ম য়ূ রী মি ত্র-র গল্প
যা যা সে কোন দেশে
একঃ
বছর কয়েক আগে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম৷ ফেরার পথে এক মাঠের ধারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল আমাদের গাড়িটা ৷ নির্জন জায়গা৷ লোকজন কেউ নেই৷ কেবল একটি নিচু ঢালা জায়গায় অনেক গাছ ৷ তারা সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে৷ দামাল হাওয়া প্ররোচনা দিচ্ছিল৷ ভিড়ে গেলাম গাছের দলে৷ কী জোর জোর হাওয়া বইছিল রে বাবা৷
গাছগুলো দুলছিল একই কাতে৷ গাছে গাছে ঢেউ৷ ঢেউয়ের টুকরোগুলো দেখতে দেখতে তীব্র এক বাসনা জন্মাচ্ছিল আমার৷ নদীমানবী হওয়ার৷ চারদিকে একবার দেখে নিয়ে চুপিচুপি হাওয়ায় হাত দুটোকে দোলাতে লাগলাম৷ যেন বাতাসের বয়ে যাওয়াটাকেই হাত দিয়ে কেটে কেটে চলছি ৷ পাড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেইকো৷
অথচ দেখুন – কী আশ্চর্য! কোথাও একটা ডোবা পুকুর অব্দি নেই৷ কেবল গাছ আর গাছ৷ বেগবান এক গাছনদী৷ একটি মাছরাঙা পাখির অপেক্ষা শুধু৷ তাহলেই আমার উটকো কল্পনানাচের ষোলকলা পূরণ৷ মাঝে মাঝে এমন হয় আমার৷ যা আমার ধারেপাশে আগেপিছে কোথাও নেই, ভেবে মরি তাকেই৷ আকাশ অব্দি লম্বা করে ভাবি৷ মাঠের মত চওড়া করে ভাবি৷
আর একবার ভয়ানক গরম৷ জঙ্গলে ঘুরছি তার মধ্যেই৷ রোদ জায়গায় জায়গায় বলয়ের মতো ঘিরছে আর ড্যাবা চক্ষে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ চারদিকে মজুর শ্রেণির মায়েরা কাঠ কাটছে ঠকঠক৷ গা পিঠ ভর্তি শ্রমের জল৷ এহেন জঙ্গলের মাঝে একপাশে পড়ে একটি আধভাঙা নৌকো৷ কাছেপিঠে কোনো নদী কোনোদিন ছিল বলে মনে হল না৷ যাঁরা কাঠ কাটছিলেন তাঁরাও বললেন –অনেকদিন ধরে নৌকাটা অমন স্থির পড়েই আছে৷ একসময় গোধূলি চক্কর দিল মাথায়৷ দেখলাম আলো ছায়ার একটা কাঁপা ভাব জাগছে নৌকোর পাটাতনে৷ আমার কেমন মনে হল –নৌকোটা এবার চলবে৷ চলবে এবার তৃষ্ণার্ত শ্রমিকগুলোকে নিয়ে ৷ তাদের কাঠকাটার পেশাটির সমাপ্তি ঘটিয়ে জলপদ্ম তোলার আরাম দেবে এ নৌকো৷ জলীয় হাওয়ায় তাদের হাক্লান্ত শরীরে কাম জাগবে টগবগ করে৷ শুকনো জঙ্গলটাকে এবার বহমান নদী করে দেবে পরিত্যক্ত জলযান৷ অনেকদিন চলেনি সে৷ তাই বয়ে যাবার ভয়ানক বাসনায় থরথর কাঁপছে যে নৌকোটা৷ ক্যাচ শব্দ উঠছে৷ সাথীরা ফ্যাকফ্যাক হাসছিলেন –কাঠকাটা মা মেয়ে ঠোঁট ওল্টাচ্ছিলেন আমার কথা শুনে৷ তবু মানতে পারিনি –নিভু সূর্যের আলো ও জংলী হাওয়া আমার দৃষ্টি ও শব্দবিভ্রম ঘটিয়েছিল৷
না –নৌকো চলেনি৷ শান্তিনিকেতনের মাঠ বা পাথর ভরা জঙ্গল নদী হয়নি৷ হয়ত মা ধরিত্রী শেষমেশ মরু হয়ে যাবে এই ভয়েই বয়নি আমার কল্পনার জল কিংবা জলযান৷
আমার এই এত দ্রুত positive থেকে negetive এ চলে যাওয়া দেখে সক্রেটিস হাসেন –ওহে ভাই কখনো না কখনো যা ছিল এই ধরায় তাই তো কল্পনায় বুনবে তুমি! এ বিশ্বে যা কোনোদিনও নেই, কোনদিন হবেও না, কেমন করে তা কল্পনায় আসবে তোমার? কল্পনা যখন করেছ তখন কোথাও না কোথাও আছে তোমার জলস্রোত –জলযান –জলের ফুল৷ তুমি কেবল মন দিয়ে তোমার ইচ্ছেটাকে চেন৷ তারপর তোমার কল্পইচ্ছায় গড়ে নাও এক মেছো মেয়ে৷ কামনা কর –সন্ধেতে গৃহস্থ যখন কাজ শেষে খাদ্য নিয়ে ঘর যায় তখন সে যেন তার আধা মাছের শরীর নিয়ে আহ্লাদে ঝাপট খায়৷
দুইঃ
ভোরেই জ্বলেছে উনুন। এক সসপ্যান দুধ ফুটছে। আর তাতে মলটোভা গুলছেন পিসিমনি। ওই দুধ ফোটা আর প্রাণপণ চামচ নড়ার শব্দে সকালবেলা আমার ঘুম ছাড়ত। উঠেই কী যে আনন্দ হতো আমার। দেখতাম কত না— নতুন মানুষে ভরেছে আমাদের ভাড়াবাড়ির ঘর!
হয়েছে কী— আমার সেই শিশুকালে আমাদের বাড়িতে বাস করতেন ওবাংলা থেকে আসা অনেক কাকা অনেক পিসি। আমার ছোট্ট মাথায় সবার সব মুখ ধরে রাখতে পারতাম না। প্রায়ই এক কাকার শরীরে অন্য কাকার মুখ বসিয়ে ফেলতাম। রাতে ঘুমের ঘোরে আরো গোলাত সব। শরীরের ওপরের মুখ বা মুখের তলার শরীর।
দেশভাগ তখন লম্বা এক জোঁক হয়ে ঘুরছে দু’দেশে। প্রতিদিন সীমা ডিঙিয়ে কেউ না কেউ এসেই যেত। ঘুমচোখে এপার ওপার সব ভুল হত। একটি বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড় এত ভালো লাগত মনে হতো, সবাই- কাকা পিসিরাই আজ বুঝি প্রথম এলেন বাড়িতে। আমার খোকাচোখ পুরানোকেও নতুন বানিয়ে ছাড়ত। বাচ্চা চাষীর ঝুড়িতে তখন কেবলই নতুন ফসল।
ঠাকুরদা নিয়ম করলেন জলখাবার সবার একরকম হবে। মনে আছে,একটা প্রায় অন্ধকার প্যাসেজে সার দিয়ে কাকা পিসিরা অনেকখানি চিনিগোলা চায়ে বাসি রুটির গোছা চুবিয়ে খাচ্ছেন। কাপে চা কম থাকতো বলে একসাথে দুটো করে রুটি চোবাতেন। কাকাদের সমান খাবো বলে আমিও ঐরকম চায়ে চোবানো চারটে করে রুটি খেতে শুরু করলাম। ছোট্ট পেটটা আমার শক্ত বাতাবি লেবু হয়ে যেত। তবু ভারী লজ্জা “বেবি দুধ” খাওয়ায়। সেটা কতটা দুধ খাব না বলে আর কতটা খাদ্যব্যবস্থায় সাম্য আনব বলে তা বলতে পারি না। তবে সসপ্যানের সব দুধ আমার গর্ভে গেলে কাকাদের চায়ে যে দুধ মোটেই পড়বে না সে বেশ বুঝতাম।
ভাড়াবাড়ির তিনটে মাত্র ঘরে অনেক মানুষের সাথে ঠেসে থাকতে থাকতেই ভালোবাসা চেনা শুরু হলো আমার। সেবার ক্লাসে পড়া পারিনি বলে খুব মার দিলেন আমার এক ওবাংলার পিসি সুতপা। সবে খুলনা থেকে কলকাতায় এসেছেন। ভালো চেনা না হলেও ভালোবাসাটা দ্রুত হয়ে গিয়েছিল আমাদের। মার খেয়ে সারাদিন আমি কথাই বলিনি পিসির সাথে। দিনভর গজগজ করছিলাম নিজের মনে। সন্ধেতে শুনেছিলাম সমস্তটা দিন জল অব্দি খাননি সুতপা। রাতে মা খাবার সাজিয়ে দিলেন আমাকে আর পিসিকে। পরিষ্কার শুনলাম পিসিকে বলছেন, ”বেশ করেছিস। আবার পড়া না পারলে আবার মারবি।”
রাগী মুখে সুতপার দিকে আড়ে দেখতে দেখতে খেয়ে যাচ্ছি গপাগপ। বোধহয় সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন কলকাতার পিসি অপর্ণা— এসে বসে গেছেন আমাদের পাশে। কী যেন একটা লুকিয়ে রেখেছেন না পিঠের দিকে? মারামারি করে দেখল— MA ক্লাসের দিস্তা নোটের খাতায় আমার জন্য লিখে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের ভাবসম্প্রসারণ। কাল যা ক্লাশে মুখস্থ বলব আমি।
আর তারপর? সুতপা আর অপর্ণা তাঁদের চারটে হাত ক্রস করে ফেলেছেন। ভাবছি কী বানাবেন এঁরা জোড়া জোড়া হাতে? ওমা! এ যে দেখি একটি হাতপালকি। ব্যাস! হাতগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পা গলিয়ে আমি উঠে পড়লাম আমার পালকিগাড়িতে। ওঠবার স্টাইল দেখে তখন কে বলবে সেটা পালকি না পক্ষীরাজ! পালকি তখন ঘোড়ার গতিতে ছুটেছে! টগবগ টগবগ! এদেশ। সেদেশ। নানাদেশ। কত দেশ–কত্ত।
পিসিমায়ের একটি দীপে আলোয় ভর্তি ভূখণ্ড। সীমানা ছাড়ায়ে। দুকূল হারায়ে। প্লাবিত।
★★বিশ্বকবি— লেখাটি তোমায় দি? তুমিই তো বেশি কেঁদেছ , বাংলা যাতে ভাগ না হয়। সে নিরুচ্চার কান্না টের পাই। তাই তোমাকেই।
★★ আছে পুনশ্চ: যে সব কীর্তিমান বাবা মা মানুষ ভরা পরিবার ভেঙে বাচ্চার মন-মগজের দফায় রত তাঁদের ”ভীষণ দরকারি” ঠোক্করটাও মারলাম৷
তিনঃ
রাতে আজ বেশ গর্মি পড়েছে, দেখছি। সল্টলেকে আমার ঘরখানার পিছনের আমগাছ থেকে পাখির মিঠি মিঠাই ডাক শোনা যাচ্ছে। উফ! কতরকম পাখির যে কতসব শব্দ। প্রত্যেক পাখির ডাক তার নিজের ধরণে। আলাদা। আবার আলাদা হয়েও এক। একযোগে যেন একখানা গানেই সুর লাগিয়ে চলেছে পাখির দল। পরপর। ঘরের পাশেই একটা ছোট বারান্দা। আলো হাওয়া একদম আসে না বলে পশ্চিমা বারান্দাটাকে কেউ বিশেষ পাত্তা ফাত্তা দেয় না। নিজের মনেই একা পড়ে থাকে সে। সারাটাক্ষণ। এখন আমি এসে দাঁড়াতেই নির্জন ব্যালকনি দেমাকে ফাটলো। ওমা দেখি কি, আমগাছ ছেড়ে রাতের কুচোকাচা পাখিগুলো সব বসে আছে বারান্দার আলসেতে। “ওরে ব্যাটা! তাই ঘর থেকে এত আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল? আমি ভাবি কে না কে সশব্দ করে দিচ্ছে আমার নিঝুম রাতকে? তোমরা?–তাই বল!” ভেংচি কাটে ময়ূরা! গর্মি রাতে ঝিরঝিরে বাতাস ওড়ে। পাখি রে –তোরা তবে কাল উড়িস! কাল ভোরে। কেমন? বকফুল আনবি ই ই ই।