার কোন ভয় নেই 
কেননা আমি আমার নই। 

আদি পুরুষ-১ 

                   
এইভাবে হারিয়ে যেতে যেতে 
আবার ফিরে আসি।
জানিনা কত যুগ ধরে মগ্ন ছিলাম | 
আমি সেই অজানন্ত মূঢ় _ 
রচনা করি পরিমণ্ডলে কূটস্থ হয়ে –
ক্রমশঃ অনন্তকর্মে যোনিগ্রস্ত |
প্রেম দাও মৃত্যু দাও প্রিয়ংবদা      
শরীরে ঈশ্বরের বাস।
এগার দ্বার খোলা রেখো 
আমিও  ত্রৈগুণ যাত্রা করি।
নতুন বল্কলে জন্মময় –
শরীরেই কর্মের চাষ করি।

চব্বিশ তত্ত্বের পর্যেষণে-
পাড়িয়ে যাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সিঁড়ি।

ধানবনের আলে- বাঁশ কঞ্চির বঁড়শি হাতে –
শামুখের ডিমপাড়া দেখে যে বালক।
গোবর নিকানো উঠোনে, 
কনকপ্রভা ধান, অন্নকোট।

মাগো ঢেঁকির তালে দেখেছি –
তোমার নগ্ন হাতে অন্ন কিভাবে নেচে ওঠে।

এইভাবে অন্নময় ব্রহ্মান্ডে বীজ বুনে যাই।
আদি পুরুষ – কড়া নাড়ি।
জেগে ওঠো, আমি এসে গেছি।

নারী

               
নারী এ এক আদি শব্দ 
যেখানে লুকিয়ে আছে এক মথুরা 
এক মগ্নতার বৃন্দাবন।
নারী এক পুরুষের হৃদয়ে লুকানো বিস্ময় ।
নারী এক অমোঘ আকর্ষণ 
যেখানে জন্ম নিতে হয়,এক অনাদি জননী, জন্মপাত্র।
নারী এই শব্দে ব্রহ্মকুণ্ডে ঝনৎকার ওঠে 
থরথর কাঁপে,মহামন্ডলে জরায়ু ছিঁড়ে
হাজার নক্ষত্র জন্ম নেবে।
যেমন পৃথিবীর ঘরে ঘরে আঁতুড় ছিঁড়ে 
শঙ্খ বেজে যাবে।
নারী এক আদি অক্ষর 
জীবন্ত নিধুবন প্রেম বুনে বুনে …

পূজোর সবই ওষুধি 

দিদিমা বলতো পূজায় যত ফুল ফল মূল ঘাস পাতা ধূপ ধুনো অগ্নি মধু সবই ওষুধি । 
কেটে গেলে দূর্বার রস,চুলে জবা,বিসফোঁড়ায় চন্দন,কর্পূরে কফ । 
পূজোর সবই ওষুধি । এমনকি শঙ্খ শব্দটাও । 
পূজোর সবই ওষুধি । এমনকি মন্ত্র,ওম শব্দটা । 
দিদিমা বলতো আউনি বাউনি আসছে, 
পঞ্চপাতার রস খেয়ে,কাককে রূপ দেখাস । 
কাঁচা হলুদ মেখে স্নান,হলুদ ও পাঁচপাতার রস, 
দৌড়ে দৌড়ে কাক খুঁজতাম মগডালে । 
মা সাজিয়ে দিত,প্রদীপের শিখার কলাপাতার 
কাজল পরিয়ে,মাথায় চন্দনের টিপ । 
সরষের তেল আর কাঁচা হলুদ মাখা হলদে ল্যাংটা শরীরটাকে কাক বিষ্ময়ে দেখতো । 
সারা গ্রামে তখন ম ম করছে নবান্নের পায়েস । 
কনকপ্রভা ধানশীষ-
বিনুনি করে সদর দরজায় টাঙ্গানো । 
চালবাটার আল্পনা,ছোট ছোট লক্ষ্মীর পা আঁকা । 
গোবরে নিকানো মাটির উঠোন। 
কলাপাতায় সাজানো নারকেল নাড়ু,
খেজুর গুড়ের পায়েস।দুধপুলি পিঠে, কতো কি ! 

দিদিমা বলতো এই শরীরেই –
বৃক্ষ মাটি জল বায়ু ও আগুন আছে,আদর কর। 
হে কাক ! হে প্রপিতামহ ! 
এখন কি আমার রূপ দেখিয়াছ ? 
প্রতিদিন পঞ্চরস নয় সহস্রবিষ খাচ্ছি । 
কদাকার মেরুদন্ডহীন কঙ্কালসার এক কবি । 
আমায় দেখ মা,হোহো হাসবে, না –
চিৎকার করে মাথা ঠুকে কাঁদবে ? 
আমার লজ্জা ! আমি সব হারিয়ে ফেলছি, 
সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে,শূণ্য নবান্নের মাঠ । 
আমি নিঃস্ব অনাথ শব্দ ভিক্ষা করি 
কাঙাল কবি ।

এসো লকডাউন হই 
             

এখন অন্ধকার সময় ।
ঘরে থাকো হে ঘরের মানুষ।
বন্ধ হয়ে যাক কল কারখানা –
দূষণ মুক্ত হোক পৃথিবী।
আমাদের নিশ্বাসে বিষ, লালসায় বিষ ।
সবকিছু গিলে নিচ্ছি,পঞ্চবটী,পৃথিবীর
সবুজ উঠোন, সরোবর ।
হে মানুষ! একটু লক ডাউন হয়ে যাও –
অবনী একটু বিশ্রাম নিক,স্নানঘরে ভিজে প্রাণখুলে বাতাস মাখুক ।
দুষণ মুছে,উষ্ণতা মুক্ত হোক ।
আন্টারর্টিকায় বরফেরা ফিরে আসুক ।
গঙ্গা বয়ে যাক মুক্ত বিহঙ্গের মতো ।

আজ যুদ্ধ শুরু হয়েছে,অবনীর সাথে মানবের। পৃথিবীর ক্রোধের বাতাসে করোণা, 
এশুধু নমুনা, অবনীর ক্রোধ -।
পবিত্র হও হে মানুষ, এখন অন্ধকার ।
ঘরে থাকো হে ঘরের মানুষ –
কিছুদিন লকডাউন হয়ে যাও।
তারপর অবনী সেজে উঠুক, ভরে যাক 
নব পল্লবে, বাতাস নেচে উঠুক, 
অর্ণজ ঝরে পড়ুক, বিহঙ্গের পাখসাটে –
আকাশ ঝলসে উঠুক ।
পৃথিবী বাসযোগ‍্য হয়ে উঠুক –
আগামী নবজন্মের জন‍্য ।
হে মানুষ, জয়ী হও – জয়ধ্বনি কর ।
হিংসাকে ছেড়ে প্রেমিক হয়ে ওঠো –
এখন পৃথিবীর বড় অসুখ –
সে আর বিশল‍্যকরণী দিতে পারবে না -।
এসো পৃথিবীকে ভালোবাসি, গেয়ে উঠি –
নমো সূর্য, নমো আকাশ, নমো বাতাস, 
নমো বরুণ, নমো ক্ষেত্রভূমি। 
নমো নমো নমো জন্মভূমি।
নতুনভাবে সেজে ওঠো হে দিশাহীন মানুষ –
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি…

                                   ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *