সৈ য় দ ক ও স র জা মা ল-গ্রন্থ সমালোচনা

পরিচিতিঃ  লেখক কতখানি চিন্তাক্ষম তা বহন করে তাঁর লেখা। আর সেটাই লেখকের একমাত্র পরিচয়। তিনি কোথায় কত সালে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন কিংবা কোথায় তাঁর পড়াশুনো, আর্থিক নির্ভরশীলতা কোথায় ইত্যাদি কথাগুলির মূল্য আকাডেমিক কচকচির অন্তঃসারশূন্যতার দরবারে বেশি হলেও প্রকৃৃত পাঠকের কাছে নিতান্তই গুরুত্বহীন। প্রকৃৃত পাঠক মজবেন গদ্যের গুণে লেখকের চিন্তাশক্তিকে উপভোগ করার আনন্দে। সেখানে যদি লেখক সফল হন তবেই তাঁর পরিচয় গড়ে উঠবে পাঠকের দরবারে। নয়তো তিনি অপরিচিতই থেকে যাবেন। কী বলেন পাঠক? বাইফোকালিজম্-এ এমনই একটি গ্রন্থ সমালোচনা রইল পাঠকদের জন্য।

 

সৈয়দ কওসর জামালের অনুবাদ গ্রন্থ ‘ফরাসি কবিতা ১৯৫০ – ২০০০’ -র আলোচনা করলেন   অ র্ধে ন্দু   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

 

বাংলা শব্দের শরীর খুঁড়ে যেখানে জাগ্রত হয় ফরাসি কাব্যের আত্মার সঙ্গীত

আট বছর আগে কেমন করে ডানা জোইয়ার ‘ক্যান পোয়েট্রি ম্যাটার’ বক্তৃতাটির বাংলা অনুবাদ আমার হাতে এসেছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে ঠিক যে-সময়ে শব্দাশ্রয়ী শিল্পমাধ্যম হিসাবে কবিতার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি নিয়ে আমি সংশয়াচ্ছন্ন হই, তখনই এই বইটি আমার সামনে তুলে ধরেছিল এমন কিছু যুক্তির অস্ত্র যা ভেতরে-ভেতরে আমাকে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলা দিয়েছিল। আমি স্পষ্টতই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে একুশ শতকের জটিল আবহকে ধারণ করার জন্য বাংলায় যে-নতুন কাব্যভাষা ও রীতি প্রয়োজন তা এখনও উদ্ভাসিত হয়নি। একইসঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে আর সেই উদ্ভাসনের সম্ভাবনাও বিশেষ নেই। ফলে বুঝেছিলাম কবিতা হয়তো ইতিমধ্যেই একটি মৃত মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তবে চারপাশে কবিতার নামে যে মহোৎসব চলছিল-চলছে-চলবে, তা তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সুনীলীয় যুগের ইলিউসনে কাতর বাঙালি নব্যকবিকূলের (দু-একজন ব্যতিক্রমকে উদাহরণের অন্তর্গত না করাই শ্রেয়) যে-আবেগ চারপাশে ঘন হয়ে দেখা যাচ্ছে তা শেষযাত্রায় হরিনামসংকীর্তনের আসরে থাকা চোখ-বন্ধ মাথা-দোলানো ভিড়ের ঘোরমাত্র। এর ভবিষ্যৎ কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার হাঘরেপনাতেই শেষ হবে। তাই, দেরি না করে ২০১৪ সালেই ‘বিবক্ষিত’-তে এই বিষয়ে একটি লেখা প্রকাশ করি, শিরোনাম ছিল – ‘কবিতা ও পাঠক : একটি মৃতপ্রায় মাধ্যমের আখ্যান’। সেই থেকেই সৈয়দ কওসর জামাল সাহেবের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয়। ডানা জোইয়ার ‘ক্যান পোয়েট্রি ম্যাটার’-এর অনুবাদক ও ‘কবিতা ও পাঠক : একটি মৃতপ্রায় মাধ্যমের আখ্যান’ প্রবন্ধের লেখক সৈয়দ কওসর জামালের অন্যান্য বহু লেখার – বিশেষ করে কবিতা – সঙ্গেও ধীরে-ধীরে পরিচিত হই। তাঁর কীর্তি ও প্রতিভা মুগ্ধ করেছিল তখনই।
তাঁর সদ্য-প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ ‘ফরাসি কবিতা ১৯৫০ – ২০০০’ সম্প্রতি হাতে পেলাম। কবিতা আমি সবিশেষ আর পড়ি না। কেননা জঞ্জালের পাহাড় সরিয়ে পুষ্প উদ্ধারের জন্য বেহিসাবি সময় আর মহানুভব ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। এই বইটিও পড়তাম না, যদি-না বইটির শিরোনামে ‘১৯৫০ – ২০০০’ সময়কালটি লেখা থাকত। অতীত ঘৃতঘ্রাণে নিমজ্জিত বাঙালি জীবনের অবক্ষয়ের সময়ে শিরোনাম-উল্লিখিত সময়কালটিই আমাকে বাধ্য করেছে বইটির পাতা উল্টে দেখতে, পড়তে। ‘সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত’ হোক অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অন্য দেশের কবিতা’ – তারপরে সম্ভবত এই বইই প্রথম যা আবার আমাকে বিদেশি কবিতার অনুবাদ পড়িয়েছে। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, কবিতা হল সেটাই যা অনুবাদে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই বইতে কবিতা রূপান্তরিত হয়ে উন্মোচিত হয়েছে অন্য সত্তায়, অন্য আরেকটি কবিতায়। সুতরাং এ-বিষয়ে জামাল সাহেবকে কুর্নিস জানাতেই হয় যে তিনি ফরাসি কাব্যের আত্মাটিকে বাংলা ভাষার শরীরে জাগ্রত করতে পেরেছেন।
প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাসের অনুবাদ করা ও পড়া একরকমের ব্যাপার কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এই অনুভূতি একেবারে আলাদা – বিশেষ করে যখন একজন কবির দ্বারা সেই অনুবাদ গ্রন্থরূপ লাভ করে তখন। বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের ফরাসি কবিদের ভাবতত্ত্বের সঙ্গে যখন একজন সমসাময়িক বাঙালি কবির আবেগ ও কাব্যভাষা একত্রে জারিত হয় তখন কবিতা যে-অনন্য রূপধারণ করে তাকে ভাষায় প্রকাশ করার আনন্দের চেয়ে অনুভব করার উল্লাস অন্তরে আরও তীব্র হয়ে জেগে ওঠে। কবিতার সঙ্গে সময়ের সংস্কৃতি অন্তর্লীন হয়ে থাকে। রামায়ণ-মহাভারত যেমন একটি সময়কালকে নির্দিষ্ট করে, তেমনই তুলসীদাস-মীরা ধারণ করেন ভক্তি আন্দোলনের স্পৃহাকে। অথবা বাইবেল ও খ্রিস্টানিটির ভাবধারাকে কেন্দ্র করে যেমন থাকে মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ তেমনই বুদ্ধের ভাবস্পৃহায় জারিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ বা ‘পূজারিণী’ ইত্যাদি। আর এই সবই হল আসলে স্থানকালের শব্দরূপ। নানান দেশের নানান স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, অন্যতর বিশ্বাসবোধ, প্রথা ও প্রভাবের ভাষ্যরূপ। এগুলিকে মিলিয়ে মিশিয়ে একত্রে গ্রহণ করেই তো মানুষ আরও উন্নত হতে থাকে। ফলে যুগ-যুগ ধরে সে মহাদেশ-মহাসাগরের সীমানা অতিক্রম করে ছুটেছে নতুন নতুন দিগন্ত উদ্ভাসনের নেশায়, আর তারপরে সমস্ত অর্জনকে সে প্রকাশ করেছে অনুবাদের ভাষায়। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্য এক সময়ের অন্য এক সংস্কৃতিকে আরেকটি অন্য সময়ের সংস্কৃতির সামনে প্রকাশ করেছে এই বই। একে ধারণ করতে পারাই এক বিরাট সাফল্য।
কবিতা রচিত হয় মূলত দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে – এক, ভাব ও ভাবনার সম্প্রচার; দুই, বোধের প্রজ্ঞাপন। কোনো পাঠকের সঙ্গে যখন এই উদ্দেশ্যগুলির যথোপযোগী সংযোগস্থাপন সম্পূর্ণ হয়, তখনই সেগুলি বহুমাত্রিকতা লাভ করে। এতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে, আবার একটুও সময় নাও লাগতে পারে অথবা এমনও হতে পারে যে কোনোদিন সংযোগস্থাপন সম্ভবই হল না। এই প্যারামিটারগুলির ভিত্তিতেই কবির প্রতিষ্ঠা নির্ধারিত হয়। কবির অন্দরমহলে থাকা নন্দনতত্ত্বের ধারণা থেকে কল্পনার মহাকাশ ও আবেগ যখন পরিস্রুত হয়ে পাঠকের ভিতরমহলে প্রবেশ করে তখন এক অনবদ্য আবেশ মূর্ত হয়। সেটিই উন্মোচিত করে অস্তিত্বের অন্যসত্তাকে। ফরাসি কবিদের নিজস্ব ভাব, ভাষা ও শৈলীকে বাঙালির পক্ষে গভীরভাবে উপলব্ধি করা কঠিন, যতক্ষণ না তাকে বাঙালির ভাববিশ্বের অন্তর্গত ভাষার অর্থে লীন করা হয়। বাঙালির সঙ্গীত, নির্দেশক, দ্যোতনা, প্রতীক, রূপকল্প, ভাবনা ও অনুভবের জারণে যখন ফরাসি চৈতন্য একীভূত হয় তখন ভেঙে যায় কাঁটাতারের বেড়াগুলি। যে-অনুবাদক এই কাজটি নিপুনতার সঙ্গে সময়ের অপেক্ষা না করে সেই মুহূর্তেই সফলভাবে করতে সক্ষম হন তিনিই তখন হয়ে ওঠেন সেই সব ফরাসি কবিদের বাঙালিসত্তার সাকাররূপ। সামঞ্জস্য, গাঢ়তা, গভীরতা ও কাঠামোগত টানাপোড়েনকে যথার্থভাবে এই বইটিতে সৈয়দ কওসর জামাল বিকশিত করেছেন ও তিনিই যেন হয়ে উঠেছেন কখনও বুশে, কখনও দুপ্যাঁ, কখনওবা ভেলতের আবার কিঁতানও।

স্বতন্ত্র ভারতীয় কবিতাকে যে-রূপ, রস, অলংকার, রীতি, গুণ-দোষ, বক্রোক্তি, স্বভাবোক্তি, ঔচিত্য ও ধ্বনিবিন্যাসের স্রোত ও সমাপতনের দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয়, অনুবাদিত কবিতাকেও সেই নিক্তিতেই বিচার করা যাবে কিনা তা আমার অজানা। কেননা আমি সামান্য পাঠক মাত্র, পণ্ডিত বিশেষজ্ঞ নই। ফলে সেই দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনা করা আমার কাছে নিরর্থক, সত্যি বলতে কী, আমি সেই কাজে অযোগ্যও বটি। আমি শুধু বুঝি কবিতার নান্দনিকতা থেকে উৎসারিত আনন্দের লহরি ও তার সৃজন, অভিব্যক্তি ও স্বীকরণের সৌসাদৃশ্য থেকে উন্মোচিত আবেশের দ্যোতনাকে। সেখানে জ্ঞাপনবাদ, উন্মোচনবাদ ও স্বজ্ঞালব্ধবাদের জ্ঞানাত্মক প্রতর্কই মূল সুর হয়ে যদি চিরন্তন লোকোত্তরবাদকে নির্দেশ করতে সক্ষম হয়, আমার কাছে তখনই তা শ্রেষ্ঠতমের স্বীকৃতি অর্জন করে। সেই অর্থে এই বই অবশ্যই শ্রেষ্ঠ। অনুবাদিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশিরভাগ সময়েই আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেক মূল কবিদের ভাববিশ্বে প্রবেশ করতে হয়। সেটা অনুবাদকের ও অনুবাদের গুরুত্বকে হ্রাস করে মূল কবিদের কীর্তিকেই প্রতিষ্ঠা করে। সেই ভঙ্গি এখানে গ্রহণ করলে বইটির বিচার সঠিক পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে বলে মনে হয়। তাই সেটিকে উপেক্ষা করাই শ্রেয়। অনুবাদের ক্ষেত্রে শুধু এটা দেখাই জরুরি যে, যে-স্থানকালের অনুভূতিকে মূল কবিরা ব্যক্ত করেছেন নিজস্ব আঙ্গিকে, অনুবাদক সেই ভাবস্পৃহাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই তাকে তাঁর নিজস্ব বোধের ইঙ্গিতময়-ব্যঞ্জনাময় আখ্যানে অনুবাদিত করতে পেরেছেন কি না! যদি তিনি তা পেরে থাকেন তাহলেই বলা যাবে আঞ্চলিকতার বৈশ্বিকরূপ সেখানে ঐতিহাসিক প্রতিপাদ্য ও বিবৃতির সংগ্রহকল্পে বৈধতা লাভ করেছে। সেখানেই অনুবাদকের সাফল্য ও সার্থকতা। সেই বিচারে এই বই অবশ্যই সফলভাবে উত্তীর্ণ।
‘ফরাসি কবিতা ১৯৫০ – ২০০০’ – বইটি অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবেই সংস্কৃতি-নির্দিষ্ট কাব্যত্বকে ভিন্ন আরেকটি সংস্কৃতির উপলব্ধিতে নিয়ে গিয়েছে ও পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে বিশ্বের কিছু শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও ভাবনার দলিল। এখানে প্রবেশ করতে হলে পাঠককেও অতিক্রম করতে হবে সাধরণত্বের স্তর, আচ্ছন্ন হতে হবে নিবিড়তার বিশ্বরূপদর্শনের আকাঙ্ক্ষায়। তবেই নাগাল পাওয়া যাবে বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাসি কবিতার দ্রবণে সিক্ত বাঙালি কবির ভিতরকণিকার পারমাণবিক অবস্থানের। তখনই ভাস্বর হবে বইটির প্রকৃত স্বরূপ। পাঠক যদি সেই স্তরে না পোঁছোন তবে তিনি বঞ্চিত থেকে যাবেন এক অমোঘ রসের পরাকাষ্ঠা থেকে। জামাল সাহেবের এই অমূল্য অবদান বাংলা সাহিত্যের একটি হীরকখন্ড হয়ে থেকে যাবে – এই প্রত্যাশা যে নিরর্থক নয় তা বইটির দ্বিতীয় সংস্করণই বুঝিয়ে দিয়েছে। নিঃশেষিত হওয়ার আগেই তাই সংগ্রহ করে নেওয়া উচিত হবে, এটাই আমার মতামত।

অন্যান্য তথ্য–
ফরাসি কবিতা ১৯৫০-২০০০, অনুবাদ – সৈয়দ কওসর জামাল, প্রকাশক – ভাষা সংসদ, মূল্য : ১৭০.০০

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *