পরবের কুড়মি ও কুড়মির পরব

পরবর্তী অংশ

★পরবের কুড়মি ও কুড়মির পরব ★

                                     গৌতম মাহাতো

                   

জিতা : 
            এই উৎসব প্রধানত ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমী তিথিতে হয়। এটি মূলত সধবা বিবাহিত মহিলাদের সন্তান কামনার্থক উৎসব। বিশ্বাস সন্তানহীন মহিলারা এই ব্রত পালন করলে সন্তান লাভ করে থাকেন। এর আচার অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট রয়েছে এবং এর কিছু জনশ্রুতিও পাওয়া যায়। তবে সে সব অর্বাচীন জোরপূর্বক সাযূজ্য খোঁজা বলেই মনে হয়।

                                                 
জিহুড় : 
         জিহুড় পরবের জল-জঙ্গল-জমিন কেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় গুরুত্ব অপরিসীম। এই উৎসব আশ্বিন মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয়। জিহুড় স্বাদ ভক্ষণের আদলে অনুষ্ঠিত হয়। জিও + হড় এই দুটি শব্দের সমাবেশে জিহুড় শব্দের উৎপত্তি। জিও অর্থাৎ বাঁচা (হিন্দী) আর হড় অর্থাৎ মানুষ। এই সময় আমন ধানের ভেতর দুধ আসে। এটি কৃষিজীবি মানুষের কাছে নিতে আসে এক অনাবিল আনন্দের বার্তা। আর সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হল এই জিহুড়। এই উৎসবেরও একটি নিজস্ব আঙ্গিক রয়েছে।

বাঁদনা :  



          বাঁদনা উদযাপিত হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যায়। বাঁদনা শব্দটি এসেছে বন্দনা থেকে। এই উৎসব গৃহপালিত গো উৎসব। কুড়মি সমাজের এটি একটি একক উৎসব।
অমাবস্যার দিন পরিবারগুলিতে ভোর থেকে শুরু হয় ‘ঘাওয়া’। অর্থাৎ ঘরে সংস্কার পরিচর্যা। মাটি লেপা, দেওয়াল প্রলেপন, দেওয়াল চিত্রন ইত্যাদি। এদিনেই নানান ধরনের পিঠে প্রস্তুত করা হয়। তাই প্রচলিত এই দিনটিকে ‘পিঠা করা’-ও বলা হয়। সন্ধ্যাবেলা করা হয় কাঁচি দুয়ারি। চাল গুঁড়ির ঢেলা বানিয়ে শাল পাতায় কার্পাসের ইয়ুলো তেলে ভিজিয়ে সলতে মত করে চৌকাঠে জ্বালিয়ে দিতে হয়। গৃহকর্তা শুদ্ধ হয়ে নতুন ধুতি পরে গোয়ালে গিয়ে শিরি-গাই শিরি-বলদের শিঙে তেল মাখিয়ে গোহালের ধন্নাতে (কড়িকাঠে) শিকায় জাগর হাঁড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। কুড়মিদের বিশ্বাস এদিন ভগবান রাত্রে এসে ঘরে গোরুদের পরিচর্যার নমুনা দেখে যান। ভোর রাতে আসে ধাঙড়্যা। গ্রামের কিছু চেলে সারারাত জুড়ে এই ধাঙড়্যার ভূমিকা পালন করে। সঙ্গে চনে মাঙন।
অমাবস্যার রাতে ধাঙড়্যা ছেলে যুবকের দল আহিরা গান গাইতে গাইতে ধামসা মাদলের সহযোগে গৃহস্থের ঘরে ঘরে গিয়ে গরু জাগিয়ে দিয়ে আসে। গৃহস্থ ধাঙড়্যার দলকে পিঠা খাইয়ে আপ্যায়ন করে।
অমাবস্যার পরের দিন গরয়্যা (গোয়াল পূজা)। এদিন প্রতিপদ। গৃহকর্তা ভোর থেকে উঠে আঙিনা উঠোন পরিস্কার করে গোবর ছড়া দিয়ে গরয়্যার নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখে। গৃহকর্তা যায় পুকুর বা জলাশয় থেকে গরয়্যা ফুল (শালুক ফুল) সংগ্রহ করতে। সেখানেই ফুল সংগ্রহ করে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ফিরে এসে গোয়াল পূজা করে। কেউ কেউ ঘরে বলিও দেয়। বলি দেওয়া হয় কুঁদরা ঠাকুরের জন্য। কালো মোরগ, পাঁঠি ছাগল (কুমারী) ইত্যাদি। নৈবেদ্যে থাকে একটি বিশেষ উপকরণ , নতুন তৈরি উনুনে ঘি এর পিঠে। সন্ধ্যাবেলা গৃহকত্রী নতুন শাড়ি পরিধান করে মুখে পান নিয়ে শিরি-গাই ও শিরি-বলদকে বরণ করে ধানের তৈরি মোড় পরিয়ে সুসজ্জিত করে তোলে। শিং এ মাখিয়ে দেওয়া হয় সরষের তেল ও সিঁদুর। যে মাটির প্রদীপটি দিয়ে বরণ করা হয় সেই প্রদীপটি কুলহি মুঢ়ায় (চৌরাস্তার মোড়ে) বাঁ পায়ের ফাঁকে তিনবার ঘুরিয়ে ভেঙে ফেলা হয়। এই রীতিটিকে বলা হয় ‘পছা ভাঙা’।
পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয়ার দিনটি হল বাঁদনা। দুপুরে আঁকা হয় চোক পুরা নামের এক বিশেষ আলপনা। পাইন্যাহ লতার (Cissus adnata) রস চালগুঁড়ির সাথে মিশিয়ে এই আলপনা দেওয়া হয়। মূল দরজায় গোবরের ঢেলা রেখে তাতে ফুল গুঁজে রাখা হয়। শিরি-গাই ও শিরি-বলদকে বরণ করে শিং এ তেল সিঁদুর মাখিয়ে হলুদ জলে পা ডুবিয়ে ঐ ঢেলা ডিঙ্গিয়ে গোয়ালে তোলা হয়।
বিকেলে অনুষ্ঠান আকর্ষণীয়। এঁকে বলা হয় গরু খুঁটান বাঁ কাড়া খুঁটান। বাগাল বা রাখালরা তাদের সেরা গবাদিকে সাজিয়ে কুলহিতে (গ্রামের রাস্তায়) খুঁটি পুঁতে বিশেষ কৌশলে বেঁধে দেওয়া হয়। আহিরা গান গাইতে গাইতে গ্রামের যুবকরা তার সামনে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা গরু বাঁ কাড়ার চামড়া নিয়ে অঙ্গভঙ্গী করে। সঙ্গে চলে ধামসা মাদলের সুরেলা বোল। এটি মূলত বাগাল বাঁ রাখালদের আদরের গবাদির সাথে খেলা, আনন্দ উৎসবের দিন। তারা গায় –
১) “ অহি রে- কেকরা সিরজল রে দিয়য়া
     কেকরা সিরজল বাতি রে
     কুমহরুকে সিরজল দিয়য়া
     ধোবিয়াকে সিরজল বাতি রে।। ”
২) “ অহি রে- জাগহু ইসরু হো মহাদেব
     জাগাহু ঘরাকর দেবা হো
     দুধে ঘি-এ জাগহু ইসরু হো মহাদেব
     গন্ধ ধূপ জাগু ঘরক দেবা হো ।।”

টুসু পরব : এই পরব পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তির দিন। এই উৎসব এখন আর শুধুমাত্র কুড়মিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই উৎসব এখন সারা বাংলার উৎসব। কুড়মি লোকজীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনী সবথেকে বেশী ধরা পড়ে যে গানে তা হল টুসু গান।

অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লেপে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়।

পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে মেয়েরা গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি তৈরী করে সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে গান করতে করতে সারা রাত পৌষ আগলায়। এই পৌষ আগলানো মানে ফসল আগলানো। খেতে পাকা ফসল, পুরুষেরা রাতে সেখানে পাহারায় ফসল আগলানোতে ব্যস্ত। মেয়েরা তাই গৃহের রক্ষক, একা রাত জাগা যায় না। তাই দলবেঁধে উৎসব।

টুসু ঘরের মেয়ে, ফসল লক্ষী। তার কাছেই যত আবদার, অভিযোগ, তার কাছেই আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ ঘটে।

  “উপরে পাটা নীচে পাটা
    তার ভিতরে দারোগা
    ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও
    টুসু যাবেন কলকেতা
    টুসু যাবেন কলকেতা
    খিদে পেলে খাবেন কি?
    আনগো টুসুর নতুন গামছা
    জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি।”

রাত পোহালে আসে মকর।

   “টুসু আমার চিন্তামণি
    মাটির কথা শোনে,
    ঘাম পথে আসে মকর
    আমাদের ফাগুনে।”

গানে গানে টুসু নিরঞ্জন। রঙীন সুদৃশ্য চৌড়লে চাপিয়ে টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বড়ো জলাশয় বা নদীতে। সবেধন নীলমণি কন্যারত্নটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার সময়, গ্রাম্য রমণীদের সে কি শোকবিহ্বল চেহারা! অশ্রুসিক্ত বদনে তখন সেই মন খারাপের গান-
“আমার বড়ো মনের বাসনা,
টুসুধনকে জলে দিবো না।”

মোট কথা জঙ্গলমহল জুড়ে চলে সারা বছরের উৎসব বাতাবরণ। এই আনন্দ এই নেগাচার কুড়মিদের রন্ধ্রে রক্তে মজ্জায়। এর কোনও লিপিবদ্ধ নিয়মাবলীও নেই। নেই বাধ্যবাধকতাও। তবুও তারা হৃদয়ের টানে মেতে ওঠে উতসবগুলিতে। এই উৎসব চলে আসছে পুরুষানুক্রমিক।

                   
                       ★★★★★★★★

তথ্য ঋণ :: ১) ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ – পশুপতিপ্রসাদ মাহাত
           ২) মানভূম সংস্কৃতি – ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত
           ৩) ঝাড়খন্ডের লোকসংস্কৃতি – রাধাগোবিন্দ মাহাত
           ৪) ঝাড়খন্ডের লোকসাহিত্য – বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত
           ৫) লোকায়ত ঝাড়খণ্ড – বিনয় মাহাত
           ৬) ভারত সংস্কৃতি – সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
           ৭) ‘লোককবি’ ভবতোষ সৎপথী
           ৮) মানভূমের আদিবাসী লোকদেবতা – ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত
           ৯) ছবি ও ভিডিও ঋণ ঃ কৌশিক মাহাত

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *