গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(দশম পর্ব)”

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র দশ পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(দশম পর্ব)

অপু, দাদা শম্ভু  ও অন্যান্যরা

 

“Courage!” he said, and pointed towards the land, “This mounting wave will roll us shoreward soon.” The Lotos Eaters, Tennyson

আর একটু বড় হয়েছি। তখন হোষ্টেলে থাকি। আমি, নুনা,দাদা পড়ালেখা করছি। আট ন’ ক্লাস হবে তখন। শম্ভু দু তিন ক্লাস অব্দি পড়েছিল। আর এগোয়নি। ছোট নৌকার পারসে জাল, বেড়া জাল চরপাটা ইত্যাদি ক’রে রোজগার শুরু করে দিয়েছে। আমাদের সংগে ওর দেখা হয় না অনেক দিন ক’রে। আমরা সপ্তাহের শেষে বাড়ি ফিরে দেখতুম শম্ভু নেই। সে নৌকায় গেছে। আবার ও যখন নৌকা থেকে ফিরে আসত, দেখত আমরা নেই। রাস্তা আলাদা হ’লে এই সমস্যা। সব রাস্তার মোড়ে, বাঁকে যে সবার দেখা হবেই এমন কোন নিশ্চয়তা থাকে না। বরং দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু রাস্তা আলাদা হলে তো আর প্রাণের টান চলে যায় না! হয়তো সব রাস্তায় সবাই হাঁটতে পারে না। শম্ভুর গায়ে তাকত ছিল, মনে সাহসও ছিল দুর্বার। তাই হয়তো সে কঠিন পথ বেছে নিয়েছিল। আজ যখন বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি, যখন জীবনের অনেকটা রাস্তা এগিয়ে এসে একটা জংশন খুঁজছি, তখন নিশ্চিত করে মেনে নিই, শম্ভু যে পথ নিয়েছিল তা ছিল দুঃসাহসিক। এই দুঃসাহসিক পথ ধরেই একটা জাতির মুখে অন্ন জোটে, এই প্রবল প্রতাপান্বিত তাকতের জোরেই না বাকি লোকেরা এত জমিদারি করে! কিন্তু আমাদের দেশে সেই দুঃসাহসিক কাজের মূল্য পায় না নিতান্ত মুখচোরা কাজের মানুষগুলো। যে চাষি চাষ করে বজ্র বিদ্যুৎ নিয়ে, যে বুক চিতিয়ে সমুদ্রের তুফানের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তার গর্ভ থেকে তুলে আনে মনি মুক্তো, তাকে নিয়ে কেউ হৈচৈ করে ব’লে দেখিনি। আমাদের হৈচৈ কে চাঁদে গেল, কে উঁচু পর্ব্বত ডিঙোলো তাদের নিয়ে। অথচ চাঁদ, পাহাড় পেরিয়ে কে কবে দু’মুঠো খুঁদের চাষ করতে পেরেছে? এসব পোকা এখন মাথায় ঘুরপাক খায়। যখনকার কথা বলছি তখন এসব ভাববার মতো সাহস ও বুদ্ধি কোনোটাই ছিল না।
শম্ভু বড় নৌকায় উঠেছে। সে আর ছোট নৌকায় ধারে পাশে নয়, বরং ইঞ্জিন লাগানো ট্রলারে বাইর গাঙে যায়। মাছ ধরে। তখন শীতকাল। পরেরদিন গঙ্গা মেলার ছুটি পড়ে যাবে। হোষ্টেল ফাঁকা হয়ে যাবে। আমরা মকর সংক্রান্তির ছুটিকে বলতুম গঙ্গামেলার ছুটি। ওই সময় গঙ্গা মেলা হয় কিনা। মেলায় যাত্রা পুতুল নাচ ইত্যাদি অন্তত দশ দিন ধরে হতো। তাই আমাদের ছুটিটাও ওই সময় বেশিদিন থাকতো।
যাইহোক, আমার রুমমেট চন্দন এসে বল্লে ” গেটের কাছে একটা টকা দাঁড়িয়াছে। তোর সঙ্গে দেখা করবে বলিয়া”। আমি অবাক হয়ে গেলুম। আমার সঙ্গে আবার কে দেখা করবে? সে বা গেটে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসতে ক্ষতি কি? এক পা দু পা করে গেটের কাছে গিয়ে দেখলুম, গেটের বাইরে দেওয়ালের গা ঘেঁসে শম্ভু দাঁড়িয়ে। একটা ময়লা ট্রাউজার আর পকেট ছেঁড়া একটা জামা পরা। খালি পা। পায়ের নখগুলোতে কাদা লেগে শুকনো হয়ে আছে। “কীরে শম্ভু, তুই? চ’ চ’ ভিত্রে চ’। এখাঁয়ে দাঁড়িয়াছু কেনি?”
শম্ভু একটু ইতস্তত বোধ করলো মনে হয়। বল্লে ” না, আমি ভিত্রে যাবোনি। শুঁ না। আমি বোড় লৌকায় বড়শিতে যাইতলি জাউঁ তো? একটা বোড় শিমুঁ কাঁটা আঁথিলি। তুই,নুনা, দা তো এঠি আছু। আমি মাছ ঘরনু ভাজিয়া তোনকের জন্য লেসসি। লে।” লক্ষ্য পড়ল ওর হাতে একটা নাইলনের পুরনো জীর্ণ ব্যাগ। সে ফিশিং থেকে বাড়ি ফিরেই আমাদের জন্য শিমুল কাঁটা মাছ ভেজে নিয়ে চলে এসেছে। আমি বল্লুম ” ভিত্রে চ'”
না রে
কেন?
তোনকের অঠি সব লোক পড়াশুঁয়া।
তাতে কী হোইচে?
আমার পায়ে জুতা নেই।
তাতেই বা কী হোইচে?
কেউ জিগাস করলে কী কইবু? আমি তোর কে?
কেন? আমার বোন্ধু তুই! সৌটা কইবো। আমান্নে ন্যাংটা বেয়ার বোন্ধু।
ধুর!
মানে? আরে তোনকের এঠি যে বোন্ধু গুআ আছে তান্নে খেরাপ ভাব্বে।
ভাবু। তবু চ। তোর চে বোড়ো বোন্ধু আমার কেউ নেই শ্লা। যে যা ভাবে ভাবু।
শম্ভু ভিতরে গেল। দাদা আর নুনা তো যারপরনাই বিস্মিত হয়ে গেল। বোঝা গেল শম্ভু আসাতে ওদের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা ফল্গু জেগে উঠেছে। সবার চোখ খুশিতে ডগমগ করছে।
জোরজবরদস্তি করায় বিছানার উপর কুণ্ঠাভরে বসল সে। শিমুল কাঁটা মাছের ভাজা বের করলুম ব্যাগ থেকে। কম তেলে ভাজা। শম্ভু একগাল হেসে বল্লে ” টাটকা রে। খা খা। ভাল্লাগবে, হা হা হা”
আমরা তিনজন খেলুম। শম্ভু খেলো না। তাকে সবাই মিলে কত যাঁচাযাঁচি করলুম। কিন্তু সে নিল না। ” আরে আমি লৌকায় সব সমে খাই। অনেক খাই। তোন্নে খা। জাঁউ তো, আমি মনে করতিলি তোন্নে ঘরে আছু। আর পুরা মাছটা লিয়া গাঙধারে ফিস্টি করিয়া খাবো। আগে আগে য্যারকম খাইতি। মনে নেই?”
মনে থাকবে না আবার? আমরা সবাই যে সেই দিনগুলো কে খুব হারাই আমাদের চোখ মুখ সেকথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল।
কাঁটা চিবোতে চিবোতে বল্লুম ” শম্ভু, কালনু আমানকের ছূটি রে, তুই ঘরে রইবু তো? ”
হুঁ, গংগা পূজার গনে বড়শি চলবেনি। লৌকার পূজা হবে।
বাহ! তা’লে তো ভাল হোইল। শুঁ, তুই মন্টু সাউকে কয়া রাখবু। আহ্লাদিকে লিয়া বারিব।
শম্ভু মাথা নাড়ল। “আইজ আইসিরে। একবার লৌকাধারে যাইতে হবে”
শম্ভুকে গেট অব্দি এগিয়ে দিতে এলাম। গেটের বাইরে এসে ও ঘন হ’য়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বল্লাম “শম্ভু, তুই ভাল আছু?”
একগাল হেসে বল্লে “হঁ রে। আইসি আমি। কাল ঘর যাইলে দেখা হবে।”
পরের দিন বিকেলে বাড়ি ফিরেই শম্ভুর বাড়িতে গেলাম। শম্ভুর দেখা পেলাম না। বাড়িতে না থাকলে আর কোথায় থাকবে? গংগাবুড়ির ঘাটে গেলাম। সেখানেও নেই। হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রানীর ঘাটে গিয়ে দেখলুম শম্ভু একটা দড়ি লাগানো হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে পুরানো কৃষ্ণচূড়ার গাছটায় হেলান দিয়ে বসে আছে গাঙের দিকে মুখ ক’রে।
সচরাচর চন্দ্রানীর ঘাটে কেউ আসেনা। চন্দ্রানীর ঘাটের বদনাম আছে। সে কোন কালের কথা! তখন জমিদারি আমল। জমিদারের কাছারী ছিল এখান থেকে এক ক্রোশ উত্তরে। জমিদার থাকতো না। থাকতো তার তসিলদার। লোক লস্কর। পাইক লেঠেলরা। তারাই ভাগচাষের জমিজমার দেখাশোনা করত। কাছারির সম্মুখে ছিল বিশাল খামারবাড়ি। সেখানেই চাষিরা ফসল তুলতো। ঝাড়াই করতো। মালিকের ভাগ রেখে দিয়ে বাকি ফসল ঘরে নিয়ে যেতো। ফসল ঝাড়াই বাছাইর সময় লেঠেলরা দাঁড়িয়ে নজর রাখতো। পান থেকে চুন খসলেই উপায় থাকতো না। জমিদার বছরে এক আধ বার আসতো। খোঁজখবর নিত। আড়ৎদার ডেকে ধান বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে যেতো।
এক পূজার ছুটিতে জমিদারের কলেজ পড়ুয়া জোয়ান ছেলে সময় কাটাতে এই হাড়হাভাতে দ্বীপে এসেছিল। চন্দ্রানী নামে এক গরীব চাষার মেয়ে তার নজরে পড়ে। পরের গল্প যেমনটা হয়। চন্দ্রানী কাছারিবাড়ি গিয়ে জমিদার পুত্রের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিয়েছিল। ক’দিন পর সাহেব চলে যায় কিন্তু চন্দ্রানীর পেটে তার একটা বেওয়ারিশ বাচ্চা রেখে যায়। সেই বেওয়ারিশ বাচ্চা পেটে নিয়ে চন্দ্রানী এখানে একটা গাছে ঝুলে পড়েছিল এক জ্যোৎস্না রাতে, তারপর থেকে চন্দ্রানীকে এই কৃষ্ণচূড়ার তলায় অনেকে কাঁদতে দেখেছে জ্যোৎস্নার মায়াবি সন্ধায়।
আমি শম্ভুর কাঁধে হাত রাখলুম। সে শান্তভাবে মুখ ঘুরিয়ে বল্লে ” আমি ঠিক জাঁই তুই খুজিয়া খুজিয়া এখাঁয়ে আইসবু।” বল্লাম ” কী করুটু একলা বুসিয়া বুসিয়া?”
ভাবিটি
কী ভাবুটু?
একটা মেইঝির কথা।
কে?
লক্ষণ আড়ির ঝিকে চিনু?
হঁ, তুই তার সংগে পিরিত করুটু?
মুচকি হাসলো শম্ভু।
কীরে? ক’
হঁ, পেম করিটি।
মেইঝিটা তো পড়েটে, না?
হুম
কীসে পড়ে জাঁউ?
হঁ, সেভেনে পড়ে।
আচ্ছা।
শুঁ, তোকে একটা কথা কই।
ক’
কাল গৌরির দরেও মাছ দিয়াসসি।
অহ, মেইঝিটার নাম গৌরি? আচ্ছা, তুই যে মাছ লিয়ালু তার বাপ মা কিছু কয়নি?
না তো। মাছ তো লিয়া লিল।
কিছু কয়নি?
হঁ।
কী কইছে?
গৌরির মা গৌরির বাপকে ডাকিয়া কইল ” দ্যাখো,গংগার ব্যাটা মাছ লেসসে। গংগা আমার দরে বারামাসিয়া থাইল। তার ব্যাটা।”
ওহহহহ, গৌরির সংগে দেখা হইল?
হুম।
কী কইল?
মুচকি হাসল শম্ভু। একটু চুপ করে থেকে ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি এনে বল্লে ” গৌরিকে লুকিয়া ২০ টাকা দিছি, আর…”
আর কী?
গৌরি চুমু দিল ঘরের পিছানে আইসিয়া।
শ্লা।বোকা.. তুই তো অনেক দূর…
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক্ষণ। বল্লাম ” উঠ শম্ভু”
শম্ভুর মুখ টা অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার থেকে শুধু ভেসে এল ” ভয় লাগচে তোর? আচ্ছা কিসের ভয় ক’ তো? কত বছর আগে একটা মেইঝি অত্যাচারের পোতিবাদ করতে পারলনি। নিজে দড়ি দিয়া মরলো। আইজ পর্যন্ত কেউ সে অন্যাইর পোতিবাদ করলনি। এখন ভয় করচে মরা লোককে। শুঁ, চন্দানী কিচু করতে পারলে যখঁ বাঁচিয়া থাইল তখঁ করত। যে বাঁচিয়া রইতে কারুর ক্ষতি করলনি সে মরিয়া যায়া করবে? আচ্ছা শুঁ…”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শম্ভুর কথা শুনছি। যেন শম্ভু নয় অন্য কেউ বলছে। অন্ধকারে ভেসে আসছে যেন কোন অতল গহ্বর থেকে। বল্লেম ” হুম্ ক'”
তোর চন্দানীর জন্যে কষ্ট লাগেনি?
লাগে রে।
আমার না ভয় লাগেনি, কষ্ট লাগে। খুব কষ্ট।
শম্ভুর গলার স্বর বসে গেল। বোধ করি এই সন্ধার অন্ধকারে তার গলা থেকে কথা নয়, কান্না বেরোতে চাইছে ঠেলে। শম্ভু আটকে রেখেছে সে কান্নাকে। কারণ আমি জানি, সবাই জানে, শম্ভুও জানে, কান্না সবার গলায় মানায় না।
মুহুর্তে প্রসংগ বদল করে শম্ভু বল্লে ” আহ্লাদিকে লিয়া কাল সকায়ে বারিবো। সকায়ে পান্তা খায়া বারিবো। আমি তুই আর নুনা। নুনাকে কয়া দুবু। ”
আমি কৌতূহলে বল্লেম ” কাই যাবু?”
শম্ভু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বল্লে ” ডুবা চড়ায়। কাল রাত্রে ওখাঁয়ে রইবো।”

°°
জিনিসপত্র সব শম্ভু গুছিয়ে নিয়েছে। জলের ড্রামটা আমি আর শম্ভু দু’জন মিলে ভর্তি করে আনলুম। তারপর নৌকা ছেড়ে দিলুম। আমি আর নুনা দাঁড়ে। শম্ভুর হাতে বৈঠা। জল কাটাচ্ছে নিজের শখে। ছপাস ছপাস করে দাঁড় ফেলছি আমি আর নুনা।শান্ত নদী। এত শান্ত যে পুকুর বলে ভ্রম হতে পারতো। তেমনটা হয় না কাকচক্ষু নীলজলের জন্য। শীতের গাঙ খুব লাজুক হয়। যেন সদ্য বক্ষোন্নত কিশোরী। কী সুন্দর মেপে পথ হাঁটে! কী রাজকীর যৌবন সরল শান্তভাবে দেখিয়ে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ডাকে সব সদ্য কিশোরকে! তাকে ছোঁবার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড আকুলতা অনুভব করে কিশোর হৃদয়! এপারের লবনাম্বু গাছেদের কাছে সে সদ্য যৌবনা লাজুক কিশোরীর পায়ের পাতার ছাপ, গোলাপি ঠোঁটের মতো একফালি খাল বেরিয়ে এসেছে শ্মশান ঘাটের দিক হ’তে। পিঠ অব্দি কালো ঘন চুল ছাড়া ওপারের ঘন লুথিয়ান আর কিই বা হতে পারে তার! আমরা চলেছি ডুবো চড়ায়। একটুখানি একটা চড়া। শীতের সময় জেগে উঠে লুথিয়ানের অদূরে। সমুদ্রের মাঝখানে যেমন নির্জন কার্গুলেন দ্বীপ। গাছ নেই, মানুষ নেই। শুধু একটা চড়া। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে যাওয়া যায়, ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত বেড়িয়ে আসা যায় কয়েক পলকে। লুথিয়ান থেকে কখনো সখনো চড়াটা সার ভাঁটার সময় চোখে যে পড়েনি তা নয়। আগেও অনেকবার ইচ্ছা হয়েছে ওই অচেনা চড়ায় গিয়ে ঘুরে আসি। লোকেরা বলে ওখানে পুরোটাই চোরাবালি। গিয়ে পা নামালেই আমরা জ্যান্ত পুঁতে যাবো। কখনো যাওয়ার চিন্তা সাহসি রূপ পাওয়ার আগেই চড়াটা জোয়ারে ডুবে গেছে। কিন্তু এই ক’ বছরে চড়াটা ক্ষয়ে যায়নি, আত্মগোপনের চেষ্টা করেনি, বরং বালি জমিয়ে জমিয়ে আরো একটু উঁচু হয়েছে। এখন মরা কোটালের সময় জোয়ার ভাঁটা সব সময় দেখা যায় চড়াটাকে। দূর থেকে দেখলে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে মনে হয়। বিশাল জলরাশির মধ্যে একটা ছোট দ্বীপ মাথা তুলে আছে। অন্যরকম লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই দ্বীপের রাজা হ’য়ে যাই।
আড়াআড়ি গাঙ পার হয়ে এখন লুথিয়ানের গা ধ’রে এগোচ্ছি। দূরে ঝন্টু মণ্ডলের নৌকা দেখা যাচ্ছে। শম্ভু হাঁক দিল ” ওওওওওওওও ঝন্টু দা আ আ আ আ আ”
ওদিক থেকে ঝন্টু দা হাত নেড়ে ইশারা করে উত্তর দিল। আর একটু এগিয়ে আরো বাম দিকে জংগলের গায়ে গায়ে নৌকা বাইতে লাগল শম্ভু। ক্রমশ ঝন্টুদা’র নৌকার কাছে এলুম। আমি দাঁড় তুলে ঝন্টুদার নৌকার ডালি ধরলুম। দুটো নৌকা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখলুম নৌকার উপর ত্রিপলের ঘরে সুবোল ঘড়ুইর বৌ মাছ কাটছে। আমি মুখ বাড়িয়ে বল্লুম ” বৌদি, কী রাঁধা হবে?” আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করল ” তুমান্মে কাই যাব ভাই? ”
“ডুবা চড়ায়”, আমি উত্তর দিলুম।
কেনি?
ঘুরতে।
আইজ রইব?
হঁ
তাইলে আমান্নেও যাবো।
তাই?
হুম, ডুবা চড়ায় জাল পাতবো। আসলে কি জাঁও তো, দু’জঁ যাইতে ভয় লাগে।
দুটো নৌকা পাশাপাশি যেতে লাগল এবার। ঝন্টুদা ওই নৌকার হাল ধরেছে। সুবোল ঘড়ির বৌ দাঁড় টানছে। আমি আর নুনা নামমাত্র দাঁড় টানছি। নৌকা শম্ভুর বৈঠাতেই চলছে। নীল জল কেটে কেটে ছপাস ছপাস করে নৌকাদুটো এগোচ্ছে ডুবো চড়ার দিকে।
ডুবা চড়ায় পৌঁছেই নৌকা খুঁটির সংগে বেঁধে রেখে জিনিসপত্র নামানো হল। তাঁবু না বাঁধলে রান্না করা যাবে না। বাতাস আছে। ফাঁকা চড়া। তাঁবু বাঁধলুম। ঝন্টুদাও তাঁবু বাঁধলো একটু দূরে। আলাদা রান্না আর হল না, একসংগেই সুবোল ঘড়ির বৌ সবার রান্না বসালো। পারসে মাছের ঝাল আর ভাত। ওদিকে তাঁবু খাঁটানো হয়ে যেতেই আমি শম্ভু ঝন্টুদা আর নুনা হাতে হাতে পারসে জাল পাতার উদ্যোগ নিলুম। শম্ভুর পায়ে একটা কিছু লাগল জলের তলায়। হাত দিয়ে তুলে দেখল একটা বড় হাড়কাঁকড়া। এখন হাটে বাজারে সাদা সাদা যে মরা কাঁকড়া ডাঁই করে বিক্রী হয় ১০০ টাকা কেজি দরে, ওকেই আমরা হাড়কাঁকড়া বলতুম। আমরা জিন্দেগী কেউ খেতাম না। এসব যে খেতে হয় এই বয়সে এসে জানছি। আমরা তখন এসব যে খাইনি তা নয়, দু একবার যে খেয়েছি সেটা অখাদ্য ভেবেই খেয়েছি। সেদিন শম্ভু জোর করে খাইয়েছিল। নিজের হাতে ঝাল রান্না করে বল্লে ” খায়া দ্যাখ একবার। দারুণ জিনিস রে শ্লা”
তুই আগে খাইছু?
হঁ
তা’লে আমিও খাবো।
সত্যি বলছি খেতে সুস্বাদু কাঁকড়াটা। আসলে এই সেদিন অব্দি লোকে সব কিছু চেহারা দেখে খেত। হাড়কাঁকড়ার চেহারা দেখেই তা যে অখাদ্য এই ধারণা কেমন করে একটা হয়ে গেছিল আমাদের। আমার যুক্তিহীন সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছিল শম্ভু।
সন্ধ্যা নাগাদ জাল তুলে দেখলুম গোটা ত্রিশেক পারসে মাছের সংগে একটা ইয়া বড় পাতাল চিংড়ি জালে লেগে আছে। পাতাল চিংড়ি আদৌ চিংড়ির মত নয়। লম্বা,পেট চওড়া, শরীরে শক্ত আবরন। পাতাল চিংড়ি এখনো লোকের খাদ্য হয়ে ওঠেনি। বেচারা! শম্ভু ওটা সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে অল্প একটু তেল দিয়ে কড়াইতে নেড়ে লংকা ভাজা দিয়ে মেখে খেতে দিয়েছিল। “খা, খায়া দ্যাখ। আরে লোক কি গাঙের সব মাছ কে চিনে? চিনেনি বলিয়াই সব খায়নি। এগাও একদিন খাবে লোক, দেখবু।”। খেয়েছিলুম। খেয়ে বুঝে উঠতে পারছিলুম না কেন লোকে এগুলো খায় না।
রাত্রে তাঁবুর বাইরে হাঁটছি। একটা ছোট্ট চড়া, যেন দ্বীপ। সবাই তাঁবুর ভিতর। আমি রাজার মতো হাঁটছি। মনে হল এই রাজ্যের রাজা হলে মন্দ হয় না। একটা নিজস্ব দ্বীপ। ঝন্টুদার তাঁবু তে সে আর সুবোল দা’র বৌ। কিরকম খসখস শব্দে এগিয়ে গেলাম। ঝন্টুদা বলছে ” দ্যাখ চঞ্চলী তোকে ছাড়া বাঁচবোনি আমি। তুই আমার সব। ”
আমিও শুধু তুমার।
সশব্দে ঝন্টুদা চঞ্চলী বৌদিকে চুমু খাচ্ছে।ধীরে ধীরে সেই মন্থর চুমু একটা ঝোড়ো রূপ নিয়েছে। অসংখ্য চুমুর বেগতিক শব্দ। আমি তাঁবুর কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে। তাঁবুর ভিতরে একটা তুফান চলছে। আমি এত বড় তুফানের সামনে দাঁড়িয়ে ঘেমে যাচ্ছি। হঠাৎ কাঁধে কারুর হাত। আমি চমকে উঠলাম। শম্ভু। ” চ’ ঘুমাইবু চ’ ”
আমি ধরা গলায় ফিসফিস করে বল্লেম ” কী হটে?”
শম্ভু কিছুই বল্লেনা। তাঁবুর মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেও চঞ্চলী বৌদির অদ্ভুত গলার অচেনা শব্দগুলো কানে বাজছিল।
সকালের ঠাণ্ডাটা আজ বড্ড বেশি। শম্ভু তাঁবুতে নেই। দক্ষিণ প্রান্তে কিছু কুড়োচ্ছে। কাছে গেলাম। ঝিনুক কুড়োচ্ছে। অন্তত খান দশেক সাদা বেগুনি ঝিনুক দু’হাতে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল৷ আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বল্লে ” গৌরিকে দুবো। পেজেন।”
আমি অবাক হয়ে বল্লেম ” পেজেন?”
” জাঁউনি? ভালাবাসাকে দ্যায়”
বুঝলাম, উপহারের কথা বলছে। প্রেজেন্টেশন। মাথা নেড়ে বল্লেম ” বুইতে পারছি।”

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(নবম পর্ব)”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *